সিনেমার ভিলেন হলে ভাবুন, দু’হাতে শত্রুর গলা টিপছে, একহাত দিয়ে নিজের চুল আঁচড়ে নিচ্ছে– এমন দৃশ্যে ভায়োলেন্সের পারদ চড়ত ধেইধেই করে! নেশারু কবি হলে, লেখা থামাতেই হত না, একহাত দিয়ে মদ-সিগারেট, বাকি দু’হাতে পদ্যখানি। যে খুব পিটপিটে, পশ্চাদ্দেশ ধৌতকরণের জন্য একখানা হাত রেখে দিত আগলে। এমনও হতে পারে, নিরামিষ রান্না ও আমিষ রান্নার জন্য হাত ভাগাভাগি হয়ে গেল। যে ঘুষখোর, দু’হাত টেবিলে রেখে একহাত বাড়িয়ে দিত নীচ দিয়ে। যে মস্ত বড় ফুড ব্লগার, সে দু’হাতে খেত, আরেক হাত হত তার সেলফি স্টিক। রবীন্দ্র জাদেজার মতো দুরন্ত ফিল্ডার, দু’হাত পকেটে ঢুকিয়ে হয়তো একহাতেই ক্যাচ ধরতেন– ‘সোয়্যাগ’ আর দেখে কে!
হাতের প্রতি বাঙালির চিরকালই একটু টান আছে। সে হাতের লেখা বলুন বা হাত ধরা। হাতপাখা কিংবা হাতেখড়ি। হাতলণ্ঠন কিংবা হাতবাক্স। প্রবাদের দিকে গেলে কেসখানা আরও জটিল! ‘হাতে মাথা কাটা’, ‘হাতে নয়, ভাতে মারা’ কিংবা ‘হাতের জল শুকোয় না’– বিচিত্র ব্যাপারস্যাপার! এমন হাতেনাতে প্রমাণিত জাত বিশেষ নেই।
দেবদেবী হিসেবেও বাঙালি তাঁদেরই বেছে নিয়েছে, যাঁদের হাতটাত একটু বেশি সংখ্যায় রয়েছে। কেউ তেড়ে কাজকম্ম করলে শ্লাঘাভরে ব’লে ওঠে, ও দশহাতে কাজ সারে। খারাপ লিখলে বলে, বাঁ-হাতের লেখা। ডনের প্রিয়পাত্র হ’লে বলে– ও হল মালটার ডানহাত। এমনকী, নতুন কাজের লোক বাড়িতে আনার আগে এ-পাড়া সে-পাড়া খোঁজ নেয়– হাতটান-ফান নেই তো? বাঙালি এত কিছু প্রার্থনা করে– ভক্তি, অর্থ, সমবেদনা, অমরত্ব, প্রেমিক-প্রেমিকা, ছন্দবোধ, টাকে চুল, বিনিমাগনায় ওয়াইফাই, তাবড় ফ্ল্যাট, রাজকুমার রাও, ওয়ামিকা গাব্বি– অথচ কেউ কি কখনও একখানা বাড়তি হাত চেয়েছে? দু’হাতে কুলোচ্ছে না মা, আরেকটা দাও প্লিজ? তবে, একখানাই, দুটো চাইলেন আর যদি প্রার্থনা ফলে যায় মাইরি– দেখবেন, কেউ না কেউ ঠিক আপনাকে ‘দ্যাবতা’ বানিয়ে ফেলেছে।
আরও পড়ুন: জেলখানায় লেখা এক চলমান রচনা
শুধু বাঙালি কেন, আপামর মনুষ্য়জাতিরই তিনহাত হলে বেজায় সুবিধে হত!
