যে সমস্ত জায়গায় মহিলারা বেশি সংখ্যায় কর্মক্ষেত্রে আসছেন, সেখানেও তাঁদের ওপর থেকে গৃহশ্রম বা কেয়ার ওয়ার্কের ভার এতটুকু কমেনি। চাকরিতে যোগ দেওয়ার পরও তাঁদের একইরকম সময় ব্যয় করতে হয় অবৈতনিক গৃহশ্রম আর পরিচর্যায়। কাজেই একজন মহিলাকে ফুল-টাইম কাজ করে এসেও নেমে পড়তে হয় দ্বিতীয় শিফ্টের কাজে। তাদের দিন হতে থাকে লম্বা, কমতে থাকে সময়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ, নিজের মতো সময় কাটানোর স্বাধীনতা। ভারতের মতো দেশ যেখানে জাত, বর্ণ ও লিঙ্গের জটিল ছকে নির্মিত হয় ক্ষমতা কাঠামো, সেখানে এই অদৃশ্য শ্রমের সিংহভাগ এসে পড়ে দলিত-বহুজন মেয়েদের কাঁধে। সামান্য পয়সার বিনিময় কিনে নেওয়া যায় তাঁদের শ্রম ও সময়। এখানে শ্রমিক নেই, ‘দিদি’ আছে। কাজ নেই, ‘সাহায্য’ আছে। কোনও লেবার কোড এখানে পৌঁছয় না।
The Many Lives of Syeda X– The Story of an Unknown Indian বইয়ে নেহা দীক্ষিত এমন এক মেয়ের গল্প বলেন, যাঁর শ্রমের কোনও হিসেব কেউ রাখে না, সময়রও নয়। যাঁর দিন শুধুই দীর্ঘতর হয়, টিকে থাকতে, অন্যের প্রয়োজন মেটাতে।
মুসলিম নিম্নবর্ণীয় মেয়ে সায়েদা, বাবরি পরবর্তী দাঙ্গা বিধ্বস্ত বেনারস ছেড়ে পরিবার নিয়ে চলে আসেন দিল্লি, রুজির সন্ধানে, বাঁচার তাগিদে। এরপরের তিন দশকে ৫০টিরও বেশি ‘চাকরি’ করেন সায়দা– বাদাম ভাঙা, শার্টের বোতাম সেলাই, চায়ের ছাঁকনি বানানো, জাতীয় পতাকা তৈরি, বিয়ের কার্ড ছাপানো। একের পর এক দক্ষতা আয়ত্ত করতে করতে এগিয়ে চলে সায়দার জীবন।
সেখানে কোনও চুক্তি নেই। মাতৃত্বকালীন ছুটি নেই। সপ্তাহান্ত নেই। এমনকী, ‘কাজের সময়’-এরও কোনও স্পষ্ট সংজ্ঞা নেই। তাঁর দিন ভাগ হয় না শ্রমে, ঘুমে, অবসরে। ফ্যাক্টরিতে কাজ, ঘরে বসে হাতের কাজ, গেরস্থালির কাজ, চক্রাকারে চলতে থাকে সায়েদার জীবন। যেখানে একদিনের অসুস্থতা মানে কাজ হারানোর আশঙ্কা, অবসর সেখানে অলীক বিলাসিতা।
সায়েদা সেই অসংখ্য দলিত বহুজন নারীর প্রতিনিধি, যাঁদের সময়ের মালিকানা থাকে অন্যের হাতে। নিজের জন্য এক ঘণ্টা সময় বের করাও সেখানে অপরাধ বলে গণ্য হয়।
ক্ষমতাবান চিরকালই দখল করে রাখতে চেয়েছে সময়– উচ্চবর্ণ নিম্নবর্ণের, মালিক শ্রমিকের, শোষক শোষিতের, পুরুষ নারীর। কে কখন ঘুম থেকে উঠবে, কে সবার শেষে খাবে, কার ঘুম বারবার ভাঙবে, আর কার রাত চুপচাপ গলে যাবে পরের দিনের প্রস্তুতিতে– এই সবই নির্ধারিত হয়ে থাকে ক্ষমতাকাঠামোর কোথায় কার অবস্থান, তার ভিত্তিতে।
