‘এজেন্ট বিনোদ’, ‘বদলাপুর’, ‘অন্ধাধুন’ — এসবের স্ক্রিপ্ট, অরিজিৎ বিশ্বাসের। সামনেই মুক্তি পাবে তাঁর লেখা পরবর্তী সিনেমা, ‘মেরি ক্রিসমাস’। মুখ্য ভূমিকায়, বিজয় সেতুপতি আর ক্যাটরিনা কাইফ। কর্ণাটক ও তামিলনাড়ুর সীমান্তে, আত্তিবেলের নিরালা বাড়িতে, লেখকের সঙ্গে মুখোমুখি আড্ডায়, উদয়ন ঘোষচৌধুরি। রোববার.ইন এক্সক্লুসিভ।
অরিজিৎদা, শুরু থেকেই শুরুটা করি। বাঙালি দুটো কবিতা লিখে তিনটে বই ছাপাবে– এসব জানা কথা। আপনার মাথায় স্ক্রিপ্ট লেখার পোকা কামড়াল কীভাবে?
একটা কথা প্রথমেই বলি। আমি কিন্তু মোটেও খুব সিনেমা-বোদ্ধা নই। ধরো, কেউ রসগোল্লা খেতে ভালোবাসে। সে একদিন ভাবল, ওটা বানিয়ে খাই। মানে, কনজিউমার যদি উল্টোদিকে যেতে চায়– সেটাই হয়েছে, কিছু না বুঝে রান্নাঘরে ঢুকে পড়েছি…
মিড-সেভেন্টিজে যখন বড় হচ্ছি, তখন অনেক ইন্টারেস্টিং হলিউডের ছবি আসত কলকাতায়। আর, কোনও কারণে, মধ্যবিত্ত বাঙালিরা হিন্দি ছবি থেকে একটু দূরে থাকত। বাবা-মা ইংরেজি অ্যাকশন ছবি দেখাতে নিয়ে যেত। সেগুলো দেখে খুব ভাল লাগত। কিচ্ছু জানতাম না, যুদ্ধে বা শিকারে কী কী হয়। ক্লাস টু-থ্রিতে পড়ি। তখন দুটো জিনিস হল। এক, সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারের অনেক ছবি দেখে, মিলিটারি হিস্ট্রিতে সিরিয়াসলি আগ্রহী হয়ে পড়লাম। সেই আগ্রহটা এখনও আছে। স্পেশালি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বই জোগাড় করি, পড়ি। দুই, হলিউডের অ্যাকশন ফিল্মগুলো আমাকে আকর্ষণ করল।
বলতে পারো, তখনই একটা ছোটো পোকা কামড়েছিল। বাড়িতে ফিরে, নিজেই কিছু অ্যাকশনের গল্প লেখার চেষ্টা করতাম। কোনও কোনও সিনেমা দেখে আশ মিটত না। মনে হত, আরেকটু যুদ্ধ, আরেকটু অ্যাকশন হলে ভালো হত! সেগুলো নিজের মতো করে, নিজের জন্যই লিখতাম। ‘কুয়ো ভাদিস’ বা ‘অ্যাটিলা দ্য হূন’ দেখে, রোমের ইতিহাস, অ্যাটিলা আর হূন আক্রমণ পড়লাম। দেখলাম, হূনরা একই সময়ে ভারতেও আক্রমণ করেছিল। ভাবলাম, বাঃ! রোমেও যুদ্ধ হবে, ভারতেও যুদ্ধ হবে– এরকম দুর্দান্ত ব্যাপার তো সহজে পাওয়া যায় না! মনে হল, সিনেমাটায় কম অ্যাকশন দেখিয়েছে, আমি ওদের দুই জেনারেশন আগে থেকে শুরু করব, অনেক যুদ্ধ হবে– কী মজা!
তখন ‘আত্মরতি’ শব্দটা জানতাম না। আসলে, ওইসব ছিল আত্মরতি। আশা করতাম না, ওগুলো কেউ পড়বে। অবশ্য, সেই ক্লাস ফাইভে তো বঙ্কিমচন্দ্র পড়িনি– সেখানে লেখা ছিল, যাহা লিখিবেন নিজের জন্য লিখিবেন…
সিরিয়াসলি স্ক্রিপ্ট লেখার দিকে কীভাবে এগোলেন?
