জলের অপরাধ, জল সবাইকে গ্রহণ করে নেয়। সে যদি জানতই তার এমন জীবনদায়ী ক্ষমতা, সে নোংরাকে উচ্ছিষ্টকে বিষকে আলাদা করতে শিখল না? তিনভাগ জল যদি, সমস্তটা ব্যবহারযোগ্য হল না কেন, এতই যদি বিবর্তন ঘটল মানুষের– এ কি প্রকৃতিরই অপরাধ নয়? সে তার নিজের সিস্টেম নিজেকে গুছিয়ে রাখতে পারে না? প্রকৃতি এহেন ভিক্টিম কার্ড ছুড়তে থাকলে, মানুষ যাবে কোথায়, ঈশ্বরেরও তো একটা দায়িত্ব আছে! জমজমের জল, শিবের মাথা, মায় গঙ্গার ফুঁসলে ওঠা মন– এসব এত সীমিত হবে কেন? অদৃষ্ট এমনই কৃপণ?
সে এক সময় ছিল। যখন বিদ্যুৎকে পকেটে ভরা যেত। প্যাকেটে বন্দি রাখা যেত। আদিম মানুষ মেঘ থেকে বিদ্যুৎ ঝরে পড়লে পটাপট বিদ্যুৎ কুড়োত। তারপর সুযোগ মতো আগুন, আলো বিবিধ প্রয়োজনে ব্যবহার করত। পাথরেও গেঁথে রাখত বিদ্যুৎকে। কিন্তু যেদিন থেকে কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদন শুরু করল, তারপর থেকে বাজ আর মাটিতে পড়ল না। মাথাকেই বেছে নিল।
এমনই বললাম। বরং, টিভিটা অন করুন।
প্রবল টেনশনের মুহূর্ত। পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করছে অভিযুক্তকে। ততক্ষণে আমরা জেনে গিয়েছি, সে একেবারেই ‘অভিযুক্ত’ নয়। একদম ‘কাঠ আসামি’। তার অপরাধের সমস্ত নুইসেন্স আমরা দেখে ফেলেছি। এবং, জিজ্ঞাসাবাদের এই পর্বে নিজের অপরাধের কথা সে প্রায় আলজিভ অবধি এনেই ফেলেছিল বলে। দেখতে পাচ্ছি, সিনেমা তখনও অর্ধেক বাকি, তবু, বিশ্বাস না করে পারছি না, এই বার পুলিশের প্রশ্ন থেকে তার নিস্তার নেই! বুক ঢিপঢিপ করছে, নাকের ডগায় ঘাম চলে এসছে আমাদের। রক্ত ছুটতে শুরু করেছে আমাদের রগে রগে। সেই চাপ সামলাতে আমরা যেই না পাশে রাখা জলের বোতলটা তুলেছি, ওমনি সেই হবু অপরাধী বলে উঠল, একটু জল চাই।
ব্যস! আলজিভ অবধি পৌঁছে যাওয়া সেই সত্য সকলই সত্যখানি এক ঢোকে গিলে নিলেন হায় রে তৃষ্ণার্ত! যদিও শেষমেশ জলের মতো সহজ হয়ে ধরা দেবে তার যাবতীয় প্যাঁচ-পয়জার, তবু এই জলই তার ধরা পড়ে যাওয়াকে আরও খানিক প্রলম্বিত করল, আরও খানিক বেড়ে গেল আমাদের টেনশন, সিনেমাকেও আরও বেশ কিছুক্ষণ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া গেল ঘটনার বাষ্পে, সঘনতায়। এমন দৃশ্য আমরা বহু বহু সিনেমায় দেখেছি।
তা জল দিয়ে কেবল সত্য নয়, কান্না, টেনশন, জ্বর, জ্বরের ওষুধ বহুকিছুই গিলে হজম করে ফেলা সম্ভব, এমনকী, একরত্তি জীবনকেও। এই ধরাধামে, জল যে ‘জীবন’-এর উপমা পেল, তার কারণ হিসাবে বলা হয়, যা আমাদের ঠোঁটস্থ, জল ছাড়া পৃথিবীর কোনও সজীব বস্তু বাঁচতে পারে না।
