২০২২-এর প্রেস ইনফর্মেশন ব্যুরো বলছে যে, ভারতে এক লাখ প্রসূতির মধ্যে ৯৭ জন মারা যান সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে। ইউনাইটেড নেশনস-এর মতে, ২০২৩ সালে ভারতে ১৯০০০ জন গর্ভবতী মহিলা মারা গেছেন, প্রতিদিন প্রায় গড়ে ৫২ জন যা ভারতকে প্রসূতিমৃত্যুতে আন্তর্জাতিক স্তরে দ্বিতীয় স্থানে এনেছে। সরকারি অনুদান বা হাসপাতালের বৈজ্ঞানিক পরিকাঠামো উপভোগ করার ক্ষেত্রে সবসময় যে দারিদ্র বাধা হয়ে দাঁড়ায় তা নয়; ধর্মীয় এবং সামাজিক বিশ্বাস, লিঙ্গবৈষম্য ও নানা কুসংস্কারের জন্য বিস্তীর্ণ এলাকায় মহিলারা সন্তান ধারণের সময় সামান্য পরিচর্যাটুকুও পান না।
মাতৃত্বকালীন মৃত্যুহারে সারা পৃথিবীতে প্রথম স্থান অধিকার করে আছে দক্ষিণ সুদান; আফ্রিকার দেশগুলির পরেই রয়েছে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের নাম।
আমাদের দেশে মাতৃত্বকালীন সুরক্ষা নিয়ে আলোচনা শুরু হয় ঔপনিবেশিক সময়। উনিশ শতকের শেষ দিকে বেহেরামজি মালাবারি ভারতে প্রসূতিমৃত্যু, বাল্যবিবাহ এবং শিশুদের অপুষ্টিজনিত নানা সমস্যা নিয়ে লিখতে শুরু করেন।
১৮৯৩ সালে ‘সহবাস সম্মতি আইন’ (এজ অফ কন্সেন্ট বিল) ভারতীয় মহিলাদের বৈবাহিক বয়স ১০ থেকে ১২ করতে চাইলে তা নিয়ে প্রবল আপত্তির সৃষ্টি হয়। অল্প বয়সে মা হওয়ার কারণে গর্ভবতী মহিলাদের শারীরিক অবস্থার অবনতি, যা থেকে প্রসবের সময় মৃত্যু এবং অপুষ্ট সন্তান জন্ম দেওয়ার মতো ঘটনা তখনকার দিনে একেবারেই ‘বিরল’ ছিল না। এই মর্মে সহবাসের বয়স বাড়ানোর প্রস্তাব এলে তাতে আপত্তি জানান হিন্দু পুনরুত্থানবাদীরা, যাঁরা সেই সময় দাঁড়িয়ে মনে করেছিলেন শাস্ত্র বা ধর্মীয় গ্রন্থ বৈবাহিক বয়স নির্ধারণ করার জন্য উপযুক্ত, এক্ষেত্রে বিজ্ঞান বা ওয়েস্টার্ন মেডিসিনকে গুরুত্ব না দিলেও চলবে। বোম্বে, মাদ্রাজ এবং ক্যালকাটা প্রেসিডেন্সির বিভিন্ন মেডিকেল জার্নাল বা সংবাদপত্র পড়লে জানা যায়, মাতৃত্বকালীন সুরক্ষা নিয়ে কীভাবে তর্ক-বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল বিশ শতকের ভারতে।
বিয়ের বয়স ছাড়াও আলোচনার ক্ষেত্র ছিল ‘midwifery’ বা দাইমাদের জীবিকা নিয়ে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, সুষম আহারের অভাব এবং সর্বোপরি বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে প্রসব না করানোর জন্য ধাত্রীবিদ্যা নিয়ে লেখালেখি শুরু হয় উনিশ শতকে। গ্রামীণ হোক বা শহুরে, নিম্নবর্ণ থেকে উচ্চবর্ণ, সকল মহিলাদেরই প্রসবের সময় পুরুষ ডাক্তাররা কতটা পর্যবেক্ষণ করতে পারবে, সেই নিয়ে দ্বিধা থাকার কারণে ১৮৬৮ সালের পরে ক্যালকাটা মেডিকেল কলেজে ‘midwifery’ কোর্স প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কিছু মহিলাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া গেলে প্রসূতিমৃত্যুর হার কমানো যাবে, এটাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। তবে ঔপনিবেশিক ভারতে প্রসূতিমৃত্যুর জন্য সর্বতোভাবে দায়ী করা হয় গর্ভবতী মহিলার বয়সকে। এই যদি হয় বিশ শতকের আখ্যান, তবে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে গত ৬০-৭০ বছরের পরিসংখ্যান কী বলছে? আইন অনুযায়ী, ১৮ বছরের নিচে বিবাহ ও সন্তান ধারণ করা যায় না, গ্রামগুলিতেও পৌঁছে গেছে সরকারি হাসপাতালের সুযোগ-সুবিধা, এক্ষেত্রে মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যে ভারত ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছে?
