অন্বিতার সুইসাইড নোট প্রশ্ন তুলে দেয় ঢাক বাজানো গালভরা শব্দ ‘নারী ক্ষমতায়ন’-এর। মুক্তি নেই বাচ্চা দেখার দায়িত্ব থেকে, মুক্তি নেই বাড়ির বয়স্কদের দেখার দায়িত্ব থেকে, মুক্তি নেই একটা সংসারকে সোহাগে ভরিয়ে রাখার থেকে, মুক্তি নেই ‘সংসার’ নামক প্রকাণ্ড খিদের থেকে, তারপর রয়েছে বাইরের চাপ, কর্মক্ষেত্রের চাপ, রাস্তাঘাটের আতঙ্ক। ঘরে ও বাইরে মেয়েরা শুধু নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই করে যাচ্ছে। মাস ফুরলে মাইনে তোলে স্বামী। অনেক নারীকে চিনি যাঁরা শুধুই চাকরিটুকু করেন, কিন্তু এটিএম থাকে স্বামীর কাছে।
শোষণের ডায়েরি ১
‘সারাদিন কী করিস, ওই *** স্কুলটা ছাড়া!’– আমার প্রাক্তনের বলা এই কথাটি যেন বারবার কানে বাজছে অন্বিতা শর্মার খবরটি পড়ে। অস্টেরিস্ক-এ ঢাকা শব্দটি নারীমাত্রই জানেন।
রোজ খবরের কাগজ খুললেই চোখে পড়ে নারীদের ওপর অত্যাচারের নানাবিধ ঘটনা। মধ্যবিত্তের সহ্য নিয়ে টিকে থাকার রোজকার স্ট্রাটেজিতে সব সহে যায়। তবুও কোনও কোনও দিন জ্বলে ওঠে আগুন ঘৃণায়, বিদ্বেষে, দ্রোহে। ফিরে আসে পুরনো স্মৃতি।
দিল্লির গাজিয়াবাদের অন্বিতা শর্মা আত্মহত্যা করেছেন। রেখে গিয়েছেন এক দীর্ঘ সুইসাইড নোট। বলেছেন তিনি ক্লান্ত এক ‘চাকুরিরতা পরিচারিকার’ কাজ করতে করতে। তিনি একজন শিক্ষিকা ছিলেন। নিয়মিত আয়ও ছিল। স্বামী ছিলেন একজন ডাক্তার, যিনি পার্টনার হয়ে উঠতে পারেননি। মধ্যবিত্তের সব চাহিদার বাক্সে তো টিকচিহ্ন, তবে?
…………………………………..
৮০% মহিলা জানিয়েছেন যে, তাঁরা কর্মক্ষেত্রে হেনস্থার শিকার। ক্রমাগত বামপন্থী রাজনীতির শক্তিক্ষয় আরও জটিল করে তুলেছে পরিস্থিতি মহিলাদের জন্য। একা এক গিগ কর্মীর পক্ষে কোনও ভাবেই সম্ভব নয় ক্ষমতার শীর্ষে থাকা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লড়াই করা। দরকার সংগঠনের।
…………………………………..
অন্বিতাকে হত্যা করা হয়েছে, হ্যাঁ হত্যা, এটা স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। প্রতিদিন তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে একটি পরিবার, একটি সমাজ, একটি ব্যবস্থা, একটি অর্থনীতি, যা উদারিকরণের বাজারে নারীকে বাইরে কাজের জন্য বাধা হয়তো দেয় না, কিন্তু বাইরে কাজে বেরলেও নারীকে ঘরের কাজ থেকে রেহাই দেয় না। বাড়ি এবং বাইরে– দুটো কাজের চাপে পিষ্ট অন্বিতার মতো মেয়েরা। ‘Time Use Survey’ (২০২৪)-র সমীক্ষা (যা মিনিস্ট্রি অফ স্ট্যাটিক্স অ্যান্ড প্রোগ্রাম ইমপ্লিমেন্টেশন প্রকাশ করে ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫) অনুযায়ী নারীরা যখন বিনা বেতনের গৃহস্থালির কাজে সময় ব্যয় করে ২৮৮ মিনিট, পুরুষরা সেখানে ব্যয় করে ৮৮ মিনিট!
