Robbar

বেচারা বি.বি.-র সঙ্গে এক-সন্ধ্যার মোলাকাত

Published by: Robbar Digital
  • Posted:September 11, 2023 5:06 pm
  • Updated:September 11, 2023 7:32 pm  

বি.বি.। আমাদের বের্টোল্ট ব্রেখ্ট‌। বেচারা সে বটে, কিন্তু বেচারা হয়েই সে থাকতে চায় না। অবস্থা সে মানে না কারণ, এ-যাবৎ মনীষীগণ জগৎটার ব্যাখ্যাই করেছেন শুধু, আসল কথা হল সেটাকে বদলানো দরকার। নিজের দশা তো বদলাতে চায় সবাই। কিন্তু মুশকিল এই যে মানুষ মাত্রেই বেচারা। প্রবল প্রতাপ নিয়ে হম্বিতম্বি করে কুরুপতি শেষমেশ মস্তকে লাথি খেয়েছিল। কে যে কখন বেচারা বনে যাবে, কেউ জানে না। তাই বি.বি. চায় মানুষের দশাটাকেই পুরোপুরি বদলে দিতে।

সুমন্ত মুখোপাধ্যায়

বেচারা বি.বি.-কে নিয়ে ঝামেলার একশেষ! কখন কোথায় কী বেশে এসে যে দেখা দিয়ে যাবে লোকটা, কেউ জানে না। আর এমনই বেয়াড়া আর ত্যাঁদড় এই বি.বি.– দেশ-কাল-পাত্র তো কোন ছাড়, সে এমনকী পরিস্থিতি, অবস্থা বা দশাও মানতে চায় না। চোখের পাতা পড়বে না, ডাহা মিথ্যে বলে দেবে! কেননা তাকে বাঁচতে হবে আগে, তার পরে সত্যি-টত্যি। বিরাট পলিটিকাল লেকচার দিয়ে দেবে হালকা মেজাজের আড্ডায়। মানে, বদলে দেবে অবস্থাটাই। তুমি হয়তো গম্ভীর ভারিক্কে সব বিষয়ে বার্তা দিচ্ছ, বি.বি. এসে বিচ্ছিরি হাসিয়ে গেল। আবার খোশমেজাজে হাসছ যখন, এমন প্যান্তাখ্যাঁচা গভীর দুঃখে টান দেবে তোমার অন্তরে, যে, তুমি ভাবতে বসবে তোমার কি এখন হাসার কথা না চটে যাওয়ার? আর রেগেমেগে ঘুসি পাকিয়ে তুমি যেই পড়ে পাওয়া দশাটার দিকে তেড়ে গেছ, অমনি বি.বি. বলে বসবে:
তবু আপনারা খেপে যাবেন না করজোড়ে শুধু মিনতি ভাই
বেঁচে আছে যারা অপরের প্রতি তাদের একটু করুণা চাই।

এই হল বি.বি.। আমাদের বের্টোল্ট ব্রেখ্ট‌। বেচারা সে বটে, কিন্তু বেচারা হয়েই সে থাকতে চায় না। অবস্থা সে মানে না কারণ, এ-যাবৎ মনীষীগণ জগৎটার ব্যাখ্যাই করেছেন শুধু, আসল কথা হল সেটাকে বদলানো দরকার। নিজের দশা তো বদলাতে চায় সবাই। কিন্তু মুশকিল এই যে মানুষ মাত্রেই বেচারা। প্রবল প্রতাপ নিয়ে হম্বিতম্বি করে কুরুপতি শেষমেশ মস্তকে লাথি খেয়েছিল। কে যে কখন বেচারা বনে যাবে, কেউ জানে না। তাই বি.বি. চায় মানুষের দশাটাকেই পুরোপুরি বদলে দিতে। প্রায় ১২৫ বছর পার করে বেচারা বি.বি.-র সঙ্গে আমাদের মোলাকাত হল সেদিন গঙ্গার ধারে ভর সন্ধেবেলায়। কলকাতার গিরিশ মঞ্চে। হল-ভর্তি লোকজনকে একেবারে ঘোল খাইয়ে দিয়ে গেল লোকটা! তারপর, মনে হল বাইরে শাকসবজিউলি-র সঙ্গে খানিক গল্প করে চায়ের দোকানে সেঁধিয়ে গেল।