১৯৮৭ সালের পর থেকেই ভারত সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে প্রসূতিমৃত্যুর হার কমানোর জন্য। ‘জননী সুরক্ষা যোজনা’, ‘প্রধানমন্ত্রী মাতৃবন্দনা যোজনা’ এবং ‘জননী শিশুসুরক্ষা’ কার্যক্রমের মতো স্কিমগুলি প্রবর্তন করা হয়। বাড়িতে বা পারিবারিক আঁতুড়ে সন্তান জন্ম না দিয়ে যাতে হাসপাতালে, নির্দিষ্ট পরিকাঠামোর মধ্যে প্রসূতিরা আসতে পারেন, সেজন্য ‘ডাইরেক্ট ক্যাস ট্রান্সফার’-এর কথা বলা হয়; অর্থাৎ কোনও দরিদ্র পরিবার যদি মনে করে, তাহলে ৫ থেকে ২৫ হাজার পর্যন্ত আর্থিক মূল্যের সাহায্য পেতে পারেন সরকারি হাসপাতালে প্রসূতি চিকিৎসার জন্য। এই সবকিছুর পরেও ২০২২-এর প্রেস ইনফর্মেশন ব্যুরো বলছে যে, ভারতে এক লাখ প্রসূতির মধ্যে ৯৭ জন মারা যান সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে। ইউনাইটেড নেশনস-এর মতে, ২০২৩ সালে ভারতে ১৯০০০ জন গর্ভবতী মহিলা মারা গেছেন, প্রতিদিন প্রায় গড়ে ৫২ জন যা ভারতকে প্রসূতিমৃত্যুতে আন্তর্জাতিক স্তরে দ্বিতীয় স্থানে এনেছে। সরকারি অনুদান বা হাসপাতালের বৈজ্ঞানিক পরিকাঠামো উপভোগ করার ক্ষেত্রে সব সময় যে দারিদ্র বাধা হয়ে দাঁড়ায় তা নয়; ধর্মীয় এবং সামাজিক বিশ্বাস, লিঙ্গবৈষম্য ও নানান কুসংস্কারের জন্য বিস্তীর্ণ এলাকায় মহিলারা সন্তান ধারণের সময় সামান্য পরিচর্যাটুকুও পান না। একুশ শতকে দাঁড়িয়েও পুত্র সন্তানের পক্ষপাতী, জাতপাত নিয়ে সমস্যা বা পণপ্রথার মতো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ মহিলা বা প্রসূতিদের ওপরে অতিরিক্ত চাপ তৈরি করে। সম্প্রতি সংবাদ শিরোনামে উঠে এসেছে যে, বিভিন্ন যোজনার মাধ্যমে যাঁরা সরকারি হাসপাতালে প্রসব যন্ত্রণা নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্যকর্মীদের থেকে তাঁরা বৈষম্যমূলক আচরণ পেয়েছেন। যোজনাতে কয়েক হাজার টাকা দেওয়ার কথা বললেও তা সঠিকভাবে লাগু করা বা সর্বতোভাবে সংবেদনশীল হওয়ার বিষয়ে ভারত একেবারেই পিছিয়ে আছে।
‘Obstetric violence’ বা লেবার রুম হিংসা এই দেশে ভীষণই গতানুগতিক ঘটনা। ২০১৩ সালে পুণের এক ডাক্তার সংবাদমাধ্যমে স্বীকার করেন যে, সরকারি হাসপাতালে প্রসবের অভিজ্ঞতার সঙ্গে যে কোনও অমানবিক মহিলা জেলের তুলনা করা যেতে পারে। গত দশ বছরে সারা ভারত থেকে পাওয়া বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা যথেষ্ট আশঙ্কা জাগায়; যেমন প্রসবের পরে এক নিম্নবর্গীয় মহিলাকে নিজেই লেবার রুমের ফ্লোর পরিষ্কার করতে বলা হয়। প্রশ্ন উঠছে যে, যোজনার মাধ্যমে কিছু অর্থ সাহায্যের সুযোগ থাকলেও, জনস্বাস্থ্য খাতে আলাদা করে সরকারি বিনিয়োগ কম। হাসপাতালে আয়া, নার্স, প্রশিক্ষিত