সান্তারা কি আইনত বৈধ! শিশুর অধিকার সুরক্ষার আইন কি জৈন ধর্মবিশ্বাসী পরিবারের শিশুদের ক্ষেত্রে খাটে না? ২০১৫ সালে রাজস্থান হাইকোর্ট সান্তারাকে অবৈধ এবং দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করে। কোর্টের যুক্তি ছিল সান্তারা কোনও জরুরি ধর্মীয় আচার নয় এবং আর্টিকেল ২১ জীবনের অধিকার সুরক্ষিত করে, মৃত্যুর অধিকার নয়। কিন্তু জৈন ধর্মাবলম্বীদের আবেদনের ভিত্তিতে সান্তারাকে ধর্মীয় ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট এই রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ দেয়। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে বিচারব্যবস্থা বরাবরই ধর্মের পক্ষপাত করে এসেছে। বলতে দ্বিধা নেই, আজও ‘তেমনি বহে ধারা’।
ব্যঙ্গচিত্র রডরিগো
‘এমন মানব জনম আর কি হবে/ মন যা কর, ত্বরায় কর এই ভবে’… আহা! এমন করে জীবনকে ভালোবাসার কথা লালন সাঁই-ই বলতে পারেন। এক গন্তব্যহীন পথ চলার নামই তো জীবন! তার যাপন তো চড়াই-উতরাই ঘেরা এক অভিযান। সুখে-দুঃখে কেটে যায় সে জীবন, কেটে যায় চাওয়া-পাওয়ার সালতামামিতেই। সেটাই তো স্বাভাবিক। ‘পথের শেষ কোথায়, কী আছে শেষে?’ তা নিয়ে ভাবতে বসে বর্তমানকে হেলায় ভাসিয়ে লাভ কী! রবিঠাকুরের মতো বুক ফুলিয়ে যদি বলতে পারতাম, ‘সবাই মোরে করেন ডাকাডাকি, কখন শুনি পরকালের ডাক, সবার আমি সমান বয়সী যে, চুলে আমার যত ধরুক পাক।’ সবাই কি তা পারে! অল্পেই হেরে-যাওয়া মানুষেরা জীবনকে ছেড়ে মৃত্যুকে আঁকড়ে ধরতে চায়। মৃত্যুবিলাসী এই সব পলাতক বর্তমান থেকে পালাতে পরকালের নিশিডাকে সাড়া দিয়ে বসে। আবার ‘শেষের সে দিন’টিকে রীতিমতো পরিকল্পনা করে সাজাতে চান যারা তাঁদের গল্প অবশ্য একটু অন্যরকম। আসুন, তেমনই কিছু গল্প শুনি।
ক’দিন আগে ফ্রেমে বাঁধানো সার্টিফিকেট হাতে এক দম্পতির ছবি দেখে চোখ আটকে গেল। ‘গোল্ডেন বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’-এ নাম উঠেছে তাঁদের শিশুকন্যার। তবে তো ওই সার্টিফিকেট হাতে মেয়েটিরই ছবি ছাপার কথা! তাছাড়া এমন কোনও বিশ্ব রেকর্ডের নাম শুনিনি তো আগে! তাই কোন কৃতিত্বের স্বীকৃতি পেল সেই একরত্তি জানার উৎসাহ জাগে। তিন বছরের বিনয়া জৈন ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত। অস্ত্রোপচার এবং আনুষঙ্গিক চিকিৎসায় খুব একটা সাড়া দিচ্ছিল না সে। হয়তো ছোট্ট বিনয়ার পক্ষে এত বড় রোগের সঙ্গে লড়াই করা সম্ভব ছিল না। পেশায় তথ্য-প্রযুক্তি কর্মী বিনয়ার মা-বাবা বিনয়াকে ইন্দোরের এক সাধুবাবার কাছে নিয়ে যান। বাবার আদেশে জৈন দম্পতি তাঁদের মেয়ের জন্যে সান্তারার আয়োজন করেন। ‘সান্তারা’ বলতে আমরণ অনশন। অর্থাৎ খেতে না দিয়ে ছোট্ট বিনয়ার মৃত্যুকে নিশ্চিত করা। এ এক জৈন আচার। কোনও কোনও জৈন ধর্মাবলম্বী মুমূর্ষু বৃদ্ধ এই আচারের মধ্যে দিয়ে ইহকালের যাত্রা শেষ করেন, এবং তা স্বেচ্ছায়। বিনয়া মাত্র তিন বছর বয়সে তা করে কনিষ্ঠতম ‘সান্তারা’ হিসেবে বিশ্বরেকর্ড গড়েছে। বলা ভালো, তাকে দিয়ে রেকর্ড গড়ানো হয়েছে। খাবার পেলে বিনয়া কি আরও দুটো দিন বাঁচত না!