লিখতে লিখতে গল্পগুলোর মান ভাল হচ্ছিল। একটা সময় দেখলাম, কেউ কেউ বলছে, ভাল লিখেছিস। স্কুল-কলেজে বন্ধুরা মিলে নাটকের দল করেছিলাম। ওখান থেকেই আস্তে আস্তে স্ক্রিপ্ট লেখার সূত্রপাত।
নাটকের দলটার নাম কী?
ক.থি.ক.– কলকাতা থিয়েটার কল্লোল। আমরা সবাই চাকরিতে ঢুকেও কিছুদিন সেটা চালিয়েছিলাম। এখন আবার রিভাইভ করেছে আমার বন্ধুরা, অন্য একটা নামে…
আচ্ছা, আগের প্রশ্নে ফিরি…
হ্যাঁ, ’৯৫-’৯৬ নাগাদ, কাজের চাপে, জীবনের চাপে দলটা আর চলছিল না। ওই সময়, আমাদের দলের এক ঝাঁক অ্যাক্টর টিভিতে কাজ করতে শুরু করল। ততদিনে আমার লেখা-লেখা খেলাও বেশ একটা জায়গায় পৌঁছেছে। গল্প লেখায় থ্রি-অ্যাক্ট স্ট্রাকচার আয়ত্ত করেছি। স্কুলে-কলেজে থাকতেই হেডলি চেজ, সিডনি শেলডন, হ্যারল্ড রবিন্স, জ্যাক হিগিন্স– এসব পড়ে ফেলেছি। তখন পড়ছি লরেন্স ব্লক, রেমন্ড শ্যান্ডলার, প্যাট্রিশিয়া হিগস্মিথ… মানে, সব থ্রিলার, নয়ার…
একদিন সুরজ মুখার্জি (এখন বম্বেতে বিখ্যাত ভয়েস আর্টিস্ট) বলল, তুমি গল্প নিয়ে মল্লিকা জালানের (শ্যামানন্দ জালানের মেয়ে) সঙ্গে দেখা করো। আমি দেখা করলাম। এদিকে, তখন আমার বাজেট-ফাজেট নিয়ে কোনও ধারণা নেই। অথচ, গল্পগুলো লিখেছি বিরাট স্কেলে– মানে, প্লেন-ফেন উড়ে যাচ্ছে টাইপ…
এরা সেগুলো পড়ে খুব এক্সাইটেড হল। বলল, এটা তো বাংলা টিভির বাজেটে হবে না, বম্বে যেতে হবে। বম্বেতেও লোকজন পড়ে উৎসাহিত, তখন এই ‘সিরিজ’ টার্মটা আসেনি– তবে, ওরা যেটা বানাবে ঠিক করল, সেটা সিরিজই। প্রথমে স্টার প্লাসে কথা হয়েছিল। ওখানে ছিল ঈশান ত্রিবেদী। ঈশান স্টার থেকে জি-তে গেল, এই প্রোজেক্টটা সঙ্গে নিয়ে গেল। আগে নাম ছিল, ‘স্বর্ণভুজ’। পরে নাম দিল ‘তারকাশ’। অভিনয় করল পঙ্কজ কাপুর, বেঞ্জামিন গিলানি, নাসিরউদ্দিন শাহ– ওই সিরিজের পাঁচটা গল্পের মধ্যে তিনটে আমার লেখা…
শ্রীরাম রাঘবনের সঙ্গে তো ওখানেই পরিচয়, না?
