২৬ বছরের শিক্ষিত মেয়ে স্মৃতি সিং, কেন তার বিয়ের ব্যবস্থা করা হবে দেওরের সঙ্গে, তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে? শ্বশুর রবি প্রতাপ যা বলেছেন, সেটাকে ‘চাপিয়ে দেওয়া’ বলে। এককালে সতীদাহ হত সে-কারণেই। সদ্য বিধবা নারীকে স্বামীর চিতায় সহমরণ বা আত্মাহুতি দিতে বাধ্য করা হত। তেমনই বড় ছেলে মারা গিয়েছে যখন পটাপট ছোট ছেলেকে বিয়ে করে ফেলো– সেই প্রস্তাবে আদৌ সেই মেয়েটির সম্মতি আছে কি না, তা জানার চেষ্টা না করাও আরেক অমানবিক প্রথা, নারীবিদ্বেষের আরেক রূপ।
এ এক অদ্ভুত সময় এসেছে। এই হয়তো কাউকে মাথায় তুলে নাচছে, তো এই আছড়ে ফেলছে নিমেষে। সামাজিক মাধ্যমের ভাষায় যা ‘ট্রোলিং’। ট্রোলিং একধরনের ‘ডিজিটাল’ নৃশংসতা, যা একজন ব্যক্তির সামাজিক সম্মানকে তছনছ করে অন্য মানুষ আনন্দ পায়। যা খুশি বলে দেওয়া যায়, কারও মুখোমুখি হতে হয় না বলে চক্ষুলজ্জার বালাই নেই। ‘সেডিস্টিক প্লেজার’। গণহিংসা বলা যেতে পারে। ডিজিটাল মাধ্যমে আমরা যতই জড়িয়ে পড়ছি, এই প্রবণতা ততই ছড়িয়ে পড়ছে। গায়ক থেকে নায়ক, কবি থেকে বিচারপতি, শিক্ষক, নেতা, মন্ত্রী– ট্রোলিং-এর খপ্পর থেকে কারও নিস্তার নেই। প্রতিদিন কেউ না কেউ ট্রোলিংয়ের দহনে পুড়ে চলেছে আর তাই দেখে হাততালি দিচ্ছে সমবেত জনতা। ট্রোলিং একটা অসুখ। প্রতিবাদের নামে অপমান, উপহাস, ঘৃণা উগরে দেওয়া। প্রতিবাদ আর টিটকিরি গুলিয়ে ফেলছে কিছু অপোগণ্ডর দল।
সম্প্রতি মরণোত্তর কীর্তি চক্রে সম্মানিত করা হয় শহিদ ক্যাপ্টেন অংশুমান সিং-কে। প্রয়াত স্বামীর হয়ে এই সম্মান রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর হাত থেকে গ্রহণ করেন স্ত্রী স্মৃতি সিং। ক্যাপ্টেন অংশুমানের বাবা-মা অভিযোগ করেন, ছেলের বিধবা স্ত্রী আর তাঁদের সঙ্গে থাকেন না। কর্তব্যরত অবস্থায় ছেলের মৃত্যুর পর সেনার তরফ থেকে যে আর্থিক সাহায্য দেওয়া হচ্ছে, তা পাচ্ছেন স্মৃতি। আক্ষেপের সুরে অংশুমানের বাবা-মায়ের অনুযোগ, তাঁদের কাছে শুধু ছেলের মালা ঝোলানো ছবিটাই রয়ে গিয়েছে। পুত্রবধূর বিরুদ্ধে তাঁদের আরও অভিযোগ, যাওয়ার সময় ছেলের কীর্তি চক্র পদক, তাঁর পোশাক, যাবতীয় নথি নিজের সঙ্গে নিয়ে গিয়েছেন স্মৃতি। এরপরই এই সংক্রান্ত বিতর্ক শুরু হয় সমাজ মাধ্যমে। স্মৃতির একটি ভিডিও সম্প্রতি ‘ভাইরাল’ হয়। সেখানে তিনি যখন প্রয়াত স্বামীর স্মৃতিচারণায় আবেগপ্রবণ, তখন তাঁকে উদ্দেশ্য করে অশালীন মন্তব্য করে জনৈক নেটিজেন। যা নিয়ে ফুঁসে উঠেছিল জাতীয় মহিলা কমিশন। নড়েচড়ে বসে দিল্লি পুলিশ। জনৈক ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগও দায়ের করা হয়েছে।
……………………………………………………………………………………….
