বিবিসি জানাচ্ছে, ২০১০ সাল থেকেই পাশ্চাত্য বাজারে এই ধরনের মহিলাদের প্রকাশ্যে বলতে শোনা যাচ্ছে যে তাঁরা কেরিয়ারে নিরুৎসাহী। কেরিয়ারের তুলনায় পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে নির্জন দ্বীপে ছুটি কাটানো, স্বামীর সেবায় দিনরাত নানা রকম নতুন নতুন রান্নার রেসিপি তৈরি করা বা পুরুষের নিখাদ সাহচর্যের উপভোগ প্রকাশ্যে এনে চল্লিশ লক্ষেরও বেশি অনুগামীবৃন্দ তৈরি করতে পেরেছেন। অর্থাৎ, পুঁজিবাদের তৈরি নারী স্বাধীনতার চরিত্রই এখন রমরম করছে, আবারও পুরুষতন্ত্রই নিয়ন্ত্রক মহিলাদের সামাজিক ও ব্যক্তিগত চরিত্র নির্মাণে।
সম্প্রতি একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, সোশ্যাল মিডিয়া সাইটে মহিলা ইনফ্লুয়েন্সারদের আয় তুলনামূলক ভাবে পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি। এমনিতে সারা পৃথিবীতে এখনও লিঙ্গবৈষম্যের জেরে মহিলা ও পুরুষের কর্মক্ষেত্রে মজুরি সমান নয়। বিশেষত, অসংগঠিত ক্ষেত্রে এই ফারাকটি চোখে পড়ার মতো। ভারত-সহ দক্ষিণ এশীয় দেশগুলিতে অসংগঠিত কর্মক্ষেত্রে মহিলারা পুরুষের অনুপাতে অনেক কম মজুরিতে একই পরিমাণ শ্রম দিয়ে থাকেন।
কিন্তু মজার বিষয় হল, সোশ্যাল মিডিয়া সাইটে দেখা যাচ্ছে, অসংগঠিত শ্রমক্ষেত্র হলেও উল্টো ছবি।
‘ডিজিটাল গ্লোবাল ওভারভিউ’ রিপোর্টে বলছে, ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম এবং ইউটিউবে ভারতের ইউজার র্যাংকিং সবচেয়ে বেশি। গত এক বছরে ১.৩ কোটি লোক শুধু মাত্র ভারত থেকে উপরোক্ত তিনটি গণমাধ্যমে যুক্ত হয়েছে। তার মধ্যে ৩৭.৮ শতাংশ শহরবাসী এবং ৬২.৯ শতাংশ গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী ভারতীয় নাগরিক। এর মধ্যে ৪৮ শতাংশ ব্যবহারকারী হলেন মহিলা এবং ৫২ শতাংশ পুরুষ। সেই রিপোর্টে স্পষ্ট উল্লেখ করা হচ্ছে, উল্লেখিত গণমাধ্যমগুলিতে ব্যবহারকারীদের মধ্যে সর্বাধিক সংখ্যকের বয়স ২৫-৩৪ বছরের মধ্যে। ১৮ বছর থেকে ৪৪ বছরের মধ্যে থাকা ব্যবহারকারীরা নিয়মিত এই মিডিয়ায় সচল। ৫-১২ বছরের মধ্যে থাকে শিশুদের সংখ্যা মোটের ১৩ শতাংশ। তুলনায় বেশ কম ব্যবহারকারীরা হলেন ৬০ বছরের বেশি যাঁদের বয়স।
…………………………….
বিবিসির একটি রিপোর্ট দেখিয়েছে যে বছর পঁচিশের এক মহিলা মুদি দোকানের ম্যানেজারির কাজ ছেড়ে দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় নিয়মিত পোস্ট করে সেখান থেকে অনুগামী সংখ্যা বাড়াতে বাড়াতে এমন উচ্চতায় পৌঁছেছেন যে নিয়মিত বিভিন্ন প্রসাধনী অর্থাৎ কসমেটিক ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপন মারফত আয় করে নিচ্ছেন হাজার হাজার ইউরো। পাশ্চাত্য দুনিয়ায় এই ধরনের কাজ করা মহিলারা চিহ্নিত হয়েছেন ‘সফট গার্ল’ বা ‘ট্রেড-ওয়াইফ’ অথবা ‘গার্লি-গার্ল’ নামে।
……………………………..
