১৯৩৬ সালে তৈরি হওয়া ‘বম্বে টকিজ’-এর হিট সিনেমা ‘অচ্ছুত কন্যা’ থেকে ২০২৩-এ মুক্তি পাওয়া ‘ভিড়’-এর মধ্যে ব্যবধান প্রায় ৯০ বছরের। এই ৯০ বছরে কতটা বদলেছে বলিউড?
জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমা এবং ওয়েব সিরিজে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের চিত্রায়ণ এবং তার গুরুত্ব খতিয়ে দেখতে গেলে, বর্ণবৈষম্যের দীর্ঘ ইতিহাস চোখে পড়ে। শ্রেণি বিভাজনের বৈষম্যের প্রতিচ্ছবি ধরা পড়ে আমাদের সিনেমাতেও। ১৯৩৬ সালে তৈরি হওয়া ‘বম্বে টকিজ’-এর হিট সিনেমা ‘অচ্ছুত কন্যা’ থেকে ২০২৩-এ মুক্তি পাওয়া ‘ভিড়’-এর মধ্যে ব্যবধান প্রায় ৯০ বছরের। এই ৯০ বছরে কতটা বদলেছে বলিউড? সাম্প্রতিককালের কিছু ছবিতে তফাতটা স্পষ্ট। ইদানীংকালের মূলধারার বিষয়বস্তুতে দলিত চরিত্ররা দুর্বল কিংবা পার্শ্বচরিত্রে আর সীমাবদ্ধ নয়। তাদের আর পদবি লুকিয়ে রাখতে হয় না। ‘দাহাড়’-এর ‘অঞ্জলি ভাঁটি’, ‘কাঁঠাল’-এর ‘মহিমা বসোর’, ‘ভিড়’-এর সূর্য কুমার টিক্স, জোর গলায় তাদের দলিত পরিচিতির কথা বলে।
কিন্তু গোড়ার দিকে বলিউডে ‘পদবি’র পদযাত্রা বড্ড একপেশে। ‘অচ্ছুত কন্যা’ (১৯৩৬), ‘সুজাতা’ (১৯৫৯), ‘সদগতি’ (১৯৮১), ‘চামেলি কি শাদি’ (১৯৮৬) বা অন্যান্য দলিত ইস্যুভিত্তিক ছবিতে নিম্নবর্গের পরিসর থেকে উঠে আসা চরিত্র মানেই অসহায়, পরিস্থিতির শিকার, উচ্চবর্ণের মুখাপেক্ষী। জীবনযুদ্ধে যদিও কখনও বা তারা জয়ের মুখ দ্যাখে, তাহলে সেই জয় আসবে উচ্চবর্ণের নায়ক চরিত্রের হাত ধরেই। উদ্ধারকর্তা হিসেবে উচ্চবর্ণের চরিত্রকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এবং এই চিত্রায়ণ ২০১৯-এর ছবি ‘আর্টিকল ফিফটিন’-এও। চিরটাকাল আমরা দেখে এসেছি নিম্নবর্গের চরিত্র মানেই সে ভৃত্য, মদ্যপ, প্রতিবন্ধী, দরিদ্র, নির্যাতিত। অর্থাৎ শ্রেণি অনুযায়ী চরিত্রের পেশা, অভ্যেস, অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা, সমাজিক অবস্থান, চেহারা, গায়ের রং ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। একদিকে দলিতের নিপীড়নকে নাটকীয়ভাবে দেখানো হচ্ছে, অন্যদিকে সহৃদয় উচ্চবর্ণ চরিত্রদের জয়জয়কার করা হয়েছে ‘চেঞ্জমেকার’, ‘নৈতিক’, ‘উচ্চপদস্থ’-র তকমা দিয়ে। যেমন ‘গঙ্গা যমুনা’ (১৯৬১), ‘সুজাতা’ (১৯৫৯), ‘দামুল’ (১৯৮৬), ‘অঙ্কুর’ (১৯৭৪), ‘আক্রোশ’ (১৯৮১), পিপলি লাইভ’ (২০১০), ‘লগান’ (২০০১), ‘স্বদেশ’ (২০০৪), ‘আর্টিকাল ফিফটিন’ (২০১৯)। আরও একটি লক্ষ্মণীয় বিষয় হল, দলিত পদবি অস্পষ্ট রাখার সচেতন