‘পারফেক্ট ডেজ’ উইম ওয়েন্ডার্স-এর সাম্প্রতিকতম ছবি। জাপান-এর টোকিও শহরের প্রেক্ষাপটে– ‘the brothel called the land of rising sun.’ উইম-এর একেকটি ছবি একেক জায়গায় গড়ে ওঠে, ওই একটি একলা ফকিরকে ঘিরে। উইম-এর ছবিতে কথা থাকে না প্রায়, বস্তুত এত কথার কী-ই বা প্রয়োজন জীবনে, বিশেষত সিনেমায়– পারফেক্ট ডেজ-এ কয়েকটি পারফেক্ট কথাবার্তা বুনে ওঠে গাছেদের সঙ্গে, আলোর রশ্মির সঙ্গে, জলের সঙ্গে, গভীর রাতের সাদাকালো স্বপ্নের সঙ্গে।
সোহিনী দাশগুপ্ত
উইম ওয়েন্ডার্স-এর সেই যে একলা লোকটি পথ চলা শুরু করেছে প্রথম থেকে, সে আজও থেমে যায়নি। জীবন ছুঁয়ে, জীবন ছেনে পথভোলা ওই পথিক কাল আবার দেখা দিয়ে গেল আমাদের। হাসিয়ে-কাঁদিয়ে-রাঙিয়ে দিয়ে গেল। ‘প্যারিস টেক্সাস’-এ, এই লোকটা ঘুরতে ঘুরতে কয়েকদিনের জন্য একটু যেন শান্ত হয়ে বসেছিল, বাড়ির সবার জুতো ধুয়ে, তকতকে পরিষ্কার করে রোদে শুকিয়ে রাখত সে। ‘লিসবন স্টোরি’তে বন্ধুকে খুঁজতে খুঁজতে ঘুরতে ঘুরতে একলা লোকটা পাড়ার বাচ্চাগুলোকে লাইট অ্যান্ড সাউন্ড-এর ম্যাজিক দেখাত। ‘পারফেক্ট ডেজ’ সে একা একা টোকিও শহরে ঘুরে ঘুরে কাটিয়ে দেয় দিন; মুখে তার আজও সেই প্রসন্নতা, ছোট এই জীবনের নিত্যদিনের বিস্ময়বোধ।
‘পারফেক্ট ডেজ’ উইম ওয়েন্ডার্স-এর সাম্প্রতিকতম ছবি। জাপান-এর টোকিও শহরের প্রেক্ষাপটে– ‘the brothel called the land of rising sun.’ উইম-এর একেকটি ছবি একেক জায়গায় গড়ে ওঠে, ওই একটি একলা ফকিরকে ঘিরে। উইম-এর ছবিতে কথা থাকে না প্রায়, বস্তুত এত কথার কী-ই বা প্রয়োজন জীবনে, বিশেষত সিনেমায়– পারফেক্ট ডেজ-এ কয়েকটি পারফেক্ট কথাবার্তা বুনে ওঠে গাছেদের সঙ্গে, আলোর রশ্মির সঙ্গে, জলের সঙ্গে, গভীর রাতের সাদাকালো স্বপ্নের সঙ্গে। কে বলে সম্পর্কে থাকতে হবে কথোপকথন, কে বলে প্রেমে থাকতে হবে ডায়ালগ। কতরকমই হতে পারে বিনিময়! একটি ছোট্ট চুম্বন হারিয়ে দিতে পারে লাখো কথাকে! কবিতা তৈরি হতে পারে প্রতি মুহূর্তে, ‘Now is now! Next time is next time!’
একদম অন্যরকম একটি ছবি উইম ওয়েন্ডার্স-এর ‘পারফেক্ট ডেজ’! এতই স্বকীয় এই ছবির ভাবনা এবং বুনন, যে অবাক হতে হয়! It is a film with a deep phiosophy. মানুষের মনোনিবেশ করার ক্ষমতা নাকি আজকাল খুব বেশি হলে মিনিট দুই। দর্শক ধরে রাখার জন্য কত কিছুই না ভেবে বের করতে হয় পরিচালকদের– চমকের পর চমক চাই, ঘটনার পর ঘটনা, কিক-এর পর কিক চাই, প্রথম কথা কন্টেন্ট, শেষ কথা কন্টেন্ট– না, ৭৮ বছর বয়সি মায়েস্ত্র আবার অনাবিলতায় বুঝিয়ে দিলেন বিষয়টা যখন সিনেমা তখন প্রথম কথা ‘ল্যাংগুয়েজ’, শেষ কথাও ‘ল্যাংগুয়েজ’। ভাষা না থাকলে বিষয় মা-এর ভোগে যায়।
উইমের ছবির সেই লোকটা আজও ক্যাসেটে গান শোনে, অলিম্পিয়াস ক্যামেরায় সেলুলয়েডে ছবি তোলে আর রোজই এক বেঞ্চে বসে স্যান্ডউইচ খায়, মাথা তুলে গাছের পাতার দিকে তাকিয়ে থাকে, প্রেক্ষাগৃহ ভরে ওঠে পাতার মর্মরে। রোজ কাকভোরে দরজার বাইরে পা রেখে আকাশের দিকে তাকায় লোকটা আর তার মুখে ফুটে ওঠে হাসি– উইমের ছবির মতোই বিরল এই হাসি, জীবনের প্রতি, বেঁচে থাকার প্রতি এই কৃতজ্ঞতা। গল্প ছাড়া, ঘটনা ছাড়া, নামমাত্র সংলাপ-এর এই ছবি যেন মেডিটেশন-এর মতো। কোজি ইয়াকুসো এই ছবিতে ‘হিরায়ামা’ চরিত্রে অভিনয়-এর জন্য কান চলচ্চিত্র উৎসবে পেয়েছে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার। সত্যিই তাকে ভাল না বেসে উপায় থাকে না। এবং তবুও সব ক’টি চরিত্রই, সে যত ছোটই হোক না কেন, সামান্য নয়; দারুণ!