ব্যক্তি ও ওষুধপত্রের অভাবের জন্য প্রসূতি মৃত্যু এড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে দারিদ্র সীমার নীচে থাকা মহিলারা হাসপাতালে যাওয়াকে গুরুত্ব দেন না, উপযুক্ত পরিকাঠামোতে তাঁরা সুস্থবোধ করবেন– এই আশা বর্তমান স্বাস্থ্যব্যবস্থা তাঁদের দিতে পারেনি। বলা হয়, প্রসবের সময় যে কোনও রকম ভার্বাল বা ফিজিকাল ভায়োলেন্স, পরে পোস্টপার্টম ডিপ্রেশনে পরিণত হতে পারে।
…………………………………………….
‘Obstetric violence’ বা লেবার রুম হিংসা এই দেশে ভীষণই গতানুগতিক ঘটনা। ২০১৩ সালে পুণের এক ডাক্তার সংবাদমাধ্যমে স্বীকার করেন যে, সরকারি হাসপাতালে প্রসবের অভিজ্ঞতার সঙ্গে যে কোনও অমানবিক মহিলা জেলের তুলনা করা যেতে পারে। গত দশ বছরে সারা ভারত থেকে পাওয়া বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা যথেষ্ট আশঙ্কা জাগায়; যেমন প্রসবের পরে এক নিম্নবর্গীয় মহিলাকে নিজেই লেবার রুমের ফ্লোর পরিষ্কার করতে বলা হয়।
…………………………………………….
১১ এপ্রিল সারা ভারতে মাতৃত্বকালীন সুরক্ষা দিবস পালিত হয়, এই প্রসঙ্গেই খুব সম্প্রতি একটি ঘটনার কথা বলা খুব জরুরি। ২০২৪ সালে নভেম্বর মাসে কর্নাটকের একজন ২৯ বছর বয়সি মহিলা, পোস্টপার্টম ডিপ্রেশনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেন। দশ মাসের কন্যা সন্তানকে রেখে এরকম ভয়াবহ পথ বেছে নেওয়ার জন্য মৃত্যুর পরেও তাঁকে কটূক্তি শুনতে হয়। আত্মহত্যা কতটা ‘বৈধ’ বা ‘অবৈধ’ সেই আলোচনায় না গিয়ে মাতৃত্বকালীন সুরক্ষার সঙ্গে এই ঘটনাকে যুক্ত করা দরকার। ভারতের গণমাধ্যম, পারিবারিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় বিশ্বাস বা তথাকথিত জনসংস্কৃতির অঙ্গ সিনেমা, গান ইত্যাদিতে মাতৃত্ব বিষয়টির একরৈখিক চিত্র আঁকা হয়ে থাকে। সদ্যোজাতদের তেল, পাউডার বা সাবানের বিজ্ঞাপনে মায়েদের একইরকম ভাবে দেখতে ও বুঝতে আমরা অভ্যস্ত। এই গতানুগতিক অবয়বে একজন সদ্য সন্তান জন্ম দেওয়া মা যত্নশীল, হাসিখুশি এবং ব্যাধিমুক্ত। প্রশ্ন জাগে, এমন মূল স্রোতের ভাবনায় পোস্টপার্টম ডিপ্রেশনের আলাদা করে কোনও প্রাসঙ্গিকতা আছে কি? ‘সুরক্ষা’ বললে অবশ্যই তা শুধু শরীরের নয়, মানসিকও। কর্ণাটকের মহিলার মৃত্যু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে মাতৃত্বকালীন মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলতে আমরা এখনও প্রস্তুত নই। এক্ষেত্রে চার মাস আগে কেরালা হাইকোর্টের একটি রায় খুব উল্লেখযোগ্য। এক মহিলা পোস্টপার্টম ডিপ্রেশনের শিকার হন এবং কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। তাঁর প্রাক্তন স্বামী দেড় বছরের শিশুর সম্পূর্ণ কাস্টডি দাবি