মে দিনের আট ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবি তাই নিছকই কাজের সময় কমানোর দাবি ছিল না। ১৮৮৬ সালে শিকাগোর হে মার্কেটে শ্রমিকরা যে দাবি তুলেছিলেন, তা ছিল সময়ের ওপর মালিকানার দাবি। তাঁরা ঘোষণা করেছিলেন বিশ্রাম আর আনন্দ কোনও বিলাসিতা নয়, বরং অধিকার।
‘আট ঘণ্টা কাজ, আট ঘণ্টা বিশ্রাম, আর আট ঘণ্টা অবসর’-এর শেষ অংশটুকু ছিল সবথেকে ‘বিপজ্জনক’। সেখানে লুকিয়ে ছিল এক অন্য স্বপ্ন– যেখানে শ্রমিক শুধু ঘুমাবে না, ক্লান্তি মেটাবে না, নিজের সময় দিয়ে কী করবে, সেটাও সে নিজে ঠিক করবে। এই দাবি ছিল মজুরির আন্দোলন থেকে এক মৌলিক উত্তরণ। যেখানে শ্রমিক শুধুই কারখানার এক্সটেশন নয়, মুনাফা তৈরির যন্ত্র নয়, বরং বিপুল সম্ভাবনাময় রক্তমাংসের মানুষ। এই দাবি ছিল নিজের সময়ের ওপর সার্বভৌমত্বের দাবি।
খাতায়-কলমে শ্রমিকের আট ঘণ্টা কাজের অধিকারের স্বীকৃতির পরে ১০০ বছরেরও বেশি সময় কেটে গেলও, সেই স্বপ্নের আঁচ এসে পৌঁছয়নি সমাজের প্রান্তে। আজও ১৪ ঘণ্টা-১৬ ঘণ্টা কাজ করেও বেঁচে থাকার ন্যূনতম রসদ জোগাতে নাভিশ্বাস ওঠে সংখ্যাগরিষ্ঠের। কাজের হিসেবে স্থান পায় না গৃহশ্রম, পরিচর্যা, বা সন্তান পালন। সেসবই আজও মেয়েদের ‘দায়িত্ব’। সেই শ্রমের রেকর্ড জমা পড়ে না কোথাও।
এই শ্রমের বিপুল ভার বহন করে চলেন মেয়েরা, বিশ্বজুড়ে। পরিসংখ্যান বলে পৃথিবী জুড়ে গড়ে প্রতিদিন প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা বিনামূল্যের গৃহশ্রমে যায় মহিলাদের। গৃহশ্রম ও কেয়ার ওয়ার্কের কাজের অসম বণ্টনের ফলে এক বড় অংশের মহিলারা শ্রমবাজারের বাইরে থেকে যান। আর তাই সার্বিকভাবে শিক্ষার হারের উন্নতি হলেও মহিলাদের শ্রম বাজারে অংশগ্রহণ আনুপাতিকভাবে বাড়ে না।
দেখা যায় যে, সমস্ত জায়গায় মহিলারা বেশি সংখ্যায় কর্মক্ষেত্রে আসছেন, সেখানেও তাঁদের ওপর থেকে গৃহশ্রম বা কেয়ার ওয়ার্কের ভার এতটুকু কমেনি। চাকরিতে যোগ দেওয়ার পরও তাঁদের একইরকম সময় ব্যয় করতে হয় অবৈতনিক গৃহশ্রম আর পরিচর্যায়। কাজেই একজন মহিলাকে ফুল-টাইম কাজ করে এসেও নেমে পড়তে হয় দ্বিতীয় শিফ্টের কাজে। তাদের দিন হতে থাকে লম্বা, কমতে থাকে সময়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ, নিজের মতো সময় কাটানোর স্বাধীনতা।
ভারতের মতো দেশ যেখানে জাত, বর্ণ ও লিঙ্গের জটিল ছকে নির্মিত হয় ক্ষমতা কাঠামো, সেখানে এই অদৃশ্য শ্রমের সিংহভাগ এসে পড়ে দলিত-বহুজন মেয়েদের কাঁধে। সামান্য পয়সার বিনিময় কিনে নেওয়া যায় তাঁদের শ্রম ও সময়। সময়ের ওপর জবরদখলের এ এক নিখুঁত মডেল। এখানে শ্রমিক নেই, ‘দিদি’ আছে। কাজ নেই, ‘সাহায্য’ আছে। কোনও লেবার কোড এখানে পৌঁছয় না। বরাদ্দ ছুটি নেই, নেই কোনও নিশ্চয়তা। বরং একদিন ছুটি নিলে মাইনে কেটে নেওয়ার নিষ্ঠুরতা আছে। আর এই হাজার হাজার দলিত বহুজন মেয়েদের সময় ও শ্রম শোষণ করে এগিয়ে চলে ভদ্রবিত্তের শহুরে ভারত।
