১৮৮৯-তে নগেন্দ্র প্রসাদের শোভাবাজার ক্লাবের একটা ম্যাচে না কি ভুল ফলাফল দেখানো হয়েছে। পাক্কা তিন বছর পর একজন মোহনবাগান সমর্থক আইনক্সে আমাকে দেখতে পেয়ে পাকড়াও করেছিলেন। তাঁর মুখটা আজ সত্যিই মনে পড়ছে। জাকার্তা এশিয়াডের সেমিফাইনালে ভারতীয় দল শুরু থেকে ২ গোলে জিতছিল। শেষ পর্যন্ত ম্যাচটা জেতে ৩-২ গোলে। ময়দানে দেখানো হল, ভারতীয় দল শুরুতেই ২ গোল খেয়ে গিয়েছে। চোটের জন্য সেমিফাইনাল থেকেই খেলতে পারেননি রাম বাহাদুর। ময়দানে দেখলাম, ফাইনালেও দাপিয়ে খেলছেন রাম বাহাদুর। এরকম ঐতিহাসিক সিনেমায় সব তথ্য এতটা ‘ঘাটিয়া’ করে দিলে ক্যায়সে চলেগা? নাহলে ময়দান হচ্ছে, ফুটবলের চক দে ইন্ডিয়া।
বিশ্বকাপ কভার করতে ব্রাজিল গিয়েছিলাম ২০১৪-তে। তখনও বিশ্বকাপ শুরু হতে দিন পঁচিশেক বাকি। এদিক-ওদিক ঘুরে দেখার জন্য হাতে একদিন সময়ে পেয়েছি। সেই সুযোগে সাও পাওলোর মিউজিয়াম গিয়েছি। ঢুকে তো চক্ষু চড়কগাছ! পেলে যে-তিনটে বিশ্বকাপ জিতেছেন, সেই তিনটির জার্সিই সেখানে জ্বলজ্বল করছে। ২০১৪ পর্যন্ত যত বিশ্বকাপ হয়েছে, প্রত্যেকটি বিশ্বকাপের বল সেখানে রাখা। যে বুট পরে রোমারিও বিশ্বকাপ জিতেছিলেন, রাখা আছে সেই বুটটাও।
এসব দেখতে দেখতে বিশ্বাস করুন, মনটা ধাওয়া করছিল কলকাতায়।
কী ভালোই না হত, কলকাতার মিউজিয়ামে ঢুকেই যদি দেখতে পেতাম, ১৯৬২-র এশিয়াডে সোনা জয়ী ম্যাচে চুনী গোস্বামীর সেই জার্সিটা? যদি থাকত ১৯৫১-র এশিয়াডে সোনা জেতা ম্যাচে শৈলেন মান্নার জার্সি? কোথাও কিচ্ছু নেই। তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম কীভাবে উদ্বুদ্ধ হবে ফুটবল নিয়ে? কীভাবে জানতে পারবে ফুটবল ঘিরে আমাদের সোনালি অতীতকে ? ‘ময়দান’ হল ভারতীয় ফুটবলের সেই ঐতিহাসিক দলিল। যা চিরঅক্ষয় হয়ে থাকবে ভারতীয় ফুটবলপ্রেমীদের হৃদয়ের ভল্টে। কিন্তু কী করবেন প্রশান্ত সিনহা কিংবা অরুণ ঘোষের মতো জাকার্তা এশিয়াডের সোনার ছেলেদের পরবর্তী প্রজন্ম, সে আমার সত্যিই জানা নেই। হয়তো প্রশান্ত সিনহার নাতি এতদিন শুনে এসেছে, সেদিন জাকার্তা এশিয়াডের ফাইনালে তার দাদু অসাধারণ ফুটবল খেলেছিলেন। কিন্তু ‘ময়দান’ দেখতে গিয়ে দেখল, তার দাদু নয়। ফাইনালে খেলছে রাম বাহাদুর। যাকে বসিয়ে ফাইনালে খেলেছিলেন প্রশান্ত সিনহা। ফলে দলিল থাকলেও হয়তো তথ্যের উইপোকা এমনভাবে খেয়েছে, যাতে আদালতে পেশ হলে দলিলের উত্তরাধিকার নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠে যাবে। শুধু ‘সিনেমা’ প্রসঙ্গে যদি বলেন, দু’বার দেখার মতো চলচ্চিত্র। যেখানে আবেগ, ভালবাসা চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। কিন্তু পুরো সিনেমা জুড়ে ‘তথ্য’ যে বহুত ‘ঘাটিয়া’ হ্যায়।
