‘বার্বি’-কে প্রোগ্রেসিভ, ফেমিনিস্ট ছবি বলা হচ্ছে কেন? আর কেনই বা পুরুষবিরোধী আখ্যা দেওয়া হচ্ছে? বার্বি যে বিউটি স্ট্যার্ন্ডাড এবং সেক্সুয়াল স্টিরিওটাইপ তুলে ধরে, সেটা ‘মেল গেজ’-এর চাহিদা থেকেই। আলোচনায় বিদিশা চট্টোপাধ্যায়।
দারুণ উজ্জ্বল গোলাপি পৃথিবী, নিখুঁত শরীর এবং চেহারার দুর্দান্ত প্যাকেজে মোড়া ‘বার্বি’ বলছে নারীর প্রতিদিনকার লড়াইয়ে, তাদের পাশে থেকে অনুপ্রেরণা জোগানোর কথা। বাস্তব পৃথিবীর মহিলারাও বার্বির মতোই সুন্দর এবং সফল হওয়ার ক্ষমতা রাখে, দাবি এই ছবির। শুধু তাই নয়, সৌন্দর্য্য এবং সাফল্যের মাপকাঠিও পরোক্ষভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে। একটা স্ট্যান্ডার্ড সেট করে দেওয়া হচ্ছে। আসলে ক্যাপিটালিস্ট এবং কনজিউমারিস্ট পৃথিবীর গণ্ডির ভিতরেই থাকছে নারী-স্বাধীনতার সংজ্ঞা। বার্বির জনক রুথ হ্যান্ডলার বলেছিলেন, ‘বার্বি অলওয়েজ রিপ্রেজেন্টেড দ্য ফ্যাক্ট দ্যাট এ উওম্যান হ্যাজ এ চয়েজ।’ অথচ ১৯৫৯ সালে লঞ্চ হওয়া বার্বি যে জার্মান পুতুল (বিল্ড লিলি) থেকে অনুপ্রাণিত, সেই লিলি কিন্তু সেক্স টয় হিসেবেই ব্যবহৃত হত। ‘টিন এজ ফ্যাশন মডেল’ হিসেবেই বার্বিকে প্রথমে প্রোমোট করা হয়। তার ভাইট্যাল স্ট্যাটিস্টিক হল ৩৬-১৮-৩৩। সেখানে তার কোনও চয়েস নেই। হেলসিঙ্কির ‘ইউনিভার্সিটি সেন্ট্রাল হসপিটাল’-এর রিসার্চ অনুযায়ী, একজন মহিলার এই ভাইটাল স্ট্যাট হলে তার শরীরে ১৭ থেকে ২২ পার্সেন্ট ফ্যাট কম থাকে ঋতুস্রাবের জন্য। ১৯৬৩ সালে ম্যাটেল-এর ‘বার্বি বেবি সিটস’-এর প্যাকেজের সঙ্গে থাকত বার্বির মিনি সাইজের বই ‘ডোন্ট ইট’। অর্থাৎ ফ্যাশন ট্রেন্ড বলছে খাওয়া চলবে না। ‘দ্য ডেভিল ওয়্যারস প্রাডা’ ছবির একটি দৃশ্যে ‘মিরান্ডা’র সেক্রেটারি ‘এমিলি’ তার চেহারা নিয়ে প্রশংসা শুনে সলজ্জ ভঙ্গিতে বলে, ‘ফাইনালি আমি শেপে আছি। বেসিক্যালি আই ডোন্ট ইট।’ আমেরিকার রিয়্যালিটি টিভি শো হোস্ট লেসি ওয়াইল্ড ১২টা ব্রেস্ট অগুমেনটেশন সার্জারি করিয়েছিলেন বার্বির মতো স্তন পেতে।
প্রশ্ন হল, এই ছবি সকলের ভাল লাগছে কেন? ‘বার্বি’-কে তারা প্রোগ্রেসিভ, ফেমিনিস্ট ছবি বলছেন কেন? আর কেনই বা পুরুষবিরোধী আখ্যা দিচ্ছে? তারা কেন ভুলে গেল বার্বির ইতিহাস? বার্বি যে বিউটি স্ট্যার্ন্ডাড এবং সেক্সুয়াল স্টিরিওটাইপ তুলে ধরে, সেটা ‘মেল গেজ’-এর চাহিদা থেকেই। ১৯৭২ সালে আন্তর্জাতিক পুতুল মেলায় নারীবাদী সংগঠন এর প্রতিবাদ করে। পোস্ট কলোনিয়াল যুগে ক্ষমতার