তাই যখন দলিত, বহুজন, শ্রমজীবী মেয়েরা নিজেদের জন্য অবসর চায়, নিজেদের জন্য সময় দাবি করে, সেই দাবি হয়ে ওঠে এক বিপ্লবী উচ্চারণ। কারণ অবসর মানে শুধু বিশ্রাম নয়; অবসর মানে নিজের জীবন, নিজের শরীর, নিজের স্বপ্নের ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা। এই দাবি প্রশ্ন করে সেই গোড়ার কাঠামোটাকেই, যেখানে শ্রম আর বিশ্রাম, প্রাপ্য আর অনুগ্রহ– সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হয় লিঙ্গ, বর্ণ ও শ্রেণির নিরিখে।
সেই কাঠামো, যেখানে উচ্চবর্ণ পুরুষের অবসরযাপন অধিকার, আর নিম্নবর্ণ নারীর অবসর সময়ের অপচয়। যেখানে গৃহশ্রম আর পরিচর্যার কাজ অদৃশ্য হলেও সমাজের টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য– সেই অদৃশ্য দেওয়ালের আড়ালে আটকে থাকে মেয়েদের দিনরাত।
২০১৯ সালে National Statistical Office-এর টাইম ইউজ সার্ভে রিপোর্ট-এ দেখা যায় গ্রামীণ ভারতে পুরুষদের ৮৬.৮% এবং শহরের পুরুষদের ৮৯.৭% যে কাজ করেন সেটা System of National Accounts-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী ‘উৎপাদনশীল’ কাজের আওতায় পড়ে। অথচ গ্রামে বসবাসকারী নারীদের ৭৬.৭% এবং শহরের নারীদের ৮১.১% কাজ ‘অউৎপাদনশীল’ শ্রম হিসেবে পরিগণিত।
এই রিপোর্ট আরও বলে ১৫-২৯ বছর বয়সি মেয়েদের ৮৫.৮% প্রতিদিন গড়ে ৪.৮৫ ঘণ্টা বিনামূল্যে গৃহশ্রম করেন, যেখানে সমবয়সি পুরুষদের মাত্র ২৪.২% গৃহশ্রমে যুক্ত, তাও দৈনিক মাত্র দেড় ঘণ্টার জন্য। বয়স ১৫-৫৯ বছর হলে নারীদের মধ্যে গৃহশ্রমের অংশগ্রহণ বেড়ে দাঁড়ায় ৯২.৩%-এ, সময়ও বাড়ে– প্রতিদিন ৫.২৫ ঘণ্টা। অথচ এই বয়ঃসীমার পুরুষদের ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ ২৮.৯%, সময় একই– দেড় ঘণ্টা।
এই অসম শ্রমবণ্টন– যেখানে মেয়েদের অধিকাংশ সময় যায় বিনামূল্যে গৃহশ্রমে, তাদের আয়-উপার্জনের সুযোগকে প্রবলভাবে সংকুচিত করে দেয়। নারীদের শ্রম অবৈতনিক এবং ‘অউৎপাদনশীল’ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায়, তারা ‘কর্মী’ হিসেবেও অদৃশ্য থেকে যান– শ্রমে যুক্ত থেকেও ‘কর্মহীন’ হিসেবে বিবেচিত হন।
শিকাগোর হে মার্কেট বিক্ষোভের অন্যতম সংগঠক, কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিক নেত্রী লুসি পারসনস বলেছিলেন,
‘There was never a greater truth uttered. We are the slaves of the slaves. We are exploited more ruthlessly than men.’