বেচারা বি.বি.-এর একটি দৃশ্য

২.
দিনকয়েক আগে আমাদের বাংলা থিয়েটারের সর্বজনপ্রিয় অভিনেতা একটু সন্দেহ দাখিল করছিলেন হোয়াটসঅ্যাপে। ব্রেখ্টে‌র ‘তৃতীয় সাম্রাজ্যের দুঃখ দুর্দশা’ পুরোটা অনুবাদ করব ভাবছি, নামাবেন না কি?– এই রকম একটা প্রশ্নের উত্তরে তাঁর একদম চাঁচাছোলা উত্তর এল– ‘মানুষের ঘটে কিন্তু কিচ্ছু ঢুকছে না, কিছুই না। রেগুলার স্টেজে উঠছি তাই জানি, কেউ যদি কমিউনিকেট করতে চায় নতুন ভাষায় বাঁধতে হবে। এতদিন যা দিয়ে হবে বলে ভেবে এসেছি, তাতে আর কাজ হচ্ছে না। এই হল সোজাসাপ্টা কথা।’

সত্যি বলতে থিয়েটার-এর ভাষা– ‘সেমিওটিক্স’ বা ‘চিহ্নবিদ্যা’ নিয়ে বাংলায় এককালে চুল ছেঁড়াছিঁড়ি বড় কম হয়নি। এখনও মোটামুটি সেই চিহ্নেরই অ-আ-ক-খ। তাই কথাটা ভাবার মতন। একে তো থিয়েটার থেকে রাজনীতি প্রায় গায়েব, বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যার যেমন রেস্ত তেমনি দৃশ্যনিচয় জুড়ে জুড়ে একটা আমোদ-আহ্লাদ। সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস দরকারও হচ্ছে না, আর যেখানে হচ্ছে সে রাস্তায় দর্শক হাঁটে না।

কিন্তু প্রশ্ন হল: ঘটে ঢুকছে না বলে জলকে মাল করে তুলব, না ঘটটাকে নিয়েই চিন্তা করব– সেটাকে কী পদ্ধতিতে ভরা যায়? এই ধরনের বিটকেল প্রশ্নের উত্তরে সুমন যা-করার বার বার করে দেখিয়েছেন। কিন্তু এবার যে ব্রেখ্ট‌-কে নিয়ে সামান্য ক’দিনের মহড়ায় স্বপ্ন দেখার একটা আয়োজন করলেন তরুণ-তরুণীদের নিয়ে, তার জন্য একটাই আবেদন, নেড়া-কে আমরা নিত্যি দেখতে চাই আমাদের বেলতলায়। ব্রেখ্ট‌ সহজ। ব্রেখ্ট‌ মানুষের সমস্যাগুলো বেঁচে থাকার ঝঞ্ঝাট নিয়ে কবিতায়-নাটকে-গল্পে ভেবেছেন আর সমাধান করতে চেয়েছেন। ভ্লাদিমির হোলান-এর একটা বড় সুন্দর লাইন আছে, ‘একমাত্র তখনই সারল্য আমরা বুঝতে পারি কেবল যখন, আমাদের বুক ফেটে যায়।’ বুক ফাটে তবু মুখ ফোটে না– এই হল মানুষের দশা। বেসরকারি হাসপাতালে দেউলিয়া সন্তান, মুরগির ছাল আর নখের বাজারু, ঝুলে পড়া চাষি অথবা গুরগাও-এর ভাঙা দোকান, সর্বত্রই বুক ফাটছে। ব্রেখ্ট‌ বুঝবে না এরা? বুঝবে না শেন-তেহর কথা: কী ভাবে ভাল হবে বলো তো মানুষ যখন জিনিসপত্রর দাম খালি বেড়েই চলে? প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তর যারা জানে, তারা সময়মতো নীরব।