ইউরোপের দেশগুলিতে বিশেষত সুইডেনে, যেখানে কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্যের মহিলা-পুরুষের মধ্যে সবচেয়ে কম, সেখানে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসের সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, মহিলারা কর্মক্ষেত্রে যোগদানের তুলনায় নিয়মিত সোশ্যাল মিডিয়াকেই বেছে নিয়েছেন রোজগারের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে। বিবিসির একটি রিপোর্ট দেখিয়েছে যে, বছর পঁচিশের এক মহিলা মুদি দোকানের ম্যানেজারির কাজ ছেড়ে দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় নিয়মিত পোস্ট করে সেখান থেকে অনুগামী সংখ্যা বাড়াতে বাড়াতে এমন উচ্চতায় পৌঁছেছেন যে, নিয়মিত বিভিন্ন প্রসাধনী অর্থাৎ কসমেটিক ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপন মারফত আয় করে নিচ্ছেন হাজার হাজার ইউরো। পাশ্চাত্য দুনিয়ায় এই ধরনের কাজ করা মহিলারা চিহ্নিত হয়েছেন ‘সফট গার্ল’ বা ‘ট্রেড-ওয়াইফ’ অথবা ‘গার্লি-গার্ল’ নামে। অর্থাৎ, নারীত্বের কোমলতাই যেখানে বাজারের বিক্রয়জাত দ্রব্য। পুরুষের কাছে সমর্পণে খেদহীন মহিলাদের আবেদন সোশ্যাল মিডিয়া সাইটে এমনই সাড়া ফেলেছে যে, তাঁদের দিয়ে তৈরি হচ্ছে বিজ্ঞাপন দুনিয়ার নতুন বাজার। বিবিসি জানাচ্ছে, ২০১০ সাল থেকেই পাশ্চাত্য বাজারে এই ধরনের মহিলাদের প্রকাশ্যে বলতে শোনা যাচ্ছে যে, তাঁরা কেরিয়ারে নিরুৎসাহী। কেরিয়ারের তুলনায় পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে নির্জন দ্বীপে ছুটি কাটানো, স্বামীর সেবায় দিনরাত নানা রকম নতুন নতুন রান্নার রেসিপি তৈরি করা বা পুরুষের নিখাদ সাহচর্যের উপভোগ প্রকাশ্যে এনে ৪০ লক্ষেরও বেশি অনুগামীবৃন্দ তৈরি করতে পেরেছেন। অর্থাৎ, পুঁজিবাদের তৈরি নারী স্বাধীনতার চরিত্রই এখন রমরম করছে, আবারও পুরুষতন্ত্রই নিয়ন্ত্রক মহিলাদের সামাজিক ও ব্যক্তিগত চরিত্র নির্মাণে। দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্বজুড়ে নারীবাদীরা পুঁজিবাদ সৃষ্ট, পিতৃতন্ত্র সৃষ্ট ‘নারীবাদ’-এর বিরোধিতা করে চলেছেন। কিন্তু ‘সফট গার্ল’ ট্রেন্ড যেহেতু হাতে কাঁচা পয়সা এনে দিচ্ছে, তাই সহজেই এই ফাঁদে পা দিচ্ছেন মহিলারা।
ফেসবুক তার ওয়েব পেজে লিখছে, রিল জনপ্রিয় হলে সেই রিলের সঙ্গে বিজ্ঞাপন জুড়ে দেওয়ার সুবিধে থাকবে। যার সুবিধা পাবেন ব্যবহারকারী। এই সূত্রে যিনি রিল বানাচ্ছেন এবং শেয়ার করছেন, তাঁরা আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারবেন। এর ফলে অনেক সময়ই লক্ষ করলে দেখা যাবে যে, এই ভিডিওগুলিতে যারা প্রকাশ্যে নিজেদের