‘গোলন্দাজ’ ছবির জন্য আমাদের তখন ইস্টবেঙ্গল মাঠে প্র্যাকটিস চলছে। ঠিক পাশেই তখন মহামেডান মাঠে চলছিল ‘ময়দান’-এর শুটিং। অরুণ ঘোষের চরিত্রে যিনি অভিনয় করেছেন সেই আমান মুন্সিকে আমাদের ‘গোলন্দাজ’-এও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ময়দান থেকে ক’বে ছুটি পাবে সেটাই তখনও কনফার্ম নয়। ফলে নেওয়া গেল না। ইস্টবেঙ্গল মাঠে প্র্যাকটিস শেষ করে মহামেডান মাঠে চলে আসতাম ‘ময়দান’ এর শুট দেখতে। দেখতাম, মোহনবাগানে খেলে যাওয়া মননদীপ, সেই পর্দার চুনী গোস্বামী, তুলসীদাস বলরামদের কোচিং করাচ্ছে। পর্দায় যে ত্রিলোক সিংয়ের চরিত্রে খেলেছে। শুনলাম, সবাই কলকাতায় পাঁচতারা হোটেলে রয়েছে। সেখান থেকেই প্রোডাকশনের গাড়িতে সবাই শুটিংয়ে আসে। ঠিক হল, ময়দানের যিনি ‘স্পোর্টস কোরিওগ্রাফার’ তাঁর সঙ্গে একটা মিটিং করা হবে। কারণ, স্পোর্টিস মুভিতে ‘স্পোর্টস কোরিওগ্রাফ’ একটা বিশেষ ব্যাপার। দক্ষ লোকের হাতে পড়লে ‘স্পোর্টস কোরিওগ্রাফ’ কতটা উন্নত হতে পারে, তা ‘ময়দান’ সিনেমাতে সবাই প্রত্যক্ষও করেছেন। আমাদের প্রোডাকশনের তরফে পরিচালক ধ্রুবকে নিয়ে আলোচনায় বসা হল ‘ময়দান’-এর ‘স্পোর্টস কোরিওগ্রাফার’-এর সঙ্গে। তিনি একা যা পারিশ্রমিক চাইলেন, তা আমাদের ‘গোলন্দাজ’ সিনেমার টোটাল বাজেটের থেকে একটু বেশি। এরপর আর কথা এগোনোর কোনও মানেই হয় না।
দেখলাম, খেলার শুট হচ্ছে আটটা ক্যামেরায়। এর সঙ্গে রয়েছে ড্রোন। আমাদের ‘গোলন্দাজ’-এ ক্লাইম্যাক্সের খেলার শুটে ব্যবহার হয়েছিল, ডাবল ক্যামেরা আর ড্রোন। আমাদের খেলার শুট হয়েছিল ৯ দিন ধরে। মোট শুটিং ২১ দিনের। ঠিক এখানেই বনি কাপুর-সহ আরও দুই প্রযোজককে শত কোটি প্রণাম। ফুটবল নিয়ে একটা সিনেমা করার জন্য কি না করেছেন তাঁরা। সব-সবরকম সুবিধা তুলে দিয়েছেন পরিচালককে। ২০০ কোটি টাকার উপর বাজেট। আর পুরো খেলার শুটটা হয়েছে দেড় বছর ধরে। শুট হয়েছে, ১৮০ দিনেরও বেশি। ‘ময়দান’ দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, অনেক ক্ষেত্রে খেলার একেকটা শট বোধহয় সারা দিন ধরে নেওয়া হয়েছে। এতটাই যত্নে এবং ধৈর্য সহকারে। কিন্তু…? কিন্তু একটা ঐতিহাসিক সিনেমাতে এত তথ্যগত ভুল কীভাবে হল সত্যিই বুঝতে পারছি না। অবশ্যি হিন্দি সিনেমা তো! জাকার্তা এশিয়াডের প্রথম ম্যাচে কোরিয়ার কাছে ভারতীয় দল হেরেছিল ২-০ গোলে। ময়দানে দেখানো হল ৪ গোলে হেরেছে। না, হিন্দি সিনেমা তো। কোথাও কোনও ট্রোল নেই। ’৬২-র স্মৃতি এদের কাছে ম্লান। এরা ১৮৮৯ সালে সবাই নগেন্দ্র প্রসাদকে দেখেছিলেন। নাহলে দেবের গোঁফের সঙ্গে নগেন্দ্র প্রসাদের গোঁফ মিলল কি না, তা নিয়ে আলাদা করে পেজ খুলে ফেলে? আসলে বাংলা সিনেমা তো। সব ‘ঘাটিয়া হ্যায়।’
