বুড়ো হওয়াতে খুব আপত্তি ছিল সুকুমার রায়ের। ‘আতঙ্ক’ ছিল বললেও বোধহয় বাড়াবাড়ি হবে না। ‘হ-য-ব-র-ল’-এর উধো রীতিমতো ভয় আর অবিশ্বাসের সুরে বলে, ‘শেষটায় বুড়ো হয়ে মরি আর কি!’ আর গল্পের শেষে বালক নায়কের জবানিতে সুকুমার নিজেই বলেন, ‘মানুষের বয়স হলে এমন হোঁতকা হয়ে যায়, কিছুতেই কোনো কথা বিশ্বাস করতে চায় না।’ ঋষিবাক্য। তিনি চাননি, কেউ হোঁতকা হয়ে যাক। কিন্তু ঋষিবাক্য আর আমরা কবেই বা শুনেছি? তাই আমাদের চিন্তা হোঁতকা, চলন হোঁতকা।
বেঁচে থাকলে সুকুমার রায়ের নশ্বর দেহের বয়স হত ছ’-কুড়ি ষোলো। কিন্তু সে তোমাদের হিসেব অন্যরকম। তাঁর নিজের হিসেব অনুযায়ী, চল্লিশে পৌঁছে তিনি নিজেই উনচল্লিশ, আটত্রিশ করে বয়স কমাতে থাকতেন। দশ পর্যন্ত নামলে আবার উঠতে দিতেন। আজ হয়তো তাঁর আসল বয়স হত তেরো। সুকুমার চল্লিশ পার করেননি। ভাগ্যিস করেননি। করলে হয়তো চারপাশের এই কুৎসিত জগৎ তাঁকে তেড়ে মেরে ডান্ডা করে দিত ঠান্ডা।
বুড়ো হওয়াতে খুব আপত্তি ছিল সুকুমার রায়ের। ‘আতঙ্ক’ ছিল বললেও বোধহয় বাড়াবাড়ি হবে না। ‘হ-য-ব-র-ল’-এর উধো রীতিমতো ভয় আর অবিশ্বাসের সুরে বলে, ‘শেষটায় বুড়ো হয়ে মরি আর কি!’ আর গল্পের শেষে বালক নায়কের জবানিতে সুকুমার নিজেই বলেন, ‘মানুষের বয়স হলে এমন হোঁতকা হয়ে যায়, কিছুতেই কোনো কথা বিশ্বাস করতে চায় না।’ ঋষিবাক্য। তিনি চাননি, কেউ হোঁতকা হয়ে যাক। কিন্তু ঋষিবাক্য আর আমরা কবেই বা শুনেছি? তাই আমাদের চিন্তা হোঁতকা, চলন হোঁতকা।
পরশুরাম রচনাবলির ভূমিকায় প্রমথনাথ বিশী দেখিয়েছিলেন, পরশুরামের অমর চরিত্রগুলোর মধ্যে কেউ কেউ আবিষ্কার, যারা আমাদের আশপাশেই থাকে। আর বাকিরা সৃষ্টি। পরশুরামের চেয়ে সাত বছরের ছোট, কিন্তু সাহিত্য রচনায় তাঁর ঢের সিনিয়র সুকুমারও অজস্র অমর চরিত্র তৈরি করেছেন। তাদেরও কেউ কেউ আবিষ্কার, বাকিরা সৃষ্টি। এদের মধ্যে এমন দু’জন আছেন, যাঁরা যে কেবল আমাদের দৈনন্দিনতার বিপ্রতীপেই অবস্থান করেন তাই নয়, আমার চোখে তাঁরা রীতিমতো বিপ্লবী– দাশরথি ওরফে পাগলা দাশু আর ‘চলচিত্তচঞ্চরী’-র ভবদুলাল। এরা দু’জনেই বুড়ো হওয়ার বিরুদ্ধে সুকুমারের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন।
আজ থেকে ১০০ বছরেরও বেশি আগে একটা গ্রামের ইশকুলের গপ্পে পাগলা দাশু যেভাবে এন্ট্রি নেয়, তা কয়েকশো কোটি টাকা খরচ করে বানানো ‘জওয়ান’-এ শাহরুখ খানের এন্ট্রিকেও চ্যালেঞ্জ দিতে পারে। সে আত্মবিশ্বাসী, ভাবুক, আত্মসচেতন, দার্শনিক, দরকার হলে ম্যানিপুলেটিভ এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ, লাইফ কোচ এবং চূড়ান্ত প্র্যাকটিকাল কিন্তু তার ‘পাগলা’ ভাবমূর্তি অতি যত্নে রক্ষা করে। সুকুমার রায়ও ধন্দে ছিলেন, ‘আচ্ছা, দাশু কি সত্যি সত্যি পাগল, না, কেবল মিচকেমি করে?’