হ্যাঁ, টিভিতে কাজ করার সময়েই শ্রীরামের সঙ্গে দেখা হল। শ্রীরাম আর আমার সম্পর্কটা ম্যাজিকের মতো– আলাপের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দু’জনে দু’জনের অনেক মিল খুঁজে পেলাম। শ্রীরাম তখন টিভি থেকে ফিল্মের দিকে যেতে চাইছে। আমার যদিও সিনেমার কোনও ট্রেনিং ছিল না, তবে একটা রাস্তা তৈরি হল। তখনও কিন্তু ফিল্ম নিয়ে খুব সিরিয়াস ছিলাম না। চাকরির চাপ ছিল, টিভিতে অনেকগুলো কাজ চলছিল– ‘তারকাশ’-এর পাশাপাশি ‘রূপকথা’, আরও কিছু– বাংলা ছবি করার কথাও ভাবছিলাম।
মাঝে, চাকরির কাজে বম্বেতে কিছুদিন ছিলাম। তখন শ্রীরাম লিখছিল ‘দয়া’ (পরে যেটার নাম হল ‘অব তক ছাপ্পান’)– ওটা আমিও একসঙ্গে লিখেছি। কিন্তু, রাম গোপাল বর্মা একটু খামখেয়ালি, হঠাৎ একদিন শ্রীরামকে বলল, ‘তুমি নতুন একটা গল্পে কাজ করো, আগেরটা শিমিতকে (আমিন) করতে দাও।’ কেন এরকম বলল আমার ধারণা নেই। শিমিতের স্ক্রিপ্টটা আলাদা হলেও, ‘দয়া’-র অনেক এলিমেন্ট চেহারা পালটে ওটাতে আছে… তো, শ্রীরাম আমাকে বলল, “তুই নতুন গল্পটায় (‘এক হাসিনা থি’) কাজ করবি?” ততদিনে বম্বেতে আমার চাকরির প্রোজেক্টটা শেষের দিকে, ওখানে আর থাকব না, তাই ‘না’ বলে দিলাম।
মানে, ওইসময় সিনেমা বা স্ক্রিপ্ট থেকে পজ নিলেন?
ঠিক পজ নয়। এখন বুঝি, ওটা ছিল একটা প্রস্তুতি পর্ব। চাকরির ফাঁকে ফাঁকে তখন প্রচুর সিনেমা দেখেছি। কোনওটাই আর্টহাউজ নয়। ওগুলো একেবারে দেখিনি, তা কিন্তু নয়। আমার আসলে বরাবর ফোকাস ছিল থ্রিলার, নয়ার, বি-মুভিজ… বলতে পারো, অবভিয়াস বায়াস আছে এগুলোর ওপর। তখন আমি ডাউনলোড করে করে কমপক্ষে ৫০০টা স্ক্রিপ্ট পড়েছি, সব হলিউডের, বিখ্যাত সিনেমার স্ক্রিপ্ট।
ওই পড়াশোনা আমার খুব কাজে লেগেছে–বিশেষ করে, থ্রি-অ্যাক্ট স্ট্রাকচারটা মনের ভেতরে গেঁথে গেছে। ইউরোপিয়ান রাইটিং আর হলিউডের তফাত বুঝতে পেরেছি। বুঝতে পেরেছি, সত্যজিৎ রায় কেন বলতেন, আমরা স্ক্রিপ্টরাইটিং শিখেছি হলিউডের কাছ থেকে।
শ্রীরাম আর আপনার মিলটা কোথায়?
উই বোথ টক অফ ভেরি ভায়োলেন্ট স্টোরিজ। ভায়োলেন্স কাকে বলে? একটা রিভলভার সবথেকে পাওয়ারফুল থাকে কখন? যখন সে একটা গুলিও ছোড়েনি। যে মুহূর্তে ছ’টা গুলি বেরিয়ে গেল, সেটা জাস্ট একটা ফার্নিচার হয়ে গেল। আমরা দু’জনেই সেরকম গল্প বলতে চাই, যেখানে দ্য গান ইজ ফুললি লোডেড– এই থ্রেট, এই পোটেন্সি অফ ভায়োলেন্স– এত লোক গুন্ডাদের হপ্তা দেয় কেন? হয়তো একটা খুন হয়, একটা বাড়ি ভাঙা হয়– বাকি লোকগুলো ওই ভয়ে দেয়। আমি পার্সোনালি মনে করি, আমাদের চারপাশে পাপ আছে। পৃথিবীতে পাপমুক্ত কেউই নয়। এটাই নয়ার, খানিকটা গ্রিক ট্র্যাজেডির মতো– তুমি দুনিয়ার সঙ্গে কতদূর সংগ্রাম করতে পারবে, ভেঙে পড়ার আগে? আর, সবসময়েই সংগ্রামে জিতবে, তা তো নয়, কিন্তু, এই সংগ্রাম করার মধ্য দিয়ে বুঝতে পারবে, তুমি পাপ-পুণ্যে মেশানো একজন ‘মানুষ’। এই ট্র্যাজেডিটাই নয়ার, এটা আমাদের খুব ভাল লাগে।
শ্রীরামের সঙ্গে আবার কীভাবে যোগাযোগ হল?