কিন্তু এটা তো কারণ নয়, এটা ফলাফল! কারণটি এ-ই যে, জলের মতো আর কারও এত নানাবিধ বস্তুকে দ্রবীভূত করার ক্ষমতা নেই। সজীবতার কারখানা সচল সক্রিয় রাখতে গেলে কোষে কোষে যে বিক্রিয়ার মাধ্যমে শক্তি উৎপাদন প্রয়োজন, তার মাধ্যম মূলত জল।
তাই জল চাই। সে খাদ্যকে শুষে নেবে পাকস্থলীর দেওয়াল জুড়ে, অক্সিজেন শুষে নেবে রক্তের প্রবাহে। কিন্তু, এ সমস্ত কাজকে পরিচ্ছন্নভাবে চালিয়ে যেতে পরিচ্ছন্ন জলের প্রয়োজন সবার আগে যে, তা আমরা বেমালুম এড়িয়ে গেলাম।
পৃথিবীর তিনভাগ জলের প্রাচুর্যতায় বিভোর হয়ে আমরা সেই পর্যায়ে পৌঁছেছি যেখানে গঙ্গার জল একইসঙ্গে পবিত্র ও ঘোলাটে! সমুদ্রের নোনা জল প্রাকৃতিকভাবেই পরিস্রুত হয়ে নদীতে এসে মিষ্টিভাব পেল, সেই নদীকে কেন্দ্র করে আমরা সভ্যতার উন্মেষ ঘটালাম, বেঁচে থাকার যাবতীয় রসদ মেটালাম, আর দৈনন্দিন চক্রাকার জীবনবেত্তায় আমাদের উদ্বৃত্ত, রেচন, বর্জ্য-মিশ্রিত জলকে সঠিক উপায়ে প্রকৃতির কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলাম তো না-ই, উপর্যুপরি ওই নদীকেই বানিয়ে ফেলাম আমাদের মহৎ নালা। শুধু নদী নয়, কালক্রমে দিঘি, পুকুর যাবতীয় জলাশয় আমাদের গ্রহণ থেকে বর্জন অবধি সমস্ত প্রাপ্তিকে মাথা পেতে নিয়েছে।
আর সেই জলকে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করে তুলতে আমরা আরও সভ্য, প্রযুক্তিধন্য, বুদ্ধিমান হয়ে উঠলাম। ঠিক যেভাবে হাওয়াকে প্রাণের আরাম বানিয়ে আমাদের ঘরকে ঠান্ডা করতে আমরা এসি চালাই, আর এসির একজস্ট বাইরের দিকে তাক করে বাইরের হাওয়াকে আরও গরম করে তুলি, এবং সেই গরমে হাঁসফাঁস করে ঘরের ভেতর ঢুকে এসির দাগ আরও দু’ঘাট কমিয়ে দিয়ে জীবনের সাফল্য উদ্যাপন করি, আমাদের জলকে ব্যবহারযোগ্য করে তোলার উপায়ও এরকমই আত্মঘাতী।
পানীয় জল সরবরাহের আগে, তাকে নানাবিধ রাসায়নিক উপায়ে নিষ্কলুষ করার প্রক্রিয়াকরণটি যে স্বল্প পরিমাণ জলকে সার্থকজন্ম দেয়, তার বহুগুণে অধিক পরিমাণ জল এবং তামাম পৃথিবীর পরিসরকে তা দূষিত করে তোলে। তারপর যে-জল আবদ্ধ পাইপ বেয়ে আমাদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে, সেখানেও আমাদের অপচয়ের শেষ থাকে না। বাসন মাজতে মাজতে আমরা কল চালিয়ে রাখি। বালতি ভরতে দিয়ে আমরা অন্য কাজে লেগে পড়ি। আর আমাদের শুচিবাই মন সবকিছুকে একেবারে ধুয়ে দেওয়ার উচাটনে গ্যালন গ্যালন জলের জীবনহানি ঘটায়।
উষ্ণায়নের তেজও এমন যে, সেই জলের উত্তরণের পরেও তার পুনর্জন্ম হতে চায় না। ফালাকাটা মেঘ জীবনের ভূত হয়ে উড়ে বেড়ায়। আর, একসময় ফুঁসতে ফুঁসতে সন্ত্রাসী ঝড় হয়ে আছড়ে পড়ে কোথাও। কোথাও আবার কয়েক বছর এমনকী, দশকের জন্য বেপাত্তা হয়ে যায়। প্রকৃতি যদি তার নিয়ম পাল্টে ফেলে, যদি তার ছাঁকনি ঘেঁটে যায়, সেই পরিস্থিতির খেলাপি করতে মানুষ কি পেরেছে?