পড়ুন রিংকা চক্রবর্তী-র লেখা: মহাপুরুষরা কি ভারত জুড়ে সংখ্যায় বাড়ছে?
……………………………………………………………………………………….
ওদিকে ঘটেছে আরেক কাণ্ড! একজন মহিলাকে ক্যাপ্টেন অংশুমান সিংয়ের স্ত্রী ভেবে ট্রোল করা হয়। এই মহিলার নাম রেশমা সেবাস্টিয়ান। গালমন্দ থেকে অভিশাপ– কিছুই বাদ যায়নি! রেশমা সিবাস্টিয়ান একজন বিখ্যাত ফ্যাশন ইনফ্লুয়েন্সার। স্মৃতি সিং এবং রেশমা সেবাস্টিয়ানের চেহারায় মিলের কারণে অনাকাঙ্ক্ষিত ট্রোলিংয়ের সম্মুখীন হতে হয় রেশমাকে। ট্রোলারদের অবশ্য উপযুক্ত জবাব দিতে ছাড়েননি এই বিখ্যাত ফ্যাশন ইনফ্লুয়েন্সার।
কিন্তু যাঁদের আলটপকা মন্তব্যর জন্য স্মৃতি সিং-কে সমাজ মাধ্যমে হেনস্তা হতে হল, সেই অংশুমানের বাবা-মায়েরও বক্তব্য কতটা যুক্তিসংগত? বিয়ের মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় ২০২৩ সালে সিয়াচেনে অগ্নিকাণ্ড থেকে সহকর্মীদের বাঁচাতে গিয়ে শহিদ হয়েছিলেন ক্যাপ্টেন অংশুমান সিং। অংশুমানের অবর্তমানে সব কিছুতে স্ত্রীর অধিকার নিয়েই যাবতীয় বিতর্ক। অংশুমানের বাবা-মা চান ‘NOK’– অর্থাৎ ‘নেক্সট অফ কিন’ আইনের পুনর্মূল্যায়ন করা হোক। সেনার বর্তমান আইন অনুযায়ী, অবিবাহিত কোনও সেনার পরিজন বলতে বাবা-মাকে বোঝায়। কিন্তু বিয়ের পরে পরিজন বলতে বোঝায় জীবনসঙ্গীকে। আইন অনুযায়ী, অংশুমানের মৃত্যুর পর তাঁর জিনিসপত্র, পেনশন প্রাপ্য তাঁর স্ত্রীর। আর এখানেই আপত্তি অংশুমানের বাবা-মায়ের। যে ছেলের বিধবা বউ শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে থাকে না, সে কেন পাবে সম্মান-পদক, টাকাপয়সা? ঘরের ছেলে বেঁচে না থাক, তার টাকা অন্তত ‘ঘরছাড়া’ না হোক। আরও বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন অংশুমানের বাবা রবি প্রতাপ সিং। তাঁর দাবি– স্মৃতি অংশুমানের ছোট ভাইকে বিয়ে করে আগের মতোই তাঁদের পুত্রবধূ হিসেবে থাকুক। বিয়ের পর অংশুমানের ছোট ভাই আর স্মৃতির পুত্রসন্তান হলে তার বাবার নামের জায়গায় অংশুমানের নাম লেখা হবে! প্রথমত তাঁরা ‘আশা’ করছেন পুত্র সন্তানের। কী পরিমাণ লিঙ্গবৈষম্য! দ্বিতীয়ত, এমন প্রস্তাব দিতে কেমন করে পারেন তাঁরা! রবি প্রতাপ বলেছিলেন, তিনি তাঁর পুত্রবধূকে বিয়ে করার কথা যখন বলেন, তখন স্মৃতি বলেন তাঁর বয়স মাত্র ২৬ বছর। তাঁর গোটা জীবনটা পড়ে রয়েছে। তিনি নিজেকে সময় দিতে চান। যত্ন নিতে চান নিজের। একটা মেয়ে, যে দাম্পত্যের সুখ অনুভব করতে পারল না, এক ঝটকায় সবটা শেষ হয়ে গেল, খোয়াতে হল স্বামীকে– ভালোবাসার মানুষকে হারানোর মতো যন্ত্রণা আর কী হতে পারে! কই কেউ তো তখন বুঝল না কী করে সামলাবে সে নিজেকে? সমস্ত ক্ষত সারিয়ে নিজের মতো বাঁচতে চাওয়া অপরাধ? এতটা ঝড় সামলে যদি সে ঘুরে দাঁড়িয়ে জীবনটাকে আবার নতুন করে সাজিয়ে নিতে চায়, তাতেই বা কী সমস্যা?