৩.
‘চেতনা’, ‘কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটি’ আর ‘শ্যামবাজার তৃতীয় সূত্র নাট্যদল’-কে নিয়ে ক’দিনের ওয়ার্কশপের ভিত্তি-তে বের্টোল্ট ব্রেখটের পুনরাবির্ভাবের যে উপস্থাপনা সুমন করলেন, তা শুধু ১২৫ তম বর্ষ উদ্‌যাপন বলে ভাবতে পারছি না। এর একটা লাগাতার প্রয়োজন আছে। গত শতকে ব্রেখ্ট‌ যখন কাজ করছিলেন, সে-সময়টা মানুষের, মানে তামাম দুনিয়া যাদের ‘মানুষ’ বলে জানে, সেই সাদা ইউরোপিয়ান আর আমেরিকান-দের হাঁড়ির হাল হয়েছিল। দু’-দুটো যুদ্ধে ধ্যানধারণাগুলো তেবড়ে-তুবড়ে তাল পাকিয়ে গেছিল, সেখান থেকেই উঠে এল বেচারা বি.বি.-র নাটক আর কবিতার ভাষা। সাধারণ গরিব মধ্যবিত্ত লোকজন বুঝতেই পারছিল না বাঁচার রাস্তা কোনদিকে? এখনও যে অবস্থা খুব বদলেছে, তা নয়, তবে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধটা ঠেকানো গেছে। ইলেকট্রিক বিল বা পাউরুটির দাম দশগুণ দিয়ে ইউরোপের বাকি অংশের লোকজন রাশিয়া-ইউক্রেন না দেখেও চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের মতো দেশে যেখানে নয়া সাম্রাজ্যবাদ দিব্যি ঘাঁটি গেড়ে বসে, সেখানে যতই জনমোহিনী বক্তৃতা চলুক, চারদিকে মানুষ পোকামাকড়ের মতো মরছিল, মরছে, মরবে এবং মরতেই থাকবে। তাই এ চত্বরেই বি.বি.-কে দেখতে পাওয়ার কথা। একদল নতুন ছেলেমেয়ের ভিড়ে আমরা হের কয়নার-এর কাছে তাই শুনে নিলাম কীভাবে ‘না’ বলতে হয়। অনিবার্যত মনে পড়ে গেল ভাস্কর চক্রবর্তীর অমোঘ লাইন, ‘প্রথমে হ্যাঁ লিখি একটা। তারপর তাকে কেটে দিই।/ কেটে দিয়ে না লিখি। না’। সুমনের বি.বি., আমাদের ‘না’-এর জোর বুঝিয়ে দিয়ে গেল।

৪.
অভিনেতাদের কিন্তু জানতে হবে তারা কী করছে। কেন করছে। মারি ফারার ছেলে বিয়োয় একা। সেটা কেউ বের করে দেয়নি। অভিনেতারা আলোর সামনে নিচে নিজেদের অভিনয় করা চরিত্রটাকে কেমন করে হতশ্রী হাঘরে দেখাবেন, সেটা ভেবে বের করা চাই। শরীর দিয়ে সময়কে ধরতে গেলে নিজের সময়কে স্নায়ুতে বইতে দেওয়া বড় দরকার। নাচ-গান-নাটক দিয়ে বি.বি. জমিয়ে দিতেন ঠিকই কিন্তু ওই মাপটা একটু টস্‌কে গেলেই মুশকিল। পাবলিক যে কোনও জিনিস দেখলেই হাসে, হাসতে চায়। আডর্নো যে একই সঙ্গে গ্রেট ডিক্টেটর আর আর্তো রো উই নিয়ে বলেছিলেন, মজা করতে গিয়ে আমরা ভুলে যাচ্ছি না তো যে হিটলারের উত্থান কোনও হাস্যকর ব্যাপার ছিল না যে, চাইলেই আটকানো যাবে। তাই যদি হত, তাহলে ওদেশে ট্রাম্প-পুতিনের দলবল আর এদেশে রেডিও নেতার এই রবরবা হত না।

তৃতীয় সাম্রাজ্যের দুর্দশার উপস্থাপনায় দাঙ্গা জিনিসটা আরও ভয়াবহ হতে পারত নৈঃশব্দ্যের ভেতর। বাইরে মানুষের চিৎকার না-ই বা শোনা গেল। গালিলেওর অভিনয় আর স্পেস-এর ব্যবহার বহুদিন মনে থাকবে। এই যে কথাগুলো বলছি, এ কোনও ‘সমালোচনা’ নয়। এ হল রিহার্সাল-এ শামিল হওয়া। নিজেকে নাট্যশরীরের অংশ মনে করা। যে-শরীর শ্রমার্ত-কে আশ্রয় দেয়, দুঃখার্তকে স্থান দেয়। এ নাটক বি.বি.-কে খুঁজে নেওয়ার রিহার্সাল। সব সময় নির্মীয়মাণ। অগুস্ত বোয়াল আজ থেকে ঠিক ৫০ বছর আগে বলেছিলেন বুর্জোয়ারা জানে তাদের জগৎ কেমন, কেমন জগৎ তারা চায়। সেইমতো তারা সম্পূর্ণ দৃশ্য তৈরি করে। হা-ঘরেদের কোনও জগৎ নেই যেটা সম্পূর্ণ, তারা জানেও না সেই জগতের চেহারা কেমন হবে। তাই তারা শুধু রিহার্সাল দেয়। শেষ করা ছবি টাঙায় না।

সুমন মুখোপাধ্যায় আর তাঁর দলবলের মহড়া চলতে থাকুক। বি. বি. বেচারা আমাদের সঙ্গে ভাঙা হাতল চায়ের কাপ নিয়ে রাজুদার দোকানে বসে পড়ুক। সময়টা ভাল না।