অন্বিতার সুইসাইড নোট প্রশ্ন তুলে দেয় ঢাক বাজানো গালভরা শব্দ ‘নারী ক্ষমতায়ন’-এর। মুক্তি নেই বাচ্চা দেখার দায়িত্ব থেকে, মুক্তি নেই বাড়ির বয়স্কদের দেখার দায়িত্ব থেকে, মুক্তি নেই একটা সংসারকে সোহাগে ভরিয়ে রাখার থেকে, মুক্তি নেই ‘সংসার’ নামক প্রকাণ্ড খিদের থেকে, তারপর রয়েছে বাইরের চাপ, কর্মক্ষেত্রের চাপ, রাস্তাঘাটের আতঙ্ক। ঘরে ও বাইরে মেয়েরা শুধু নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই করে যাচ্ছে। মাস ফুরলে মাইনে তোলে স্বামী। অনেক নারীকে চিনি যাঁরা শুধুই চাকরিটুকু করেন, কিন্তু এটিএম থাকে স্বামীর কাছে। ২৪ ঘণ্টা জাঁতাকলে পিষছেন, জানেন শোষিত হচ্ছেন, বা অনেকে তো জানেনও না যে শোষিত হচ্ছেন, শান্তি একটাই স্বামী নামক ‘সুরক্ষা’ (পড়ুন ‘পেনিস’) তো আছে। যে সমাজে পুরুষলিঙ্গ সমস্ত ক্ষমতার কেন্দ্রে– সেখানে তো এই-ই ভবিতব্য।
তাই টিচার্স রুম থেকে চায়ের দোকান– কেউ সরকারি, বেসরকারি ক্ষেত্রে চাকুরিরত মহিলা বিয়ে করলেই একটা কথা কানে আসে– আর তুমি তো ‘দুধেলা গাই’ পেয়েছ, কেউ বলে ‘ডাবল ইঞ্জিন’।
কর্মক্ষেত্র থেকে ফিরে ঘাড়ের ব্যাগটা ফেলে সংসারের কাজে সুনিপুণ হাওয়ার কাজে নেমে পড়েন নারীরা।
ক্রমশ বেসরকারিকরণের দিকে ঝুঁকছে আমাদের দেশ। আর বেসরকারি ক্ষেত্রে নেই চাকুরির নিরাপত্তা, নেই কোনও নির্দিষ্ট কাজের সময়। টয়লেট গেলেও চাকরি চলে যায়। ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেল্থ সার্ভের রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতে ১৮-৪৯ বছর বয়স্কদের মধ্যে ২৯% মহিলা গার্হস্থ্য হিংসার শিকার, যে সমস্ত নারীরা কাজের জন্য বাইরে যান, তাঁদের বেশি গার্হস্থ্য হিংসার শিকার হতে হয় কারণ বাড়ির পুরুষটির হিংসার মাধ্যমে আর্থিক এবং পারিবারিক ক্ষমতা নিজের হাতের মুঠোয় রাখতে চান।
৮০% মহিলা জানিয়েছেন যে, তাঁরা কর্মক্ষেত্রে হেনস্থার শিকার। ক্রমাগত বামপন্থী রাজনীতির শক্তিক্ষয় আরও জটিল করে তুলেছে পরিস্থিতি মহিলাদের জন্য। একা এক গিগ কর্মীর পক্ষে কোনও ভাবেই সম্ভব নয় ক্ষমতার শীর্ষে থাকা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লড়াই করা। দরকার সংগঠনের।
অন্বিতার সুইসাইড নোট আমার মতো অনেকেরই লেখা সুইসাইড নোট। অন্বিতা লিখেছে কিন্তু আমি বা আমরা বারবার লিখতে গিয়েও ফিরে ফিরে আসি– এই শুধু পার্থক্য। অন্বিতার রান্না করে রেখে যাওয়া ভাত তাঁর স্বামী খেতে পেরেছে কি না জানি না– তবে আমাদের রক্ত চুষে দিব্যি ফুলে ফেঁপে বাড়ছে পুঁজি আর পিতৃতন্ত্র।
