মেয়েরা একশোবার প্রেমে পড়বে, আজীবন প্রেমে পড়ার অবকাশ যেন থাকে আমাদের সকলের। এই দাবি শুধু মেয়েদের ওপরই করা হয় যে সে একবার প্রেমে পড়বে, এবং একবারই বিয়ে করবে। বা প্রেমও করবে না, সিধে বিয়ে করে নেবে। একটি মেয়ের অধিকার নেই প্রেমে পড়ার। এদিকে ছেলেরা যা খুশি করতে পারে। কয়েক যুগ আগেও পুরুষ একাধিক বিয়ে করার অনুমতি পেত, অনুমতি শুধু নয়, সেটাই ছিল সমাজের ট্রেন্ড। আজ সেই পুরুষরাই মেয়ের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। যতদিন মেয়েদের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন করা হবে, ততদিন দীপিকার মতো সাহসী মেয়েরা তার একাধিক প্রেমের প্রসঙ্গ তুলবে প্রকাশ্যে। যাতে অস্বস্তিতে পড়ে যায় সমাজ।
আমরা অভিনেতা-অভিনেত্রীরা সর্বসমক্ষে যা-ই বলি না কেন, তার ভুল ব্যাখ্যা করবেই সমাজ। এটা আমরা মেনে নিয়েছি এতদিনে। যেদিন ‘কফি উইথ করণ’-এ দীপিকা পাডুকোন ও রণবীর সিং-এর এপিসোডটা রিলিজ করল, সেদিনই আমি রাতে দেখেছি। একটা এপিসোড শুট হতে সময় লাগে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা। এডিট টেবিলে সেটা একঘণ্টায় নামানো হয়। ফলে বোঝাই যাচ্ছে কতটা কাটছাট করতে হয়। দীপিকার যে কথাটার পরিপ্রেক্ষিতে আজ দীপিকা সমাজের চোখে ‘নষ্ট মেয়ে’ হয়ে গেল, সেই কথাটার আগে-পিছে কী আছে, আমরা তা জানি না কিন্তু। এমনকী জানি না পরের কথাটাও। কারণ আমাদের তা দেখানো হয়নি, জানানো হয়নি। একটা এডিটেড এপিসোড দেখেই ট্রোলিং শুরু হয়ে গিয়েছে সোশাল মিডিয়ায়, সমাজে, বোদ্ধাদের জ্ঞানগম্ভীর তর্কে।
আমরা দেখছি দীপিকা পাডুকোন নিজের অন্যান্য সম্পর্কের কথা বলছে, পাশে রণবীর সিং ‘ভাজা মাছটি উল্টে খেতে পারে না’ মুখ করে বসে আছে। ক্যামেরা কিন্তু টানা রণবীরের দিকে তাক করে রয়েছে। তা দেখে দর্শকের মনে হয়েছে রণবীর এসব আগে কিছু জানতই না। বা জেনেও সব সহ্য করে নিয়েছে স্ত্রীয়ের প্রতি অন্ধ ভালোবাসায়। কিন্তু এগুলো কোনওটাই সত্যি নয়।
আসলে আমাদের প্রত্যেকেরই জীবনে কোনও গভীর প্রেম ভেঙে গেলে আমাদের মধ্যে কমিটমেন্ট ফোবিয়া চলে আসে। আমরা ভয় পাই সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা মানুষকে বিশ্বাস করতে, ভরসা করতে। আমাদের মনে হয় আগের মানুষটির মতো এই মানুষটিও আমাকে আঘাত দিয়ে চলে যাবে। একটা আঘাতের ওপর আরেকটা আঘাত কি নেওয়া সম্ভব? আমরা ভয় পাই, আমরা নিজেদের প্রোটেক্ট করি। দীপিকা পাডুকোনও তার কিছু আগেই একটা গভীর সম্পর্ক থেকে বেরিয়েছে একটা চরম ডিপ্রেশনের সঙ্গে। দীপিকা নিজের মানসিক অবসাদ নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলেছে, আমরা সেই সময় আহা আহা করেছি। দীপিকার সাহসের প্রশংসা করেছি। কিন্তু এটা বোঝার চেষ্টা করেছি কি আসলে কোন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দীপিকাকে যেতে হয়েছে? যদি সেদিন বুঝতে পারতাম আমরা, তাহলে এটাও বুঝতে পারতাম যে কফি উইথ করণ-এ বসে দীপিকা আসলে কী বলতে চাইছে। একটা গভীর আঘাত নিয়ে একটা সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে দীপিকা হয়তো বুঝতে পারছিল না যে রণবীর সিং-এর প্রেমটা আসলে কতটা সত্য়ি, কতটা বাস্তব। রণবীর