আর ‘চলচিত্তচঞ্চরী’-র ভবদুলাল শুধু বাংলা সাহিতেই নয়, বিশ্বসাহিত্যেও এক বিরল চরিত্র। দুনিয়া সার্ভান্তেস-এর ডন কিহোতেকে নিয়ে মাতামাতি করে, কিন্তু ভবদুলাল কম কীসে? এই আপাতনিরীহ গোবেচারা ডিমেনশিয়া-আক্রান্ত লেখক যশোপ্রার্থী লোকটা দেশলাই কাঠির মতো। শুধুমাত্র Faux Pas-এর জোরেই সে আগুন লাগিয়ে দিতে পারে দুই বিবদমান গোষ্ঠীর মধ্যে। তাকে দেখেও আমাদের সন্দেহ হয়, লোকটা কি সত্যিই এরকম তারকাটা, নাকি স্রেফ মিচকেমি করছে?
কিন্তু দাশু আর ভবদুলাল-এর যেটা আসল মিল, তা হল– দু’জনেই বিপ্লবী। আমাদের প্রতিদিনের যাপনের একেবারে উল্টোবাগে দাঁড়িয়ে এই দু’জনই সম্পূর্ণ নিজের শর্তে বাঁচে। এদের কোনও ভয় নেই, ভনিতা নেই, ভালনারেবিলিটি নেই। এদের হারানো যায় না।
দাশু যখন তার খামচিয়ে জোগাড় করা দেবদূতের চরিত্র শেষ হতে না দিয়ে নাটকের শেষ দৃশ্যে আউট অফ টার্ন মঞ্চে এসে মন্ত্রীর খেই হারিয়ে ফেলা বক্তিমে নিজে শেষ করে আর তারপর প্রায় আদেশের মতো বলে, ‘যাও সবে নিজ নিজ কাজে’, সে কি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় না, আমরা একটা পরশ্রীকাতর জাতি হিসেবে নিজ নিজ কাজ বাদ দিয়ে স্রেফ পড়শির শোওয়ার ঘরে উঁকি মেরে এবং চায়ের কাপে রাজা-উজির বধ করে কেমন ক্ষুদ্র আর আপাত-নষ্ট একটা জীবন বাঁচছি? যে জীবন ফড়িংয়ের দোয়েলের, আমাদের সাথে তার হয় না কো দেখা। কিন্তু দাশু দেখিয়ে দেয়।
মিহিদানার হাঁড়ির ভেতরে রাখা পটকা ফাটিয়ে ইশকুলসুদ্ধ আতঙ্ক তৈরি করে দাশুর অবিচল ডিফেন্স– আমার পটকা আমি যা ইচ্ছে তাই করব। আমরা কেউ বলতে পারি কি এভাবে? আমাদের কি মনে পড়ে যায় না, সুকুমারের মৃত্যুর ১৬ বছর পরে, নিজের জীবনের শেষ বছরে লেখা ‘তাসের দেশ’-এ রবীন্দ্রনাথ রাজপুত্রের মন্ত্রের নাম দিয়েছিলেন, ইচ্ছেমন্ত্র? ‘–ইচ্ছে ! –ইচ্ছে! সেই তো ভাঙছে, সেই তো গড়ছে, সেই তো দিচ্ছে নিচ্ছে।’ আর তারও প্রায় সাড়ে পাঁচ দশক পর এক নাগরিক কবিয়াল গাইবেন, ‘ইচ্ছে হল এক ধরনের গঙ্গাফড়িং, অনিচ্ছেতেও লাফায় খালি তিড়িংবিড়িং।’ কোথাও কি দাশুর ছেঁড়া ছাতা আর এই দুই প্রবল পুরুষের রাজছত্র মিলে চলে যায় না এক বৈকুণ্ঠের দিকে, যার নাম ‘ইচ্ছেমতো বাঁচো’?