প্রয়াস। ‘সিংহম রিটার্নস’ ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘বাজিরাও সিংহম’, ‘কিক’ ছবিতে ভিলেন ‘শিব গজরা’ (নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকি), ‘ওয়েলকাম ব্যাক’-এ লোকাল গুণ্ডা ‘অজ্জু’ (জন আব্রাহাম), ‘নিউটন’ (২০১৭)-এ নিউটন কুমার (রাজকুমার রাও) কোন সম্প্রদায়ের বোঝা যায় না। যদিও ‘নিউটন’-এ সূক্ষ্ম ইঙ্গিত আছে দলিত পরিচিতির।
ইদানীংকালে গান্ধীর হরিজন ভাবমূর্তি, এবং স্টিরিওটিপিকাল দলিত চিত্রায়ণের চেনা ছক ভেঙে তৈরি হয়েছে ২০০০ সালের পরবর্তী কিছু ছবি। ‘মাসান’ (২০১৫)-এর দীপক কুমার (ভিকি কৌশল) দরিদ্র এবং দলিত সম্প্রদায়ের হলেও তার ক্রাইসিস, যাপন দেখানো হয়েছে একজন দলিতের দৃষ্টিকোণ থেকেই। তার জীবনের সংকট সে নিজেই কাটিয়ে উঠছে, উচ্চবর্ণের সাহায্য ছাড়াই।
‘দাহাড়’-এর অঞ্জলি ভাঁটি (সোনাক্ষী সিনহা) নিজের পদবি নিয়ে লুকোছাপা করে না। পুরুষ শাসিত পেশায় এবং নিজের জীবনযাত্রায় এই দলিত নারী সাহসী, স্বাধীন, শিক্ষিত এবং নিজের দাবিতে সোচ্চার। এমনকী, যৌন চাহিদার ব্যাপারেও ‘অঞ্জলি’ সরব। এমন এক চরিত্র, যা স্টিরিওটাইপ দলিত চিত্রায়ণের হেজিমনিকে ভেঙে চুরমার করে দেয়। ‘কাঁঠাল’-এর মহিমা বসোর (সানিয়া মালহোত্রা), ‘অঞ্জলি’র মতো সরব না হলেও এই ছবির প্রাণভোমরা সে-ই। একজন বুদ্ধিদীপ্ত, শিক্ষিত এবং দক্ষ পুলিশ অফিসার। প্রতিবাদী স্বর তার মধ্যে না থাকলেও সে জানে উচ্চবর্ণের সামনে উচ্চকিত না হয়েও ম্যাচ জেতা যায়। ‘ভিড়’ (২০২৩)-এর সূর্য কুমার (রাজকুমার রাও) কর্মক্ষেত্রে সুবিধার্থে প্রথম ‘সিং’ পদবি ব্যবহার করলেও পরে তার আসল পদবি ‘টিক্স’ ফিরিয়ে আনে। একজন সৎ, শিক্ষিত পুলিশ অফিসার হওয়া সত্ত্বেও দলিত পরিচিতির কারণে সূর্য তার নিপীড়নের ইতিহাস বয়ে বেড়ায়। উল্লেখ করা দরকার, এর আগে হিন্দি ছবিতে পুলিশের চরিত্রে সাধারণত দেখা যেত ক্ষত্রিয় পদবি। অর্থাৎ, রক্ষাকর্তা মানেই ক্ষত্রিয় হতে হবে। ‘মেড ইন হেভেন’-এ আমরা দেখি ‘ড. পল্লবী মেনকে’-র গল্প। উচ্চবর্ণের পাঞ্জাবি ছেলের সঙ্গে প্রেম হলেও বিয়ের সময় পাত্রপক্ষ ‘পল্লবী’-র দলিত আইডেনটিটি ঢেকে দিতে চায়। ‘পল্লবী’ প্রতিবাদ করে এবং এই সিরিজে আমরা দেখি দলিত বিয়ের উদ্যাপন গ্ল্যামারাস এবং চোখধাঁধানো। মূলধারার হিন্দি ‘কনটেন্ট’-এ এমন ঝলমলে, স্বপ্নিল, চকচকে দলিত রিপ্রেজেন্টেশন আগে দেখিনি। প্রথমত তার কারণ হল দলিত সম্প্রদায়কে অসহায়, নুইয়ে পড়া, অসাম্যের শিকার হিসেবে দেখতেই স্বচ্ছন্দ্য বোধ করে আমাদের সমাজ এবং দ্বিতীয়ত গল্প বলছে, পরিচালনা করছে, অভিনয় করছে উচ্চবর্ণ সম্প্রদায়। তাদের দেখার চোখ সেটাই দেখাবে, যেটা তারা দেখতে চায়। মেনস্ট্রিম বলিউডে গৌরী শিন্দে বা নীরজ ধাওয়ানের মতো পরিচালক আর ক’জন আছেন।