আমি একটা বাংলা ছবি করলাম ২০০৭-এ, ‘কাঞ্চনবাবু’। তখন আমার কোনও ধারণা ছিল না পোস্ট-প্রোডাকশনে কী বীভৎস ঝামেলা! কত টাকা লাগে, কতদিন লাগে– ফিল্মের জন্য যা টাকা জোগাড় হয়েছিল, সেটা শুটেই প্রায় শেষ হয়ে যায়। ছবিটা এখনও আছে, কিন্তু মনে হয় না, ওটা আর কিছু হবে। পরাণদা’ (বন্দ্যোপাধ্যায়) অসাধারণ অ্যাক্টিং করেছিলেন। সেটা ভাবলে খুব গিলটি লাগে।
ওই সময়ে, অফিসের কাজে আবার বম্বেতে থাকছি। কয়েক মাস পর, হঠাৎ মনে হল, শ্রীরামটা কী করছে একটু দেখি! গেলাম ওর বাড়িতে। ব্যাটা আমাকে দেখে মহা খুশি। ওর হাতে তখন ‘এজেন্ট বিনোদ’। গল্পটা একেবারে ফ্লুইড স্টেটে রয়েছে, আমাকে বলল, ‘তুই করবি?’ বললাম, ‘হ্যাঁ, আমি তো বসেই আছি।’ সেখান থেকে আবার একসঙ্গে কাজ করা শুরু হল।
একটা কথা স্বীকার করতে একটু অপরাধ বোধ হয়। আমাকে আসলে সেরকম স্ট্রাগল কখনও করতে হয়নি। বড়সড় না হলেও মোটামুটি মাঝারি ধরনের দরজা খুলে গেছে সহজেই।
আপনাদের লেখার প্রসেসটা কীরকম?
শ্রীরামের সঙ্গে কাজ করে যেটা ভাল হয়েছে, নিজেদের লেখা নিয়ে উই বোথ আর ভেরি রুথলেস। যে কোনও সময় যা যা কাজ হয়েছে, সেগুলো ফেলে দিয়ে নতুন করে শুরু করতে আমাদের আটকায় না। আমরা একটা টার্ম বানিয়েছি, ‘শুবক্স’। মানে, আমরা আলোচনা করি, এই সিনটা বেশ, ওই জায়গাটা দারুণ, এটা হতে পারে, ওটাও হতে পারে… এর কোনও নিয়মকানুন নেই– যা যা আইডিয়া আসে, সেগুলো লিখে রাখি। কখনও একটা নোট, কখনও পুরো সিন উইথ ডায়লগ, যদিও শেষমেশ সেগুলো এমন পর্বতপ্রমাণ হয়ে যায়, পরে আর কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় না। ব্যাপারটা অনেকটা মালা গাঁথা হয়নি, কিন্তু নানারকমের ফুল জোগাড় হয়েছে। এবার, একটা সময়ে, আমরা বলটা ঠেলতে আরম্ভ করি। সেই কাজটা মেইনলি আমিই করি।
এবার, মালা গাঁথতে বসে দেখা যায় সব ফুল নেওয়া যাবে না। হয়তো চমৎকার একটা সিন আছে, কিন্তু কাজে লাগবে না। কারণ, গল্পটা অন্যদিকে যাবে। তারপর, কয়েকটা সিন লিখে শ্রীরামকে পাঠাই, ও মতামত দেয়। যদিও, কোনওটাই ফাইনাল নয় তখনও। তবে, একটা অবয়ব আস্তে আস্তে ধোঁয়া থেকে বেরতে শুরু করে। সত্যি বলতে, ওই অবয়ব বেরনোর সময়টাই আমাদের কাছে সবথেকে আনন্দের।
তারপর, বম্বেতে আমরা দেখা করি প্রায় অল্টারনেট ডে… রাত্তিরবেলা একসঙ্গে বসি, চর্চা-টর্চা হয়… তাতে কোনও তাগাদা থাকে না। কারণ, আমরা টাইমলাইনে কাজ করি না। আমরা কোনও অ্যাডভান্স নিই না। অ্যাডভান্স নিলেই একটা স্টেক হয়ে যায়। তবে, হ্যাঁ, প্রফেশনাল রাইটারদের অ্যাডভান্সটা দরকার। আমরা কাজ করি মূলত আনন্দের জায়গা থেকে।
অন্যান্য লেখার সঙ্গে স্ক্রিপ্ট লেখার তুলনা করা যায়?