কিছুই হয় না এই ছবিতে, কিন্তু কত কিছুই যে হয় তার ইয়ত্তা নেই! কোনও ঘটনা ঘটে না অথচ ঘটেই চলে কিছু না কিছু। উইম-এর ছবি যেন বলে দেয়, দেখ, চোখ তুলে একবার দেখ, মন খুলে একবার দেখো– দেখতে পাবে চারপাশে কতরকম ম্যাজিক হয়ে চলেছে প্রতি মুহূর্তে।
এই প্রথম কোনও হিরোর সঙ্গে পরিচিত হলাম যার কাজ বাথরুম সাফ করা। আনন্দের সঙ্গে, ভালবেসে, রীতিমতো প্যাশনের সঙ্গে লোকটা এই কাজ করে নিখুঁতভাবে, যেন মন্দিরপ্রাঙ্গণ পরিষ্কার করছে সে। এই কাজ তার চয়েস, কারণ লোকটি প্ৰকৃত অর্থেই ‘ইন্টেলেকচুয়াল’। বই-ই তার জীবন, মিউজিক তার নিত্যসঙ্গী, গাছ তার বন্ধু। মানুষ ঘিরে, অন্য মানুষের জীবন ঘিরে তার রয়েছে শ্রদ্ধা আর স্নেহ। এই টালমাটাল সময়ে দাঁড়িয়ে, এই যুদ্ধ পরিস্থিতি তে দাঁড়িয়ে, রাজনৈতিক হিংস্রতার ভাগীদার হয়ে, রোজকার ইঁদুরদৌড়ে জেরবার এই ক্লান্তিকর সব-পেতে-হবে-র বেঁচে থাকার বিশ্বব্যাপী ন্যারেটিভ-এর একটি অত্যদ্ভুত প্রতিবাদ হিউমারে ভরা, আশ্চর্য মানবিক উইম ওয়েন্ডার্স-এর এবারের ছবি, ‘পারফেক্ট ডেজ’।
যথারীতি আপাদমস্তক সিনেমাটিক উইম ওয়েন্ডার্স এর এই ছবিটিও। টোকিও শহরের জনবহুলতা, উঁচু উঁচু ইমারত ভরা সিটিস্কেপও ছবিতে কবিতা হয়ে উঠেছে। আর তার সঙ্গেই দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রাচীন বৃক্ষরাজি। ফুটে উঠছে নতুন চারা। সিনেমার যে ভাষা আমাদের নিয়ে যায় অন্য চেতনার স্তরে, জাগতিকতার উর্ধ্বে সেই আধ্যাত্মিক কাব্যময়তাই এই ছবির প্রকাশ। আমরা যারা সিনেমা বানাই, সিনেমা বানাতে গিয়ে নাজেহাল হই, তারা জানি কী অসম্ভব কঠিন কাজ এটা। দৃশ্য, শব্দ, সুর, ছন্দ বুনে তৈরি হয় যেই পারফেক্ট সিনার্জি তা এভাবে আয়ত্ত কতিপয় চলচ্চিত্রকার পক্ষেই সম্ভব। টানটান ছবিটি দেখতে দেখতে হঠাৎ মনে হয়, রোজ যে সূর্য ওঠে তাকে কি একদিনও ‘থ্যাংক ইউ’ বলেছি আজ অবধি! শেষ দৃশ্যে চোখের জল আর মুখের হাসি হিরায়ামার মতোই ফুটে ওঠে আমার এবং আমাদের মুখেও। এমন ছবি শান্ত করে দেয় মন, ভরিয়ে তোলে। ছবি দেখে বেরিয়ে এসে গাছের কাছে চুপ করে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে, একা লাগে কিন্তু ভাল লাগে। মনে হয় ‘পারফেক্ট ডে’ বা ‘আদর্শ দিন’ বলে কিছু হয় না, আসলে প্রত্যেকটি দিনই ‘পারফেক্ট’।