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
১৯৬২-তে ভারতীয় দলকে অন্ধকূপ থেকে তুলে ধরেননি রহিম সাহেব। তার দশ বছর আগেই ১৯৫১-তে তিনি ভারতীয় দলে সোনা জিতিয়েছেন এশিয়াডে। শৈলেন মান্না সেই দলের অধিনায়ক ছিলেন। বাঙালি ভুলে গিয়েছে। কী আর করা যাবে। রহিম সাহেব যাতে সোনা জিততে না পারেন, সেটাও কাঠি করেছেন একজন বাঙালি সাংবাদিক। ময়দানে সেরকমই দেখানো হয়েছে। আসলে বাংলার সব ‘ঘাটিয়া’ হ্যায়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
অনেকে বলবেন, সিনেম্যাটিক লাইসেন্সে ওরকম ভুল দেখানোই যায়। ধরুন, ‘৮৩’ সিনেমাতে দেখানো হল ফাইনালে ৩৮ এর বদলে শ্রীকান্ত করলেন ৫৮। মানবেন? ধরুন, সিনেমাকে আরও আবেগঘন এবং মোহময় ও আরও বীরত্ব দেখানোর জন্য জন্য কপিল দেবের ১৭৫ নটআউট-কে দেখানো হল অপরাজিত ৩৭৫। মানবেন? বলবেন, সিনেমাটিক লাইসেন্স নেওয়াই যায়? আসলে হিন্দি সিনেমা তো। সব চলতা হ্যায়। বাংলা হলেই ‘ঘাটিয়া’ হ্যায়। বাংলা তো ‘ঘাটিয়া’-ই।
না হলে হায়দরাবাদ সন্তোষ ট্রফিতে কলকাতায় এসে বাংলাকে হারিয়ে দিয়ে চলে গেল ! সেইসময় বাংলাকে সন্তোষ ট্রফিতে হারাচ্ছে, স্বপ্নেও হায়দরাবাদের ফুটবলাররা ভাবতে পেরেছেন? আমরা বাঙালিরা পর্দায় সেটাও দেখলাম আর চোখের জল ফেললাম।
১৮৮৯-তে নগেন্দ্র প্রসাদের শোভাবাজার ক্লাবের একটা ম্যাচে নাকি ভুল ফলাফল দেখানো হয়েছে। পাক্কা তিন বছর পর একজন মোহনবাগান সমর্থক আইনক্সে আমাকে দেখতে পেয়ে পাকড়াও করেছিলেন। তাঁর মুখটা আজ সত্যিই মনে পড়ছে। জাকার্তা এশিয়াডের সেমিফাইনালে ভারতীয় দল শুরু থেকে ২ গোলে জিতছিল। শেষ পর্যন্ত ম্যাচটা জেতে ৩-২ গোলে। ময়দানে দেখানো হল, ভারতীয় দল শুরুতেই ২ গোল খেয়ে গিয়েছে। চোটের জন্য সেমিফাইনাল থেকেই খেলতে পারেননি রাম বাহাদুর। ময়দানে দেখলাম, ফাইনালেও দাপিয়ে খেলছেন রাম বাহাদুর। হিন্দি সিনেমা যখন, সব আচ্ছা হ্যায়। বাংলার হারিয়েই থামা হয়নি। সিনেমার ভিলেনও একজন বাঙালি। আইএফএ কর্তা বেচু দত্ত রায়ের আদলেই তৈরি হয়েছে ‘শুভঙ্কর’ রুদ্রনীলের চরিত্র। ’৪২-এ বিকাশ রায়ের খলনায়কোচিত অভিনয় দেখে যে পরিমাণ রাগ হয়েছে আপামর ভারতবাসীর। এক্ষেত্রেও রুদ্রনীলের অভিনয় দেখেও তাই হয়েছে। এরপর রুদ্রর সত্যিই বলিউডের দিকেই চোখ রাখা উচিত। কী অসাধারণ অভিনয়। কিন্তু বেচু দত্ত রায় ওরফে মণীন্দ্র দত্ত রায় কি সত্যিই এত খারাপ লোক ছিলেন যিনি জাকার্তার মাঠে দাঁড়িয়েও চাইছিলেন ভারতের পরাজয়!
