সমাজে চালু ধারণা আছে যে, প্রতিবন্ধী মানেই যৌনতাবিহীন মানুষ। শারীরিক-মানসিক কোনও প্রতিবন্ধকতা কোনও মানুষের আছে মানে যৌনচাহিদা তার থাকতে পারে না। তাও বিসমকামী প্রতিবন্ধী মানুষ হলে আমাদের দেশ বা সমাজে প্রেম, বিবাহ, প্রজনন সম্ভব (অবশ্যই অন্য একজন প্রতিবন্ধী মানুষের সঙ্গে!) কিন্তু সেই মানুষটি যদি সমকামী-রূপান্তরকামী হন তখন তাঁর জীবন অচিরেই বিভীষিকাময় হয়ে ওঠে। ভারতে তথাকথিত ‘সুস্থ’ যৌনসংখ্যালঘু মানুষদের অসুবিধার শেষ নেই। তাঁরা আজও নিজেদের যৌনচাহিদা ব্যক্ত করলে হেনস্তা-হিংসার শিকার হন, স্কুল জীবন থেকে সেই বিদ্বেষ শুরু হয়। এ-দেশে আজও সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষেরা বিসমকামী মানুষদের মতো বিবাহ, সন্তান ধারণ-পালনের অধিকার থেকে বিচ্যুত।
গ্রাফিক্স: দীপঙ্কর ভৌমিক
একটি ধর্মীয় সংগঠনের সম্মেলন ‘মানবিকতা’ বিষয়ক। সম্মেলনকে সার্থক আর গভীর করতে প্রতিবন্ধী শিশু-কিশোর ও তাদের অভিভাবকদের জড়ো করা হয়েছে। ‘স্পিরিচুয়াল’ ব্যাপার-স্যাপার কিছু হবে মনে করে এসেছেন বহু অভিভাবক। তাঁদের আশা যে, তাঁরা আধ্যাত্মিক হতে পারলে হয়তো বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুপালনের যে-চাপ, তা থেকে খানিক রেহাইয়ের পথ পাওয়া যাবে। হয়তো যোগ-ধ্যান শেখানো হবে। সেদিনকার বক্তা একজন গেরুয়া পরিহিত ব্রহ্মচারী বা সন্ন্যাসী। কথা বলার ধরন সুন্দর। তিনি পুরাণ থেকে অষ্টবক্র মুনির উদাহরণ টেনে আজকের প্রতিবন্ধী জীবনের বাস্তবতা সম্পর্কে নিজের বক্তব্য তুলে ধরছিলেন। এত অবধি সব ঠিক ছিল। হঠাৎ বক্তা বলে বসলেন, ‘প্রতিবন্ধকতা আসলে পূর্বজন্মের কৃতি’। এবং আমাদের সহানুভূতি দরকার প্রত্যেক প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য। খুব বেশি সময় গেল না দর্শকাসনে বসা একজন মা বলে উঠলেন, ‘মহারাজ! আপনার প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা জানিয়ে বলছি আপনার বক্তব্য শুধু ভুল নয়, হিংসাত্মক। কারণ, এই যে আপনি বলছেন পূর্বজন্মের কর্মফলে মানুষ প্রতিবন্ধী হয় তাহলে অন্যান্য মানুষের মনে হতে পারে প্রতিবন্ধী মানেই পাপী এবং হয়তো অপরাধীও। প্রতিবন্ধী মানুষ সম্বন্ধে এমন মনোভাব যদি সমাজে তৈরি হয় তবে সহানুভূতি তো দূরের কথা, এই মানুষগুলো বারবার ঘৃণার শিকার হবে।’ ভদ্রমহিলার এ-হেন বক্তব্যে সমগ্র প্রেক্ষাগৃহ জুড়ে নীরবতা নেমে এল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই পুরো হল করতালিতে ভরে উঠল।
সেদিনের সেই সাধু শুধু নয়, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা বিষয়ে অনেকের ধারণা, তা যেন পূর্বজন্মের কর্মফল। প্রতিবন্ধকতা যে একটা বিশেষ যাপন মাত্র এবং সম্পূর্ণভাবে সামাজিক নির্মাণ তা আমাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। কারণ, আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ে ওঠে সুস্থবাদ (এবলিজম)-এর ওপর। প্রতিবন্ধী মানুষ কীভাবে একটি সমাজে অংশগ্রহণ করবেন, তা আমরা ভেবে দেখি না। মনুষ্যজন্ম মানেই তথাকথিত ‘সুস্থ’ হবে আর না হলে ‘সুস্থ’ সমাজের সঙ্গে সেই মানুষগুলোকে ‘মানিয়ে’ চলতে হবে। তাই প্রতিবন্ধী মানুষ খুব সহজেই আমাদের রাষ্ট্রে ও সমাজে সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে। তবু এ কথা ঠিক সংখ্যালঘু হলেও রাষ্ট্র প্রতিবন্ধী গোষ্ঠীর জন্য কিছু বিশেষ আইন ও অধিকার তৈরি করেছে। সংখ্যালঘুর