অনুক্রম বোঝাতে, লিঙ্গ-ভিত্তিক পরিচয়ের যে মাপদণ্ড বা বৈষম্য, বার্বি গোড়া থেকেই সেই পিতৃতান্ত্রিক মাপকাঠি অনুসরণ করে এসেছে। ১৯৯২ সালে ম্যাটেল-এর বার্বির মুখের সংলাপ হল ‘ম্যাথ ক্লাস ইজ টাফ’। অর্থাৎ, তোমার লিঙ্গ নির্ধারণ করে দিচ্ছে কোনটা নারীসুলভ, কোনটা পুরুষসুলভ। বর্ণবিদ্বেষও কিন্তু লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের দর্শন দ্বারাই পরিচালিত, যেখানে জন্মানোর পর একদল এগিয়ে থাকছে কেবলমাত্র নির্দিষ্ট জাতি-গোষ্ঠীর অন্তর্গত বলে। ১৯৯৭ সালে ম্যাটেল-এর ‘ওরিও বার্বি’ বর্ণবিদ্বেষ উসকে দেয়। কারণ কালো চামড়ার এই বার্বির নাম ‘ওরিও’, যা একটি বর্ণবিদ্বেষী স্ল্যাং! সেই সময়ে ‘কালো-চামড়া’-দের ‘ওরিও’ বলে ডাকা হত, অর্থাৎ গায়ের রং কালো হলেও যাদের ভিতরে ‘সাদা চামড়া’র মতো হাবভাব আছে বলে মনে করত ‘সাদা চামড়া’ গোষ্ঠী। ছবির ব্যবসা ভাল হওয়ার পর লিমিটেড এডিশন-এর ‘উইয়ার্ড বার্বি’ বাজারে এলেও, ‘কুইয়ার বার্বি’ স্থান পায়নি, কারণ তারা এখনও মার্জিনালাইজড।
তাহলে হঠাৎ কী হল, একটা ছবির সাফল্য সব বদলে দিল কেন? গ্রেটা গারউইগ পরিচালিত ‘বার্বি’ খুব সুচতুরভাবে মেয়েদের হাতে তুলে দিয়েছে স্টিয়ারিং। কল্পনার গোলাপি মনোরম জগৎ আর বাস্তব পৃথিবীর ফারাক মুছে দেওয়ার গল্প বলেছেন। কথক বলছে, ‘বার্বি ইজ অল দিজ উওম্যান। অ্যান্ড অল দিজ উওম্যান আর বার্বি’, ‘থ্যাংকস টু বার্বি, অল প্রবলেমস অফ ফেমিনিজম হ্যাভ বিন সলভ্ড’। এই ছবিতে মজা আছে, স্যাটায়ার আছে, গ্ল্যামার আছে, শাইন আছে। যা একটি ‘সামার রিলিজ’ ফ্যান্টাসি ফিল্মের থাকা দরকার। শহরে থাকা যে প্রিভিলেজ ক্লাস এই ছবি দেখতে যাবে, তারা ফিল-গুড, হ্যাপি এন্ডিং সিনেমা দেখতে চায়। ম্যাটেল এবং গ্রেটা গারউইগ সেটাই নিখুঁত মিশ্রণে পেশ করেছে। সমস্যার কথা থাকলেও তার ওপরে সুন্দর পালিশ আছে। অনেকটা ‘ন্যুড মেকআপ’-এর মতো। নিবেদিতা মেনন তাঁর বই ‘সিইং লাইক এ ফেমিনিস্ট’-এ বলছেন, ‘ন্যুড মেকআপের উদ্দেশ্যই হল কয়েক ঘণ্টা ধরে মেকআপ করে মুখের খুঁতগুলো ঢেকে দাও, যাতে মনে না হয়, তুমি মেকআপ করেছ। দ্য মেনটেনিং অফ সোশ্যাল অর্ডার ইজ লাইক দ্যাট’। নারীর বাধ্যতামূলক অবস্থান নিয়ে ছবিতে ‘গ্লোরিয়া’র যে মোনোলগ, সেটাও এই ন্যুড মেকআপের দ্বিচারিতার দিকেই ইঙ্গিত করে। এবং লক্ষণীয়, বার্বির বিপরীতে দাঁড়ানো যে ‘সাধারণ’, ‘ইম্পারফেক্ট’ নারী ‘গ্লোরিয়া’– তার অর্থনৈতিক, সামাজিক অবস্থান বলে দেয় সে অত্যন্ত প্রিভিলেজড। এই