সেদিন ময়দান সিনেমাটা সাউথ সিটির আইনক্সে দেখার সময় পাশের দুই অবাঙালি নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল, ‘বঙ্গালি লোক সহি জাগাহ পে কাঠি কর দেতে হ্যায়’। অথচ মণীন্দ্র দত্ত রায়ের নামেই অনূর্ধ্ব-২১ জাতীয় ফুটবল করে ফেডারেশন।
১৯৬২-তে ভারতীয় দলকে অন্ধকূপ থেকে তুলে ধরেননি রহিম সাহেব। তার দশ বছর আগেই ১৯৫১-তে তিনি ভারতীয় দলে সোনা জিতিয়েছেন এশিয়াডে। শৈলেন মান্না সেই দলের অধিনায়ক ছিলেন। বাঙালি ভুলে গিয়েছে। কী আর করা যাবে। রহিম সাহেব যাতে সোনা জিততে না পারেন, সেটাও কাঠি করেছেন একজন বাঙালি সাংবাদিক। ময়দানে সেরকমই দেখানো হয়েছে। আসলে বাংলার সব ‘ঘাটিয়া’ হ্যায়।
কিন্তু আসল তথ্যটা দেখালে বোধহয় ভালো হত। জাকার্তা তখন রাজনৈতিকভাবে উত্তাল। ভারতীয় দলের শেষ ম্যাচটাই ছিল ফুটবল। আগেরদিন পাকিস্তানের হকি দল ভারতীয় দলকে হারিয়ে দেয়। ফুটবল ফাইনালে মাঠে কোনও ভারতীয় দর্শককে ঢুকতে পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। ফাইনালে মাঠে ঢুকে ভারতীয় দলের জন্য গ্যালারি থেকে গলা ফাটিয়েছিলেন পাকিস্তানের হকি প্লেয়াররা।
আরেকটা কথা। ২০১৮-তে মহামেডান মাঠে শুট হয়েছে ‘ময়দান’-এর। মহামেডানে তখন কাঠের গ্যালারি ভেঙে কংক্রিটের গ্যালারি করে দিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। সিনেমাতে দেখা যাচ্ছে, ১৯৬০-এর অলিম্পিকের প্রস্তুতি চলছে মহামেডান মাঠে। পিছনে কংক্রিটের গ্যালারি! সামান্য ‘সিজি’ করলেই তো গ্যালারি সরে যেতে। আসলে প্র্যাকটিস হয়েছিল, মনুমেন্টের সামনে সিটি মাঠে। সিজিতে সেটা করাই যেত। যদি কোনও বাংলা সিনেমায় ২০১৮ সালের গ্যালারিকে ১৯৬০ সালের মাঠে দেখিয়ে দেওয়া হত, তাহলে এতক্ষণে সোশ্যাল মিডিয়াতে হ্যাজ নেমে যেত।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: যৌনসারল্যে শরীরকে আবিষ্কার করার স্বাভাবিকতাই ‘পুওর থিংস’-এর ম্যাজিক
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এরপরেও বলছি, ফুটবলকে কেন্দ্র করে এরকম ধরনের সিনেমা হওয়া সত্যিই দরকার ছিল। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম জানবে, ফুটবলটা আমরাও খেলতে পারতাম। জানি, সিনেমা হলটা ইতিহাস ক্লাস নয়। জানি কেউ ইতিহাস বই সঙ্গে নিয়ে সিনেমা দেখতে যায় না। জানি, এটা রহিম সাহেব বা ’৬২-র এশিয়াড নিয়ে ডকুমেন্টরি নয়। কিন্তু ফাইনালে রাম বাহাদুরের জায়গায় প্রশান্ত সিনহাকে দেখালে কী এমন উত্তেজনা কমত? অথবা বাংলাকে না হারালে কি চুনী গোস্বামীকে সেই ম্যাচ থেকে সিলেক্ট করা যেত না? প্রযোজক তো কোনও খামতি রাখেননি। সময়, টাকা সব উজাড় করে দিয়েছেন। অজয় দেবগন জীবনের অন্যতম সেরা অভিনয়টা করে দিলেন। কিন্তু এরকম ঐতিহাসিক সিনেমায় সব তথ্য এতটা ‘ঘাটিয়া’ করে দিলে ক্যায়সে চলেগা? নাহলে ময়দান হচ্ছে, ফুটবলের ‘চক দে ইন্ডিয়া’।