রামকৃষ্ণ বলতেন, ‘সংসারে থাকবি পাঁকাল মাছের মতো। জলটা গায়ে লাগবে, পাঁকটা লাগবে না।’ ভবদুলাল এই যাপনের এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ঠাট্টা, ব্যঙ্গ, অপমান এমনকী, শারীরিক নিগ্রহও তার আপনবেগে পাগল-পারা চলার পথে কোনও বাধা তৈরি করে না। দাশুর মতো করে না হলেও তার যাপন তার নিজের মতো করে। ‘আমার যা ইচ্ছে তাই করব’ এটা মুখে না বলেও সেভাবেই বাঁচা তার ধর্ম। এর সঙ্গে যোগ হয় তার শিশুর মতো কৌতূহলী চোখ, তার জ্ঞানপিপাসা এবং সব ছাপিয়ে গোটা জীবন আর সমাজের থেকে বিচ্ছিন্ন এক বিবিক্তি। পাঁকটা লাগে না। জলটা লাগে। আমাদের ঠুনকো জীবনচারিতাকে খানখান করে দেয় তার সারল্য আর আপাতউদ্ভট আচরণ। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, ছেলেবেলায় যে বেড়াল বা শজারুটা ভবদুলালকে কামড়ে দিয়েছিল, তাকে কোথায় পাওয়া যায়?
কাট টু
সুকুমার-পুত্র সত্যজিতের সৃষ্টি রহস্য-রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক লালমোহন গাঙ্গুলি ওরফে জটায়ু। আমার একটা প্রবল সন্দেহ, সত্যজিৎ এই চরিত্রের কাঠামোটা ধার করেছিলেন ভবদুলালের থেকে। দুটো নামের মধ্যে ‘লাল’-এও মিল। সুকুমার ভবদুলালকে ব্যবহার করেছেন, যাঁরা ধর্ম নিয়ে অন্তঃসারশূন্য বাগাড়ম্বর করেন আর পরমত অসহিষ্ণু হয়ে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে দীর্ণ হন– তাঁদের মিহিদানার হাঁড়িতে পটকা ফাটাতে। ভবদুলাল এক রাজনৈতিক চরিত্র। লালমোহন নন। সত্যজিৎ নিজের কোনও অ্যাজেন্ডা ফারদার করার জন্য লালমোহনকে সৃষ্টি বা ব্যবহার করেননি। কিন্তু হয়তো বা নিজের অজ্ঞাতসারেই, লালমোহন ওঁর তৈরি সব চরিত্রের তুলনায় ব্যতিক্রমী। ওঁকেও পাঁক ছোঁয়নি কখনও। গড়পারের ঘটি পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি খাড়াইয়ের লালমোহন ‘Vicariously’ বেঁচেছেন ওঁর হিরো প্রখর রুদ্রের মধ্যে। তাতে ওঁর অহং ক্ষুণ্ণ হয়নি।
লালমোহনের বইয়ের তিনমাসে ছ’টা এডিশন ছাপতে হত। কিন্তু উনি আর ওঁর দুই উজ্জ্বল পূর্বসূরি– দাশু আর ভবদুলালের আর কোনও এডিশন নেই। এঁরা তিন এবং অ-তৃতীয়।
গ্রাফিক্স অর্ঘ্য চৌধুরী