ছবির দর্শক মূলত এরাই– আজকের আধুনিক নারী, যার অর্থনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী, যার একটা নিজস্ব ভয়েস আছে, যার স্বাধীনতার ডিকশনারিতে ‘চয়েস’ বলে একটা শব্দ আছে। অথচ ভেবে দেখলে বোঝা যায় ‘চয়েস’ থাকার মধ্যেও সীমাবদ্ধতা আছে। কমোডিফিকেশনের যুগে এই পুঁজিবাদী সমাজই তোমায় অপশন তৈরি করে দিচ্ছে। এবার তুমি বেছে নাও। অমর্ত্য সেন লিখছেন, ‘নাথিং ক্যান বি মোর ইউনিভার্সাল অর এলিমেন্টারি দ্যান দ্য ফ্যাক্ট দ্যাট চয়েসেস অফ অল কাইন্ডস ইন এভরি এরিয়া আর অলওয়েজ মেড উইদিন পার্টিকুলার লিমিটস।’ আর এই ‘লিমিট’ বা সীমাবদ্ধতা যে আছে, সেটাই গুলিয়ে দেওয়া হয়।
বডি পজিটিভিটির কথা বলা হয়, ডাবল এক্সএল সাইজ, ডার্ক স্কিন উদ্যাপন করা হয়, কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়াতে রোগা হওয়ার, উজ্জ্বল ত্বক তৈরির করার আশ্চর্য উপায় বাতলে দেওয়া রিলের জনপ্রিয়তা দেখলে তাক লেগে যায়। অথচ বলা হচ্ছে চয়েস আপনার!
কসমেটিক প্রোডাক্ট-এর বাড়বাড়ন্ত এবং ‘বডি পজিটিভিটি’র স্লোগান যেভাবে বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে, ‘বার্বি’ এবং ‘ফেমিনিজম’ আসলে তেমনই ওক্সিমোরোন-এর উদাহরণ। ফলে এই ছবিকে যদি একটি দু’ঘণ্টার বার্বির বিজ্ঞাপন বলা হয়, তাহলে খুব ভুল হবে না। ফেমিনিজমকে পণ্য করেই মার্গট রবি এবং রায়ান গসলিং অভিনীত এই ছবি ‘বার্বি’র ফেমিনিস্ট মেকওভার-এ সফল হয়েছে। গ্রেটা গারউইগ-এর ছবি তৈরি হয়েছে একটি বিশেষ ব্র্যান্ডকে পরিবেশন করার জন্যই। কারণ এই সফল ফ্র্যাঞ্চাইজিকে ঘিরে যে পরিমাণ টাকার লগ্নি, সেটা সচল রাখতে চাই দুর্দান্ত মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি। শোনা যাচ্ছে, আরও ৪৫টি ছবি তৈরির ভাবনা রয়েছে। তাই চোখ ধাঁধানো এন্ট্রি গ্রেটা গারউইগের মতো পরিচালককে সঙ্গে করে, যিনি হলেন নারীকেন্দ্রীক ছবির পোস্টার চাইল্ড। ম্যাটেলের পরবর্তী তুরুপের তাস হতে চলেছেন পরিচালক লেনা ডানহ্যাম, ম্যাটেলভার্সের ব্যাপ্তির জন্য তাঁকে ‘পলি পকেট’ (ম্যাটেল-এর অন্য পুতুল) পরিচালনার ভার দেওয়া হয়েছে। শোনা যাচ্ছে, নামভূমিকায় অভিনয় করবেন ‘এমিলি ইন প্যারিস’ খ্যাত অভিনেত্রী লিলি কলিন্স। ‘মার্ভেল’ মডেলের রেপ্লিকা তৈরি করতে তাই ‘এ’ লিস্টেড ফেমিনিস্টদের বাছাই করা হচ্ছে– এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। এবং তা নিয়ে আশাপ্রদ হওয়া উচিত কি না, সেই সংশয় থেকেই যায়।