করে বসেন আদালতের কাছ থেকে। সাক্ষ্য প্রমাণসহ বলা হয় যে, অসুস্থ মহিলা তাঁর সন্তানকে দেখার উপযুক্ত নন, তাই বাচ্চাটির অভিভাবকত্ব যাতে শুধুমাত্র বাবার ওপরেই বর্তায়। কেরালা আদালত রায় দেন যে, পোস্টপার্টম একটি সাময়িক ব্যাপার, এবং সেটি কখনওই ফুল কাস্টেডি অস্বীকার করার জন্য উপযুক্ত কারণ নয়। এই নির্দিষ্ট মামলাটি আমাদের ভাবায় যে খুব সাধারণ ভারতীয় পরিবারগুলোতে মাতৃত্ব নিয়ে কী ধরনের প্রত্যাশা, আবেগ, এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে মিথ তৈরি হয়।
একেবারে দারিদ্রসীমার নিচের মহিলাদের হাসপাতালের সুযোগসুবিধা না পাওয়া, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সন্তান ধারণের সময় মৃত্যুর মতো ঘটনা আমাদের যেমন উদ্বিগ্ন করে, তেমনই মধ্যবিত্ত পরিবারে ম্যারিটাল রেপ, মানসিক স্বাস্থ্যের অবহেলা বা আরও নানা অসুরক্ষিত পরিবেশে সন্তান জন্ম দেওয়া নিয়ে আজ কথা বলার দরকার আছে। কীভাবে মানসিক এবং শারীরিক সুরক্ষা প্রদানের মাধ্যমে প্রসূতিমৃত্যু ভারতে কমানো যায়– সেই হেতু অন্যান্য দেশের বিভিন্ন মেটারনিটি কেয়ার মডেলের দিকেও লক্ষ রাখা যেতে পারে। যেমন নাইজেরিয়াতে ‘আবিয়ে মডেল’ প্রস্তুত করা হয়েছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের স্পনসরশিপে এই ত্রিস্তরীয় মডেলে প্রথম ধাপে হেলথ সেন্টার, দ্বিতীয় ধাপে রেগুলার হসপিটাল এবং সবশেষে মাদার অ্যান্ড চাইল্ড হসপিটালকে রাখা হয়েছে। একজন প্রসূতি সন্তান জন্ম দেওয়ার আগে, লেবার রুমে এবং সদ্যোজাতকে নিয়ে, ত্রিস্তরীয় ধাপে যাতে পরিষেবা পায় তাই এই তিনটে প্রতিষ্ঠানকেই একই সূত্রে বেঁধে ফেলা, একটি আরেকটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, কর্মীরাও সর্বক্ষণ যোগাযোগ রাখে, যাতে হেলথ সেন্টার থেকে লেবার রুম এবং শেষে চাইল্ড হসপিটালে ধারাবাহিকভাবে একজন মা ও সন্তান সুরক্ষা পেতে পারে। ভারতের গ্রামগুলোতে যদি এভাবে শুধুমাত্র গর্ভবতী মহিলাদের জন্য পৃথক সেন্টার খোলা যায়, রেগুলার হাসপাতালের বাইরেও, তাহলে অনেক ক্ষেত্রেই অপুষ্টি, অস্বাস্থ্য বা কুসংস্কার পেরিয়ে মা ও সন্তানকে বাঁচানো সম্ভব। এক্ষেত্রে শুধু সরকার নয়, হয়তো বেসরকারি সংস্থা বা এনজিওদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকতে পারে।
ফ্রয়েডের প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব ‘eros and thanatos’ (১৯২০), বা সেক্স ড্রাইভ (life force/will to live) ও ডেথ-ড্রাইভ (self-annihilation/destruction)-এর দ্বিধা ছাড়িয়ে, ভ্রমর বা ভ্রমররা বাঁচতে চায়, এবং সেই বেঁচে থাকার কেন্দ্রে রয়েছে রক্ত-মাংস-মজ্জা দিয়ে তৈরি একটি শরীর।