লুসি ছিলেন তাঁদের একজন, যারা আমেরিকার গৃহযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে দাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়েও এক নতুন শৃঙ্খলের মুখোমুখি হয়– লিঙ্গ ও শ্রেণিভিত্তিক শোষণের।
নিজের অতীত– দাসত্ব, বর্ণপরিচয় মুছে ফেলতে চেয়েছিলেন লুসি, হয়ে উঠেছিলেন শ্রমিক আন্দোলনের এক দুর্দান্ত সংগঠক ও কৌশলবিদ। হে মার্কেট বিক্ষোভের পর তাঁর সঙ্গী যখন মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন, তখন ‘হে মার্কেট উইডো’ পরিচিতি নিয়ে আমেরিকা জুড়ে শ্রমিকদের সংগঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি।
লুসি গভীরভাবে বুঝেছিলেন প্রতিটি পুরুষ শ্রমিকের দৃশ্যমান শিফটের পিছনে রয়েছে একজন নারীর অদৃশ্য, অবিরাম শিফট; যার কোনও হিসেব নেই, স্বীকৃতি নেই। আর সেই অদৃশ্য শ্রমের ওপর ভর করেই গড়ে উঠেছে পুঁজিবাদী উৎপাদনের এই নির্মম ব্যবস্থা।
এ এমন এক বাস্তবতা, যেখানে সময় নিজেই হয়ে ওঠে এক শ্রেণিগত সম্পদ। যেমন পুঁজি জমা হয় হাতে গোনা কিছু মানুষের কাছে, তেমনই জমা হয় অবসর, বিশ্রাম, আর সময়ের অধিকার। গৃহশ্রম আর পরিচর্যার এই অদৃশ্য ব্যবস্থা সময়ের পুঁজিকরণের ভিতকে শক্ত করে– যেখানে কারও অতিরিক্ত অবসর নিশ্চিত হয় অন্য কারও অতিরিক্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে।
একদিকে কর্পোরেট পুঁজির চাহিদায় শ্রমিকের কাজের সময় বাড়ছে, ছুটি সংকুচিত হচ্ছে, শ্রমিক সময়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছেন। অন্যদিকে প্রান্তিক নারীদের ওপর আরও বেশি করে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে অবৈতনিক সময়শ্রম। এই দুই প্রান্ত– অতি দৃশ্যমান এবং অতি অদৃশ্য শ্রম– একসঙ্গে নির্মাণ করে এমন এক ব্যবস্থা, যেখানে উৎপাদনের আর পুনরুৎপাদনের ভিতরে চিরস্থায়ী হয় ক্ষমতার অসম বণ্টন।
আর সায়েদারা লড়ে চলেন সেই ক্ষমতার কাঠামোর বিরুদ্ধে– কখনও একটুকরো অবসর চুরি করে, কখনও মিছিলে স্লোগানে, কখনও বা নেহাতই টিকে থেকে। এখানে প্রতিটি ছোট ছোট অবাধ্যতা, প্রতিটি নীরব প্রত্যাখ্যান, প্রতিটি ছিনিয়ে আনা আনন্দের মুহূর্ত হয়ে ওঠে প্রতিরোধ। প্রতিদিনের শ্রম আর শোষণের চক্রের মাঝে, সময়ের ওপর সামান্য নিয়ন্ত্রণ কায়েম করাও হয়ে দাঁড়ায় এক রাজনৈতিক ঘোষণা।
১৯ শতকের শেষ ও ২০ শতকের শুরুর দিকে, শুধু ব্রিটিশ প্রশাসন নয়, ভারতীয় এলিট পুরুষেরাও এই পেশায় মহিলাদের আসা রীতিমতো সমর্থন করেন। অনুমান করা হত ভারতীয় মহিলারা পুরুষ ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা করাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। ফলে আপাতদৃষ্টিতে অন্যান্য অনেক দেশের, বা এ-দেশেই অন্য অনেক পেশার তুলনায় এখানে মহিলাদের ডাক্তারি পড়া বা ডাক্তার হওয়ার পথটা অনেকটা সহজ ছিল।