দলিত কনটেন্ট প্রসঙ্গে মনে পড়ছে ‘দিল্লি ক্রাইম সিজন টু’-তে ‘ডি-নোটিফায়েড’ গোষ্ঠীর কথা, যাদের জন্মগত ক্রিমিনাল হিসাবে দেখত ব্রিটিশ সরকার। পরে আইন করে এই গোষ্ঠীকে ‘ডি নোটিফাই’ করা হলেও সমাজ বদলায়নি। এবং এই ‘ডি-নোটিফায়েড’ সম্প্রদায়ের উন্নতিও হয়নি। আম্বেদকরবাদী আদর্শের সঙ্গে পূর্ব উল্লিখিত মেনস্ট্রিম কনটেন্টকে পুরোপুরি মেলানো যাবে না হয়তো। বরং চৈতন্য তমন্নে পরিচালিত ‘কোর্ট’ (২০১৪) ছবিটি এই ভাবনার কাছাকাছি। এই ছবিতে ব্রাহ্মণের সেভিয়ার কমপ্লেক্স নেই, দলিত নিপীড়নকে গ্লোরিফাই করার প্রচেষ্টা নেই। বরং ভারতীয় আইনি ব্যবস্থায় একজন দলিতের অভিজ্ঞতাকেই জোর দেওয়া হয়েছে। দলিত-বহুজন অ্যাক্টিভিস্ট ‘নারায়ণ কাম্বলে’-র চরিত্রে ভিরা সাথিদারকে (দলিত কবি এবং অ্যাক্টিভিস্ট) দিয়ে অভিনয় করানো খুব সচেতনভাবেই। যদিও মেনস্ট্রিম ছবির ব্যালট বক্সের আওতায় আসে না ‘কোর্ট’। তেমনই আরও একটি বহু চর্চিত ছবি হল ‘সাইরাত’ (২০১৬), যার অনুকরণে মেনস্ট্রিম বলিউডে ‘ধড়ক’ (২০১৮) তৈরি হলেও, এই ছবি দলিত রাজনীতির চিত্রায়ণে ব্যর্থ। পরিসংখ্যান বলে ২০১৩-২০১৪-তে হওয়া ৩০০ ছবির মধ্যে মোট ছ’টি ছবির কেন্দ্রে রয়েছে দলিত সম্প্রদায়ের চরিত্র।
তবে আইরনি হল ‘মেড ইন হেভেন’-এ ‘পল্লবি মেনকে’-র চরিত্রের সঙ্গে ‘কামিং আউট অ্যাজ দলিত’-এর লেখক ইয়াশিকা দত্ত নিজের মিল খুঁজে পেয়ে স্বীকৃতি চাইলে নির্মাতারা বেশ কড়া ভাষায় তা খারিজ করে দেন। সোশ্যাল মিডিয়াতে এই নিয়ে বিতর্কও হয়ে গিয়েছে। একদিকে দলিত মহিলা লেখক, অন্যদিকে একটু বেশি ক্ষমতাবান দলিত পুরুষ পরিচালক এবং অন্যান্য। এ নিয়ে টুইটারও গরম হয়েছে বেশ কয়েকদিন। অন্যদিকে ‘দি এলিফ্যান্ট হুইসপারার্স’ তথ্যচিত্রের দুই প্রধান চরিত্র বোম্মান এবং বেলি, যাঁরা হাতির দেখভালের দায়িত্বে, যাঁদের সঙ্গে কথা বলে তথ্যচিত্রটি তৈরি করা হল– তাঁদের শোষণের গল্প হয়তো অনেকেই জানে না। নির্মাতারা কথা রাখেননি, যোগ্য পারিশ্রমিক দেননি এই দাবিতে তাঁরা নির্মাতাদের আইনি নোটিস পাঠিয়েছেন। এই খবর একবার ভেসে উঠে জলে বুড়ি কাটার মতো করেই হারিয়ে যায়। আমাদের মনে থাকবে ‘অস্কার’-এর আলোয় দেখা মঞ্চের ম্যাজিকটুকুই। সিনেমায় দলিত-বহুজন কণ্ঠস্বর আরও জোরালো হয়ে উঠতে যেন আরও ৯০টা বছর না লেগে যায়, এটাই কাম্য!