প্রশ্ন উঠতে পারে, সান্তারা কি আইনত বৈধ! শিশুর অধিকার সুরক্ষার আইন কি জৈন ধর্মবিশ্বাসী পরিবারের শিশুদের ক্ষেত্রে খাটে না? ২০১৫ সালে রাজস্থান হাইকোর্ট সান্তারাকে অবৈধ এবং দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করে। কোর্টের যুক্তি ছিল– সান্তারা কোনও জরুরি ধর্মীয় আচার নয় এবং আর্টিকেল ২১ জীবনের অধিকার সুরক্ষিত করে, মৃত্যুর অধিকার নয়। কিন্তু জৈন ধর্মাবলম্বীদের আবেদনের ভিত্তিতে সান্তারাকে ধর্মীয় ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট এই রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ দেয়। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে বিচারব্যবস্থা বরাবরই ধর্মের পক্ষপাত করে এসেছে। বলতে দ্বিধা নেই, আজও ‘তেমনি বহে ধারা’। কিন্তু বাকি থেকে যায় আরও কয়েকটা প্রশ্ন। তথাকথিত শিক্ষিত, তথ্য-প্রযুক্তি কর্মী এই মা-বাবা আজও এতটাই সংস্কারাচ্ছন্ন! আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কি তাহলে যুক্তিবাদী চিন্তাভাবনার পাঠ দিতে ব্যর্থ? পরিবার বা সমাজ কি মানবিকতার বোধ গড়ে দিতে অপারগ! হয়তো তাই। না হলে অসহায় বিনয়াকে প্রাণের বিনিময়ে রেকর্ড গড়তে হত না! আর আত্মজার সেই রেকর্ডের সার্টিফিকেট হাতে গর্বিত মা-বাবার ছবিও ছাপা হত না কোনও কাগজে।
একটা চিঠি পড়ে শোনাই। ইংল্যান্ডের বাকিংহামশায়ারের জিওফ্রে হোয়েলির লেখা খোলা চিঠি, ব্রিটিশ পার্লামান্টের এমপি-দের উদ্দেশে:
‘‘আপনারা যখন এই চিঠি পড়বেন, আমি তখন মৃত। ২০১৯ এর ৭ ফেব্রুয়ারি আমি আমার স্ত্রী অ্যান, সন্তান দোমিনিক আর অ্যালিক্স আর দু’-একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে সামনে রেখে সুইজারল্যান্ডের ডিগনিটাস ফেসিলিটি ক্লিনিকে সেই ওষুধ খাব, যা আমাকে এই জীবন থেকে চিরকালের জন্যে মুক্তি দেবে। সকলের ভালোবাসা আর সহযোগিতায় আমি আমার লক্ষ্য পূরণ করতে পেরেছি। মোটর নিউরোন অসুখের অবর্ণনীয় যন্ত্রণার থেকে নিজের জীবনের শেষ মুহূর্তটাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছি।’’
জিওফ্রের এই চিঠি অনেক বিতর্ক উসকে দিয়েছে। বিশেষ করে ইউরোপীয় দেশগুলোতে মৃত্যুর অধিকারকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে জোরালো সওয়াল তুলতে সমাজকর্মীদের সাহস জুগিয়েছে। জিওফ্রে আসলে যে প্রক্রিয়ায় নিজের মৃত্যুকে নিজে নির্ধারণ করেছেন, নিয়ন্ত্রণ করেছেন, তার পোশাকি নাম ‘সুইসাইড ট্যুরিজম’। অর্থাৎ কিনা নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে গিয়ে, বিশেষরকম পেশাদারি সহায়তায় জীবনের ইতি টানা। পাশে থাকবেন ডাক্তার, কিছু প্রিয়জন, পরিবেশটি হবে নিজের কল্পনার রঙে সাজানো। নিজের স্থির করে দেওয়া সময়ে তাঁর ওপর প্রয়োগ করা হবে বিশেষ কোনও ওষুধ এবং তিনি চলে যাবেন এ জীবনের পথ পার করে।