জীবন, স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য, বা প্রসাধন-সংক্রান্ত বিষয়ে কথা বলতে চাইছেন, তাঁদের একটা বড় অংশ শ্রেণিপরিচয়ে সমাজের থাকবন্দি ব্যবস্থার মধ্য বা নিম্ন মধ্যস্তরে রয়েছে। অর্থাৎ, মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের উপস্থিতি সেখানে বেশ প্রকট। এবং এই নিয়ে কারও বিশেষ লুকোছাপা নেই, কারণ মিডিয়া কনটেন্টের মধ্যে প্রকট ভাবে নিহিত আছে আস্পিরেশন বা সমাজ-অর্থনীতির কাঠামোয় তুলনামূলকভাবে নীচে থাকা মানুষের ঊর্ধগামী হওয়ার শখ ও প্রত্যাশা।
এই পরিসংখ্যান পাওয়ার পরে প্রাথমিক ভাবে দু’টি প্রশ্ন উঠতে পারে? এক, এদেশে মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষে রিল বানিয়ে উপার্জন করার রাস্তা খুঁজছেন কেন? এমনটা হতেই পারে যে, করোনা অতিমারী ও লকডাউনের সময় থেকে এদেশে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত অর্থাৎ খেটে খাওয়া মানুষের কাজের সুবিধে কমে যাওয়া, বাজারদর বেড়ে যাওয়া এবং চাকরি বা কাজ চলে যাওয়ার মতো যেসব বেদনাদায়ক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে রিল উৎপাদনের মাধ্যমে সহজে অর্থলাভের উপায় খুঁজছে মানুষ। বেকারত্বের জ্বালায় পুড়ে যাওয়ার আগে তরুণ-তরুণীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বানাচ্ছেন রিল। স্বপ্ন দেখছেন, লক্ষপতি হওয়ার। শিকে ছিঁড়ছে লাখে একটির। কিন্তু সেই আশায় কোটি কোটি মানুষ নিয়মিত সামাজিক মাধ্যমে সচল থেকে বাঁচিয়ে রাখছেন বিজ্ঞাপনের দুনিয়াকে। একইসঙ্গে বলতে হবে যে, সমাজের উচ্চবিত্ত স্তরের মানুষেরা যেভাবে ‘লাইফস্টাইল’ রিল ও ভ্লগ বানাচ্ছে, তাতে সুখের এক অবাস্তব ধারণা তৈরি হচ্ছে। খুবই পরিকল্পিতভাবে তৈরি করা হচ্ছে এমন এক স্বপ্ন, যা অসম্ভব, যা প্রকৃতিবিরুদ্ধ, যা ছোঁয়া সম্ভব নয়। সেই আকাঙ্ক্ষা ছোঁয়াই সাধারণ মানুষের লক্ষ্য এখন।
দ্বিতীয় প্রশ্ন উঠতে পারে, মহিলা শরীর বা শরীরী আবেদন, গৃহকর্ম নিপুণতা, মেয়েলিপনা প্রকট করা বা ব্যক্তিজীবন প্রকাশ্যে আনার মধ্যে যে আপাত নারীমুক্তি সুলভ ভান রয়েছে, তা কোথাও পিতৃতান্ত্রিক সামাজিক কাঠামোটিকে আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করে ফেলছে কি না? কারণ, সফট গার্ল হয়ে ওঠার বিষয়বস্তু ‘পুরুষ যা চায়’ তার প্রতি লক্ষ্য রেখেই রিলের মূল কন্টেট তৈরি করা।