না, এটা একেবারে ডিফারেন্ট একটা ক্রাফট। এর মধ্যে কোনও অটিওরশিপ নেই। আমার স্ক্রিপ্ট যে আমারই গল্প হতে হবে, এর কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। যদি একটা নয়ার পড়ে সাংঘাতিক লাগে, সেটার রাইটস পেলে, আই ক্যান ওয়ার্ক অন দ্য স্ক্রিপ্ট– বাংলাতে দেখো, আজ পর্যন্ত যতগুলো ভাল ছবি হয়েছে, বেশিরভাগ অন্য কারও সাহিত্য থেকে নেওয়া।
কিন্তু, এখনকার বাংলা ছবিতে সেই ব্যাপারটা…
হ্যাঁ, এখন বাংলায় প্রায় সকলে অটিওরশিপের দায় নিয়ে ফেলেছে। যে ডিরেক্টর, সে-ই গল্প-প্রণেতা, সে-ই স্ক্রিপ্ট-প্রণেতা– কী বলব! হলিউডের যেসব নামকরা ডিরেক্টর, তাঁদের মধ্যেও এত প্রতিভা নেই।
আচ্ছা, লিখতে লিখতে আটকে যান কোথাও?
হ্যাঁ, আটকে যাই। আমাদের আটকানোটা নানাভাবে হয়। কী হয়, প্রত্যেকটা সিনে একটা করে কনফ্লিক্ট লাগে। ওটা না থাকলে, স্টোরি এগোবে না। বেসিক কনফ্লিক্ট আর ভিজুয়াল। এই কনফ্লিক্টটা তৈরি করতে হয়, নইলে সিনটা ইনফর্মেটিভ হয়ে যায়। স্ক্রিপ্টে কোনও ইনফর্মেশনও ভিজুয়ালি দিতে হয়। ধরো, ‘আমার বেড়াল ভালো লাগে’ বলার থেকে দেখলে প্রোটাগনিস্ট রাস্তায় একটা বেড়ালকে আদর করছে…
এই ব্যাপারটায় অনেক ক্রাফট থাকে। যেমন, একটা সিনেমায় ছিল মেরি কুইন অফ স্কট– রাজকন্যে, কিন্তু ছোটবেলায় বন্দি। এটা কম বাজেটে দেখাবে কীভাবে? প্রোডাকশন খালি একটা পুরনো কেল্লা, কিছু কস্টিউম জোগাড় করেছে। একটা ঘোড়াও নেই। বন্দি, অথচ রাজকন্যে– কীভাবে বোঝাবে? মুখে বলাই যায়, কিন্তু সেটা কি ভালো স্ক্রিপ্ট? ওরা দেখাল, মেরির মা বাচ্চা মেয়ের মাথায় চার-পাঁচটা বই চাপিয়ে হাঁটা প্র্যাকটিস করাচ্ছে, যাতে মুকুট পরে রাজকন্যে অনায়াসে হাঁটতে পারে। কী অসাধারণ চিন্তা! কী ট্র্যাজিক! রানি কখনও হবে কি না, কে জানে! কিন্তু, যেটুকু সম্বল, তাতেই রানির হাঁটা প্র্যাকটিস করাচ্ছে! সিনেমাটা দেখার সময় একবারও মনে হবে না, বাজেট নেই! বরং ভাববে, তাই তো! বন্দি থাকলেও রাজকন্যেকে কত কী শিখতে হয়!