১৯৯৯ সালে ‘সুইসাইড ট্যুরিজম’ শব্দটি প্রথম চালু করেন জুরিখের অ্যাটর্নি জেনারেল। পৃথিবীর খুব কম দেশেই স্বেচ্ছামৃত্যু বা ইউথেনেশিয়া আইনি বৈধতা পেয়েছে। যে সমস্ত মানুষ আরোগ্যহীন রোগে আক্রান্ত এবং দুঃসহ যন্ত্রণায় মৃত্যুর অপেক্ষায় বেঁচে থাকেন, তাঁদের হয়তো মৃত্যুর অধিকার দাবি করাটা সংগত। ২০১৮-১৯-এ ফ্রান্স, স্পেন এবং ইংল্যান্ডে করা জনসমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ৯৬ শতাংশ মানুষই মৃত্যুর অধিকারের আইনি স্বীকৃতি চাইছেন। কিন্তু সেই অধিকারকে আইনি স্বীকৃতি দিতে রাষ্ট্র ভয় পায়। হয়তো আইনের অপব্যবহারের আশঙ্কায়। আছে নৈতিকতার পিছুটানও। তবে এ ব্যাপারে সুইজারল্যান্ডের আইনব্যবস্থা বেশ আলগা। তাই সে দেশে গজিয়ে উঠেছে বেশ কিছু পেশাদারি সংস্থা যারা মৃত্যুমুখাপেক্ষী মানুষদের চিরবিদায়ে সহায়তা করেন। অবশ্য মানুষটিকে বেশ লম্বা যাচাই পর্ব পার করে তবেই মৃত্যু-সহায়তা প্রাপ্তির যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। আত্মহত্যা-সহায়ক সংস্থা হিসেবে ‘এক্সিট’, ‘এক্সিন্টারন্যশনাল’, ‘ডিগনিটাস’, ‘লাইফ সার্কেল’ এবং ‘পেগাসাস’– এই নামগুলো প্রথম সারিতে আসে। ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘ডিগনিটাস’ই সুইজারল্যান্ডের সবচেয়ে আলোচিত সংস্থা। পরিসংখ্যান বলছে জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন এবং কানাডা থেকে সুইজারল্যান্ড-মুখী সুইসাইড ট্যুরিস্টের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। তার চেয়ে দ্রুত গতিতে বাড়ছে এই সব সংস্থার সদস্য সংখ্যা। সমাজতাত্ত্বিকরা একে সমগ্র ইউরোপ এবং পশ্চিমি দেশগুলো, মূলত কানাডায় ‘মৃত্যুর অধিকার’ আন্দোলনের জের বলে ব্যাখ্যা করতে চান। এই সব সংস্থায় সদস্য-চাঁদার অঙ্কটি কম নয়। বার্ষিক গড়ে ৪৫ থেকে ৮০ সুইস ফ্রাঙ্ক, আর আজীবন সদস্য হলে ১০০০ সুইস ফ্রাঙ্ক। মৃত্যু সহায়তার খরচ পড়ে সংস্থা ভেদে ৬৫০০ থেকে ১৫০০০ সুইস ফ্রাঙ্ক। ২০১৭ সালের পরিসংখ্যান বলছে সুইসাইড ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রির বার্ষিক ব্যবসায়িক মূল্য ৫১ মিলিয়ন ইউরো। ‘শেষ পারানির কড়ি’-টুকুও তবে বিশ্ববাজারে বিকিয়ে গেল!
জীবন তো যাপনের জন্য। তার থেকে পালিয়ে যাওয়া, সে তো হেরে যাওয়া। এমন সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে যেতে কি মন চায়! ‘এমন মানবজনম আর পাবে না, বারে বারে আর আসা হবে না, বারে বারে আর আসা হবে না রে মন’। তাই যা অনিশ্চিত তাকে নিশ্চিত করার দায় না-ই বা নিলাম কাঁধে! মৃত্যু নিয়ে রোম্যান্টিসিজম চলতেই থাকবে; সাহিত্যে, বাস্তবে। জীবনানন্দ দাশের মতো কবিরা হয়তো বারে বারে মৃত্যুর অনুষঙ্গ টেনে আনবেন। ‘কোথায় রয়েছে মৃত্যু, কোন দিকে? খুঁজি আমি তারে’ কিংবা ‘যেই ঘুম ভাঙে নাকো কোনদিন, ঘুমাতে ঘুমাতে, সবচেয়ে সুখ আর শান্তি আছে তাতে’। এমন বিষণ্ণতার প্রকাশ তাঁর ছত্রে ছত্রে। জীবনানন্দ! যাঁর নামেই মিশে আছে আনন্দময় জীবনের আভাস তিনিই এত বিষাদবিলাসী! কলকাতার বুকে ট্রামে কাটা পড়ার একমাত্র ইতিহাস যিনি গড়ে যান, তাঁর মৃত্যুকে সুইসাইড বলেই মনে করেন অনেকে। আর যে মানুষটি জীবনভর মৃত্যুমিছিল দেখে এসেছেন তিনিই বলতে পারেন ‘মরণ রে, তুঁহু মম শ্যামসমান’। আজকের নিরাশাক্রান্ত সময়ে দাঁড়িয়ে রবি ঠাকুরের কথাই হয়ে উঠুক সব জীবনের সহজপাঠ– ‘আকাশ তবু সুনীল থাকে/ মধুর ঠেকে ভোরের আলো/ মরণ এলে হঠাৎ দেখি/ মরার চেয়ে বাঁচাই ভালো’।
ভবিষ্য-পুরাণের শ্লোক থেকে বোঝা যায়, আধুনিক কুম্ভমেলার জন-সমাগমের ভিত্তি তৈরি হয়েছে এইসব সময় থেকেই। তবে এখানে মনে রাখতে হবে– ভবিষ্য-পুরাণের অনেক অংশই এই সেদিন লেখা হয়েছে, এতটাই সেদিন যে, এখানে ওয়ারেন হেস্টিংস থেকে ইলায়জা ইম্পে এমনকী কুইন ভিক্টোরিয়ারও বর্ণনা আছে!