একটি সহজ উদাহরণ এই সূত্রে দেওয়া যেতে পারে হল, ‘ঘরোয়াপনা’। সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন তরুণী বা মহিলারাও জনপ্রিয়তা পাচ্ছেন, যাঁরা ঘরোয়া কাজের নৈপুণ্য , শাড়ি পরার কায়দা দেখানো, ঘরোয়া টিপস দেওয়া অথবা নানাবিধ ধর্মীয় আচারে নিয়মনিষ্ঠা বিষয়ে কথা বলছেন। তাঁদের ঘরোয়াপনা বিক্রয়জাত সামগ্রীতে পরিণত হচ্ছে রিলের দুনিয়ায়। তাঁরা অনেক সময়েই ঘরোয়া ভাবের মধ্যেই তুলে ধরছেন ব্যক্তিজীবনের সাধ আহ্লাদ বা অভিজ্ঞতার কথা, যা সহজে প্রকাশ্যে না-বলাই দস্তুর। কখনও প্রকাশ্যে উঠে আসছে যৌন ইঙ্গিতের ছোঁয়া। দেখানো হচ্ছে, বুকের খাঁজ বা ঈষৎ উন্মুক্ত শরীরের অংশ, যৌন উত্তেজক ফ্রেম। পাঠক নিশ্চয়ই গুলিয়ে ফেলবেন না যে, কেন সমালোচনার চোখে দেখা হচ্ছে, মহিলাদের শরীর মেলে ধরা রিলের পর্দায়। কারণ মহিলা যদি সত্যি নিজের ইচ্ছে ও মত অনুযায়ী নিজের ব্যক্তিগত জীবনের প্রসঙ্গ ভাগ করে নিতে উৎসাহী হয়, তাতে কিছু বলার থাকে না। সেটিও ব্যক্তি-স্বাধীনতাকে জীবনে লাগু করার দিকে একধাপ এগিয়ে যাবে বলেই মনে করা উচিত।
কিন্তু সমস্যা থাকবে, যদি রিল উৎপাদনকারী মহিলাটি বাধ্য হন কোনও কারণে, তাহলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্নটি এসে পড়বে। আপত্তি উঠতেই পারে, যদি কেউ অজ্ঞাতসারে এমন কনটেন্ট উৎপাদন করে, যা অন্যের ভাষা, ধর্ম, বর্ণ বা দেহ সৌষ্ঠবের তারতম্য নিয়ে কথা বলতে থাকেন। যদি বিশেষ কোনও জনজাতি তাঁদের অজ্ঞাতে রিলের কনটেন্টে পরিণত হন। সমস্যা এখানে যে নারী শরীরকে পণ্য করে যেখানে বাজার ফুলেফেঁপে ওঠে, সেখানে রিলে শরীর দেখানো পণ্যায়ন না স্বাধীনতা?
রিলে যেভাবে গৃহকর্মে নিপুণা, ধর্মভাবে প্রবল বিশ্বাসী, স্বামীসেবার যে ‘অবাস্তব’ স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে, তা অন্য মহিলার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং তা গৃহ-হিংসার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কারণ সমাজে ‘ঘরোয়া’ হতে শেখার পাঠ মেয়েদের সবচেয়ে বেশি দেওয়া হয়। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে ‘ঘরোয়া’ হতে না পারার জন্য বহু নববধূকে নিপীড়ন সহ্য করতে হয়। ‘ঘরোয়াপনা’ বলতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মেয়েদের স্বকীয়তা, বা তাঁর চারিত্রিক গুণাবলিকে দেখা হয় না। বরং, মেয়েদের ব্যক্তি স্বাধীনতার ইচ্ছে, চারিত্রিক দৃঢ়তা বা বাইরে বেরিয়ে চাকরি করার ইচ্ছে ঘরোয়া না-হওয়ার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তার ফলে ‘ঘরোয়া’ হওয়ার যে মিথ থেকে যায় পুরুষের মনে, সমাজের শিরায় শিরায় তাঁকে বাস্তবে বিনা অভিযোগে ছুঁতে পারার ক্ষমতা কোনও মেয়েরই থাকে না।
সুতরাং বলা যায়, ‘সফট গার্ল’ কনটেন্ট উপার্জনের পথ কারও কারও জীবনে কিছুটা সুগম করলেও তা যে কখনওই নারী স্বাধীনতার পথ সুগম করবে না। বরং আরও প্রতিষ্ঠিত হবে পুরুষতন্ত্র ও পুঁজিবাদ।