ভারতের প্রযুক্তির স্বর্গ বলে বিদিত কর্নাটক, বেঙ্গালুরু পেরেছে তাদের প্রযুক্তি দিয়ে জল সংকট আটকাতে? তা কোনও দিনই সম্ভব নয়। কারণ, মানবসভ্যতার বিপ্লব ঘটেছেই অপচয়ের উপর ভিত্তি করে। পুঁজিবাদী, ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি গড়েই উঠেছে প্রকৃতির সম্পদকে বিনষ্ট ও যথেচ্ছ ব্যবহারকে কেন্দ্র করে। মানুষ এই অপচয়কে সরলায়িত করতেই ধোপদুরস্ত ভদ্র-সভ্যের আদলে সাদা রংকে আভিজাত্য দিয়েছে। আমরা যে যত বেশি নিজেদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হিসেবে ঠাওরানোর প্রয়াসে লুটোপুটি খেয়েছি, আমরা ততটাই নোংরা করেছি আশপাশকে। নিজেদের ময়লার দায়িত্ব নিইনি। উলটে, ড্রেন পরিষ্কার করা, বাথরুম সাফাই করা মানুষগুলোকে বানিয়ে তুলেছি অস্পৃশ্য।
বৃষ্টির সময় যে কোনও নদী বা পুকুর ভরে ওঠে, ছিপ নিয়ে নৌকো নিয়ে মাছ ধরার তোড়জোর লেগে পড়ে। কিন্তু জলাশয় বা স্রোতস্বিনীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালে লক্ষ করবেন, বৃষ্টির এক-একটা ফোঁটা সেই জলের আধারে উধাও হয়ে যাচ্ছে আদপে। মেঘ থেকে আসা জল গুলে যাচ্ছে আমাদের পাপ মেশানো ‘পবিত্র’ জলে।
কিন্তু ওসব বাতুলতা। জলের অপরাধ, জল সবাইকে গ্রহণ করে নেয়। সে যদি জানতই তার এমন জীবনদায়ী ক্ষমতা, সে নোংরাকে উচ্ছিষ্টকে বিষকে আলাদা করতে শিখল না? তিনভাগ জল যদি, সমস্তটা ব্যবহারযোগ্য হল না কেন, এতই যদি বিবর্তন ঘটল মানুষের– এ কি প্রকৃতিরই অপরাধ নয়? সে তার নিজের সিস্টেম নিজেকে গুছিয়ে রাখতে পারে না? প্রকৃতি এহেন ভিক্টিম কার্ড ছুড়তে থাকলে, মানুষ যাবে কোথায়, ঈশ্বরেরও তো একটা দায়িত্ব আছে! জমজমের জল, শিবের মাথা, মায় গঙ্গার ফুঁসলে ওঠা মন– এসব এত সীমিত হবে কেন? অদৃষ্ট এমনই কৃপণ?
জলকে এই জিজ্ঞাসাবাদ করতে করতে একদিন জল যদি ওই বিদ্যুতের মতোই কেবলমাত্র আমাদের কড়কানোর জন্য বাস্তব হয়ে ওঠে, আর সুদৃশ্য বোতলে ভরে রাখতে পারবেন তো? অক্সিজেন আর হাইড্রোজন মিশিয়ে জল বানানোর সূত্র, কিংবা পকেটে অত ট্যাঁক সইবে? এত অপরাধ গিলে নেওয়ার মতো জল আমাদের মুখের গোড়ায় আর নেই মনে হয়।
নয়তো, বিজ্ঞানীরা মঙ্গল, চাঁদ, বুধে জল খুঁজতে এত অর্থব্যয় করে?