এগুলোকে আমরা বলি ‘ডিভাইস’। এক-একটা ভালো ‘ডিভাইস’ স্ক্রিপ্টকে দ্রুতগতিতে টেনে নিয়ে যায়।
আমাদের নেক্সট ছবি, ‘ইক্কিশ’-এর শুটিং শুরু হয়েছে। ওখানে দু’-মিনিটের একটা সিন দরকার, যেখানে চরিত্রের একটা উত্তরণ হবে। ওই সিনটা লিখতে গিয়ে আটকে গেছিলাম। তারপর, শেষমেশ যেটা হয়েছে, আমরা প্রত্যেকে খুব খুশি। ওটা ডায়লগ দিয়েই হয়েছে। ডায়লগ মানে বড় বড় ভাষণ নয়, মানুষ খুব সাধারণভাবেও কথা বলতে পারে। কারণ, আমাদের চরিত্রগুলো সাধারণ। কিন্তু, দেখার পর দর্শক যেন অনুধাবন করে, কিছু একটা হল।
তো, ওই যে মালা গাঁথা– অনেক সময় গাঁথার পরেও দেখা যায় ফাঁক আছে, তখন আবার ভাবতে হয়। আসলে, এই প্রসেসটা খুব ইন্টারেস্টিং।
স্ক্রিপ্ট আর নভেল বা গল্পের তফাত কী মনে হয়?
আই লাভ দ্য ক্রাফট অফ স্ক্রিপ্টরাইটিং। কিন্তু, দিনের শেষে, কী জানো তো, একটা নভেলের, একটা রিটেন পিসের স্কোপ অনেক বড়। ওখানে একটা চরিত্রকে যত গভীরভাবে দেখানো যেতে পারে, স্ক্রিপ্টে সেটা মুশকিল। একজন স্ক্রিপ্টরাইটারের মূল দায়িত্ব ওই জায়গাটা ভিজুয়ালি আনতে চেষ্টা করা। যা যা লেখা আছে নভেলে, সেগুলোই তুলে নিলে, ব্যাঙ হবে! আমাকে ভাবতে হবে, ওগুলো পর্দায় কীভাবে দেখাতে পারব। ধরো, ‘বদলাপুর’– ওটার গল্পটা আমি লিখতেই পারতাম না। আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ওই মূল নভেল ‘‘ডেথ’স ডার্ক অ্যাবিস’’-এর লেখক মাসিমো কার্লোটো, উনি জেলে থেকেছেন, জায়গাটা দেখেছেন– হয়তো ওরকম চরিত্র বা ঘটনা দেখেছেন… ও জিনিস আমার মাথা থেকে বেরতই না!
এবার, তার মানে কি নভেলটা বেটার? স্ক্রিপ্টটা খারাপ হয়েছে? না, একদমই না! দুটো, দুটোর জায়গায় আছে। আমার সত্যিই মনে হয় না, কোনও স্ক্রিপ্টরাইটার ওই গল্পটা লিখতে পারবে। পারলে তো ভাল, কিন্তু একটা নভেল যেরকম ডিপ ডাইভ করতে পারে, স্ক্রিপ্ট সেটা পারে না। আসলে, নভেলের ফরম্যাটটা ওই ডিপ ডাইভটা করতে অ্যালাউ করে, এনকারেজ করে।
আবার, কিছু ক্লাসিক স্ক্রিপ্ট আছে, যেমন ‘ব্রিজ অন দ্য রিভার কোয়াই’ বা, ‘লরেন্স অফ অ্যারাবিয়া’– এগুলো নিজেই এক-একটা এপিক– প্রায় নভেলের রেঞ্জে ক্যারেক্টার স্টাডি করতে পারে।
আপনাদের মাথায় আর কোন কোন নভেল আছে?
আছে, অনেকগুলো আছে। আনফরচুনেটলি, অনেকগুলোই বিদেশি নয়ার। দেশেরও কিছু কিছু আছে। দেশের একটা গল্প নিয়ে আমি কাজ করছি। দেখা যাক, কী করতে পারি ওটা…
(পরের পর্বে সমাপ্ত)
গ্রাফিক্স: অর্ঘ্য চৌধুরী
এ দেশে প্রসূতিসদন থেকে নবজাত শিশু ও প্রসূতিকে ছেড়ে দেওয়ার পরও স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে বেশ কয়েক মাস ধরে নিয়মিত একজন চিকিৎসক বাড়িতে এসে তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে যান। এটা ছিল এখানকার জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার একটি অপরিহার্য অঙ্গ।