শোষণের ডায়েরি ২
হ্যাঁ
শুয়ে থাকতে খুব মজা হয়
যখন নখরে ছিন্নভিন্ন হয়
মুখ, স্তন, কাঁধ, পেট
আর তারপর সেই নখগুলো পৌঁছায়
দুটো ঊরুর মাঝে।
দারুণ লাগে যখন ভ্যাজাইনা থেকে
কেউ খুবলে তুলে নেয় মাংসপিণ্ড।
এত প্রশান্তি লাগে যে গভীর ঘুম চলে আসে
যখন তারা ছিঁড়ে ফেলে হাইমেন
আর গরম রক্ত গলগল করে বেরিয়ে আসে।
দারুণ লাগে কোনো নালা নর্দমাতে পড়ে থাকতে
আর পোকারা যখন কুড়ে কুড়ে খায়
ক্ষতস্থান।
এভাবে আমাদের মৃত্যু
দারুণ শান্তি দেয় হাউসকে
যে হাউসের দেওয়াল হাসিতে ফেটে পড়ে
হি হি হি হি হি হি হি হি হি হি হি হি
হা হা হা হা হা হা হা হা হা হা হা হা
হো হো হো হো হো হো হো হো হো
এই ঘৃণ্য ঘটনার বিরুদ্ধেই উক্ত কবিতাটি লেখেন এক কবি।
আমাদের দেশে ধর্ষণ একটি রাজনৈতিক অস্ত্র। কাঠুয়া থেকে হাথরস, বিলকিস বানো থেকে আর. জি. কর সবেতেই ধর্ষণ একটি রাজনৈতিক অস্ত্র নারীদের বিরুদ্ধে। সংসদীয় কিংবা প্রতিষ্ঠান কিংবা পরিবার সবেতেই ধর্ষণ ব্যবহ্নত হয় ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার হিসেবে। সেখানে নারীদের এখন ধর্ষিত হয়েছে এটা প্রমাণ করার জন্য অপেক্ষা করতে হবে পায়জামার ফিতে খোলা হয়েছে কি না তার ওপর?
যত শক্ত হচ্ছে দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক উত্থানের চাপ, ততই ব্যাকফুটে নারীরা। পেশি আস্ফালনের রাজনীতিতে নারীরা কোলাট্যারেল ড্যামেজ সবসময়ই। তাই তো দক্ষিণের ডিলিমিটেশন ও হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে অন্ধ্রপ্রদেশ সরকারের এক মন্ত্রীর নিদান দিয়েছেন মহিলাদের বেশি বেশি করে সন্তান জন্ম দিতে হবে। এর ফলে নারীদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে কী প্রভাব পড়বে– তার তোয়াক্কা না করেই মন্ত্রীর এই নিদান।
ধর্ষণের অভিযোগ এলেই শাসকপক্ষ সবসময় সেটা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত থাকে। কখনও বলা হয় সাজানো ঘটনা বা কখনও ভিক্টিম ব্লেমিং অ্যান্ড শেমিং। একমাত্র আশার আলো ছিল কোর্টের কাছে ন্যায়বিচার চাওয়া। সেখানেও এমন মন্তব্য পেলে ন্যায় পাওয়ার আশা আরও দূরে সরে যায়।
এ হেন পরিস্থিতিতে সর্বস্তরের নারীদের এগিয়ে এসে লড়াইয়ে একসঙ্গে না দাঁড়ালে অন্বিতা দের সুইসাইড নোট আরও দীর্ঘ হবে আর খুনি, ধর্ষক ছাড় পেয়ে যাবে বারবার। নারীদের বিরুদ্ধে যখন দাঁড়ায় পিতৃতন্ত্র তখন সেই লাইনে একসঙ্গে দাঁড়ায় ডান, বাম, সেন্ট্রিস্ট। নারীদের অধিকার তাই বুঝে নিতে হবে নিজেদেরই।