স্মৃৃতি যা পেয়েছেন, তা তিনি আইনত পেয়েছেন। কৌশলে হাতিয়ে নেননি! ২৬ বছরের ওইটুকু মেয়ে, শিক্ষিত মেয়ে, কেন একটু একটু করে গুছিয়ে নেওয়ার সময় আবার জীবনটা ঘেঁটে দেবে? বিয়েটাই কি জীবনে সব? কী এমন মোক্ষলাভ হয় তাতে? যে যাওয়ার সে তো চলেই গিয়েছে, যে আছে সে তো বাঁচুক নিজের মতো! রবি প্রতাপ যা বলেছেন, সেটাকে ‘চাপিয়ে দেওয়া’ বলে। এককালে সতীদাহ হত সে-কারণেই। সদ্য বিধবা নারীকে স্বামীর চিতায় সহমরণ বা আত্মাহুতি দিতে বাধ্য করা হত। তেমনই বড় ছেলে মারা গিয়েছে যখন পটাপট ছোট ছেলেকে বিয়ে করে ফেলো– সেই প্রস্তাবে আদৌ সেই মেয়েটির সম্মতি আছে কি না, তা জানার চেষ্টা না করাও আরেক অমানবিক প্রথা। বিধবা বিবাহ এবং ডিভোর্সের পর পুনর্বিবাহ সবসময়ই স্বাগত। এই নিয়ে তৈরি হয়েছে চমৎকার সব বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন। যেখানে দেখা গিয়েছে শাশুড়ি তাঁর বউমাকে আগলে রেখেছেন নিজের সন্তানের মতো। এমনকী বউমাটির পছন্দের পাত্রর সঙ্গে বিয়ে দিতেও প্রস্তুত। ঠিক একইভাবে স্বামীকে হারানো শাশুড়ি মায়ের নতুন করে জীবনসঙ্গী খুঁজে নেওয়াকে খুশিমনে মেনে নিয়েছেন বউমা থেকে শুরু করে পরিবারের সকলে– এমন বিজ্ঞাপনও কিন্তু আমাদের মন ছুঁয়ে যায়। মূল বিষয় হল ‘কনসেন্ট’। শুধুমাত্র বিয়ে নয়, যে কোনও ক্ষেত্রে একজন আরেকজনের ব্যাপারে এমনি এমনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে পারে না। স্বামী স্ত্রীয়ের হয়ে, বাবা মায়ের হয়ে, বড়রা ছোটদের হয়ে পারে না। আপনার সামনের মানুষটা একটা আলাদা ব্যক্তিমানুষ। তার চিন্তাধারা, মূল্যবোধ আলাদা। তার বেড়ে ওঠার পরিবেশ আলাদা। আপনি পারেন না তার হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে। আপনি ঠিক করে দেবেন না পার্টিতে আপনার পার্টনার হার্ড ড্রিংকস নেবেন, না সফ্ট! আপনি আপনার সন্তানকে আজীবন কচি খোকা বা খুকি ভেবে ঠিক করে দেবেন না সে কী পড়াশোনা করবে, গান শিখবে না নাচ, আবৃত্তি না আঁকা, কী খাবে, কিংবা কী পেশা সে বেছে নেবে কর্মজীবনে। আপনি অভিভাবক হিসাবে তাকে ‘গাইড’ করতে পারেন। কিন্তু আপনার মতামত চাপিয়ে দিতে পারেন না। ঠিক একইভাবে জীবনসঙ্গী নির্বাচনের সিদ্ধান্ত একান্ত আপনার সন্তানের। সে সমকামী না বিষম, সেটাও তার একেবারে ব্যক্তিগত বিষয়। একজন সমকামী মানুষকে ‘সুস্থ’ করার প্রচেষ্টা আপনারই অসুস্থতার লক্ষণ। আপনি বাঁচুন অন্যকেও ভালোভাবে বাঁচতে দিন। দয়া করে অন্যের ব্যাপারে নাক গলাবেন না।