সিং-ও কি তা জানত সেসময়ে? যে এই প্রেমটাই তাঁর জীবনের সেই প্রেমটা? রণবীর এই সময় কী কী করেছে, তা কি রণবীর সাহস করে বলতে পেরেছে? দীপিকা রণবীর সিং-কে শুরুতেই গ্রহণ করতে পারেনি মানেই এই নয় যে সে সবার সঙ্গে প্রেম করে বেরিয়েছে, বহু পুরুষের সঙ্গ লাভ করেছে। দীপিকা কোনও সিরিয়াস সম্পর্কে জড়ানোর আগে সময় নিয়েছে, যাচাই করেছে, কিছু মানুষের সঙ্গে জড়িয়েছে, কাউকেই মনে ধরেনি। যাচাই না করে প্রেম বা বিয়ে করার ফল আর কতদিন মেয়েরা ভুগবে? একটা মেয়ে দেখেশুনে সম্পূর্ণ শিওর হয়ে একটা সম্পর্কে জড়িয়েছে, এটাই তো কাম্য। এটাই তো আধুনিক মানসিকতা।
অনেক সময়ই আসে, যখন পূর্বের সম্পর্কটা আমাদের নানা ধরনের অপ্রীতিকর প্রশ্নের সামনাসামনি করে দেয়। আমি নিজে একজন প্রেসক্রাইবড মেন্টাল পেশেন্ট, আমি জানি এই সময়গুলোতে মানসিক তোলপাড় কোন জায়গায় যেতে পারে। সেই জন্যই আমি আজ এটা ব্যাখ্যা করতে পারছি। দীপিকা হয়তো রণবীর সিং-এর থেকে ভালোবাসা পাচ্ছে, আশ্রয় পাচ্ছে, নিশ্চিন্ততা পাচ্ছে, কিন্তু কোথাও গিয়ে সে এটা বিশ্বাস করতে পারছে না যে ওকেও কেউ ভালোবাসতে পারে। আর মনে রাখতে হবে, সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে পর্দায় নায়ক-নায়িকা সবাই একভাবেই ভাবে, সবার একই ইনসিকিওরিটি। আমি তো বলব, দীপিকা কফি উইথ করণের মতো একটা প্ল্যাটফর্মে এসে যে বলতে পেরেছে নিজের এই সময়টার কথা, সেটার জন্য সাহসের দরকার হয়। সে নিজের কিছু অস্বত্বিকর অতীতের কথা বলার সাহস রেখেছে। এবং এসবকিছুই সে বলছে স্বামীর পাশে বসে, কনফিডেন্সের সঙ্গে, গরিমার সঙ্গে। তার বর্তমান পার্টনার কী ভাবল তার অতীত নিয়ে, সে ব্যাপারে পরোয়াই করেনি দীপিকা। সে নিজের অতীত নিয়ে স্পষ্ট। আমরা ক’জন পারব এটা করতে? কিন্তু আমাদের সবার এরকম লড়াই চলেছে। কেউ প্রকাশ করতে পারিনি।
এদিকে রণবীর যে একজন বুঝদার প্রেমিকের মতো দীপিকার পাশে থেকেছে দীপিকার মানসিক অবসাদের সময়, এই কথাটা কারও মাথায় আসেনি। রণবীর সিং মানসিক অবসাদ কী জানত না, কিন্তু তবুও কীভাবে সে ধীরে ধীরে কেয়ারগিভার হয়ে উঠল, এটা তো আমাদের আলোচনার বিষয় হতে পারত। যা শিক্ষনীয়, তা আমরা চিরকার বর্জন করে এসেছি। রণবীর বলছে যে, বাড়ি ফিরে এসে সে দেখছে ডাইনিংয়ে বসে দীপিকার কাঁদছে। দীপিকা জানেও না যে চোখ দিয়ে জল পড়ছে। কই, এই কথাগুলো তো কেউ নজর করল না।
মেয়েরা একশোবার প্রেমে পড়বে, আজীবন প্রেমে পড়ার অবকাশ যেন থাকে আমাদের সকলের। এই দাবি শুধু মেয়েদের ওপরই করা হয় যে সে একবার প্রেমে পড়বে, এবং একবারই বিয়ে করবে। বা প্রেমও করবে না, সিধে বিয়ে করে নেবে। একটি মেয়ের অধিকার নেই প্রেমে পড়ার। এদিকে ছেলেরা যা খুশি করতে পারে। কয়েক যুগ আগেও পুরুষ একাধিক বিয়ে করার অনুমতি পেত, অনুমতি শুধু নয়, সেটাই ছিল সমাজের ট্রেন্ড। আজ সেই পুরুষরাই মেয়ের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। যতদিন মেয়েদের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন করা হবে, ততদিন দীপিকার মতো সাহসী মেয়েরা তার একাধিক প্রেমের প্রসঙ্গ তুলবে প্রকাশ্যে। যাতে অস্বস্তিতে পড়ে যায় সমাজ।
বেশ করেছে, প্রেম করেছে।