সিনেমার ভিলেন হলে ভাবুন, দু’হাতে শত্রুর গলা টিপছে, একহাত দিয়ে নিজের চুল আঁচড়ে নিচ্ছে– এমন দৃশ্যে ভায়োলেন্সের পারদ চড়ত ধেইধেই করে! নেশারু কবি হলে, লেখা থামাতেই হত না, একহাত দিয়ে মদ-সিগারেট, বাকি দু’হাতে পদ্যখানি। যে খুব পিটপিটে, পশ্চাদ্দেশ ধৌতকরণের জন্য একখানা হাত রেখে দিত আগলে। এমনও হতে পারে, নিরামিষ রান্না ও আমিষ রান্নার জন্য হাত ভাগাভাগি হয়ে গেল। যে ঘুষখোর, দু’হাত টেবিলে রেখে একহাত বাড়িয়ে দিত নীচ দিয়ে। যে মস্ত বড় ফুড ব্লগার, সে দু’হাতে খেত, আরেক হাত হত তার সেলফি স্টিক। রবীন্দ্র জাদেজার মতো দুরন্ত ফিল্ডার, দু’হাত পকেটে ঢুকিয়ে হয়তো একহাতেই ক্যাচ ধরতেন– ‘সোয়্যাগ’ আর দেখে কে! শচীনের টেনিস এলবোর জন্য খামোকা বছর নষ্ট হত না সেরে উঠতে। বাস কন্ডাকটর একহাতে বাসের টিন বাজিয়ে লোক তুলতেন, বাকি দু’হাতে টিকিট ও টাকা বুঝে নিতেন। ফুচকাওয়ালা একহাতে নাক ঝাড়তেন, অন্য দু’হাত দিয়ে তেঁতুলজল গুলতেন আর হাইজেনিক ফুচকা পরিবেশন করতেন, হইহই করে হিট হত তাঁর ফুচকার দোকান। টুকলিবাজ ছাত্র তৃতীয় হাতে লুকিয়ে রাখত যত রাজ্যের চোতা। চুম্বনকালে দু’হাতে গাল ধরে, আরেক হাতে যৌনতার রাস্তায় গড়গড়িয়ে ঢুকে যাওয়া যেত। শাহরুখ খান দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়েও আরেক হাত নাড়তে পারতেন দিব্যি। তবলাবাদক ডায়না-বাঁয়ায় তাল দিতে দিতেই হাতুড়ি নিয়ে খানিক ঠুকে মেরামত করে নিতে পারতেন। পাঞ্জা লড়তে গিয়ে হারছি-হারব পরিস্থিতি হলে, এই তৃতীয় হাতের আলতো চোট্টামিতে জিতে যাওয়া যেত।
আরও পড়ুন: স্বপনকুমার স্বপ্ন লিখতেন, সাহিত্য নয়
একইসঙ্গে দেখানো যেত, একহাতি তালি বাজে না, আর দু’হাতে তালি বাজে। জাগলারদের মস্ত সুবিধে হত। পিসি সরকার ওই একখানা বাড়তি হাত বের করেই যত ম্যাজিক করে ফেলতে পারতেন। ক্যারাম-লুডো-তাস খেলতে গিয়ে অবশ্য বেজায় চিটিংয়ের খপ্পরে পড়তে হত, তা হোক। ক্লাসরুমে ‘উপস্থিত’ বলার সময় প্রক্সিকালে এই তিন নম্বর হাতখানা উঠলে অতটা সন্দেহ হত না। তবে, জল বলুন বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার– বেজায় খচ্চা হত। একহাতে চোখ ঢেকে আরেক হাত বুকের উপর রেখে, দিব্যি মাথায় বুলিয়ে নেওয়া যেত একাকিত্বের হাতখানি। দু’হাতে শশব্যস্ত হয়ে অন্য কাজকম্মো করা যেত, আরেক হাতে দিব্যি পড়া যেত রোববার.ইন!
তবে, ঝামেলাও কিছু কম হত না। এই যে নারায়ণমূর্তি বলেছেন হপ্তায় ৭০ ঘণ্টা কাজ করতে। তিনহাত হয়ে গেলে উনি আবার বলে বসতেন– সপ্তাহে ১০৫ ঘণ্টা। হাতপ্রতি ৩৫ ধরে। এদিকে হাতে যে হাতখরচ বাড়ছে, এমন না। এ কেমন কথা! জ্যোতিষীদেরও বেজায় অসুবিধে হত। দুটো হাতের মধ্যে ডান-বাম করা যায়। কিন্তু তিনখানা হাত হলে কি ‘আপন বাপন চৌকি চাপন’ করে বেছে নেবেন? আধার সেন্টারেই বা কোন আঙুলের ছাপ দেবেন? কংগ্রেসের লোগোতে যে হাতের তালু, তারাই বা কোন হাত বেছে নেবেন! হ্যান্ডশেক করলে কোন হাতখানা বাড়াবেন, উল্টোদিকের লোকের সঙ্গে সে হাতের তালু মিলবে কি না– এ একটা গন্ডগোলে কেস হতে পারে! এই কয়েকটা খুচরো ঝঞ্ঝাট ছাড়া, মাইরি, তৃতীয় হাত জুটলে ভাল বইকি মন্দ হত না।
তবে, তৃতীয় হাত পেলেও রাজনৈতিক নেতাদের কিছু অদলবদল হত না। অপকীর্তির হাতখানা গুঁড়িয়ে দিয়ে দেখা যেত, একখানা হাতও তাঁদের আস্ত নেই!
প্রচ্ছদের ছবি: অর্ঘ্য চৌধুরী
একজন বিজ্ঞানী জীবন বিপন্ন করে কর্পোরেট চালিত রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। দেশের গোয়েন্দা বাহিনী তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল, তারা দেশাইকে ফেরায়নি। না ফেরানোর জন্য জবাবদিহি করেনি। এবং নানা কারণের সংযোগে আজ ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্য কেন্দ্র আজ সাগর জলে।