সুবিধার্থে পুরো সমাজটাকে ঢেলে সাজানো যায়নি ঠিকই কিন্তু ব্যবহারিক জীবনের নানা কাজে দেশের প্রতিবন্ধী মানুষরা অংশগ্রহণ করতে পারছে। সেসবের অভ্যন্তরীণ সংগ্রাম মারাত্মক কিন্তু প্রতিবন্ধী মানুষরা সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে প্রস্তুত। তাঁরা চাকরি, ব্যবসা, প্রেম, বিবাহ, সন্তান উৎপাদন-পালন এবং নানাবিধ রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার- সব বিষয়ে তথাকথিত ‘সুস্থ’ জনগোষ্ঠীর থেকে পিছিয়ে থাকতে রাজি নয়। কিন্তু সেই মানদণ্ড আবার পিতৃতান্ত্রিক ও বিসমকামী। প্রতিবন্ধী যেখানে নারী এবং সমকামী-রূপান্তরকামী সেখানে এই সংগ্রাম অনেকগুণ বেশি শুধু নয়, ধ্বংসাত্মকও বটে।
আমাদের সমাজে চালু ধারণা আছে যে প্রতিবন্ধী মানেই যৌনতাবিহীন মানুষ। শারীরিক-মানসিক কোনও প্রতিবন্ধকতা কোনও মানুষের আছে মানে যৌনচাহিদা তার থাকতে পারে না। তাও বিসমকামী প্রতিবন্ধী মানুষ হলে আমাদের দেশ বা সমাজে প্রেম, বিবাহ, প্রজনন সম্ভব (অবশ্যই অন্য একজন প্রতিবন্ধী মানুষের সঙ্গে!) কিন্তু সেই মানুষটি যদি সমকামী-রূপান্তরকামী হন তখন তাঁর জীবন অচিরেই বিভীষিকাময় হয়ে ওঠে। ভারতে তথাকথিত ‘সুস্থ’ যৌনসংখ্যালঘু মানুষদের অসুবিধার শেষ নেই। তাঁরা আজও নিজেদের যৌনচাহিদা ব্যক্ত করলে হেনস্তা-হিংসার শিকার হন, স্কুল জীবন থেকে সেই বিদ্বেষ শুরু হয়। এ-দেশে আজও সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষেরা বিসমকামী মানুষদের মতো বিবাহ, সন্তান ধারণ-পালনের অধিকার থেকে বিচ্যুত। তবু এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই যে তাঁরা এক প্রকার জোট বাঁধতে পেরেছেন, ‘প্রাইড-মার্চ’-এর মধ্যে দিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেন এবং রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের প্রতিবাদ করেন। কিন্তু সেই যৌনসংখ্যালঘু মানুষটি যদি প্রতিবন্ধী হন তবে গোষ্ঠীর ভেতরে ও বাইরে– দু’ক্ষেত্রেই সামাজিক ‘স্টিগমা’ তাঁকে চেপে ধরে। একজন হুইলচেয়ার-ব্যবহারকারী মানুষের পক্ষে ‘প্রাইড-মার্চ’-এ অংশগ্রহণ কতটা সুবিধার? একজন দৃষ্টিহীন মানুষ কি সহজেই সঙ্গীনির্বাচনের অ্যাপ ব্যবহার করতে পারেন? একজন তথাকথিত ‘সুস্থ’ সমকামী মানুষ কি খুব অনায়াসে একজন মূক ও বধির সমকামী মানুষকে গ্রহণ করে নেন? দেখা যাচ্ছে প্রতিবন্ধী মানুষদের প্রতি যে-বৈষম্য তথাকথিত বিসমকামী সমাজে প্রকট, তার প্রভাব কি সমকামী-রূপান্তরকামী গোষ্ঠীতেও পড়ে। শুধু তাই নয়, আপামর যৌনসংখ্যালঘু মানুষের বিসমতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজের কাছে যেসব দাবি, সেগুলি কি প্রতিবন্ধী সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের নিজস্ব চাহিদার অনুবর্তী? নাকি সেখানেও সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সংখ্যালঘুর একটি সমান্তরাল সংগ্রামের স্রোত বহমান? সংখ্যালঘুর মধ্যেও সংখ্যালঘু যাঁরা তাঁদের কথা না ভাবলে বা বৃহত্তর আলোচনায় তাঁদের অন্তর্ভুক্ত না করলে আন্দোলনের প্রকৃত উদ্দেশ্য কখনওই সফল হবে না। আমাদের সব রকম যৌনশিক্ষা থেকে, লিঙ্গযৌনতা বিষয়ক আলোচনা থেকে প্রতিবন্ধী মানুষদের, বিশেষত যাঁরা একাধারে যৌনসংখ্যালঘু এবং প্রতিবন্ধী, তাঁদের কথা যেন বাদ না পড়ে।
সেদিনের সম্মেলন শেষে সেই মা-এর সঙ্গে মুখোমুখি হওয়া গিয়েছিল। সকলে দেখি একটা মোক্ষম কথা বলার জন্য সেই মাকে অভিনন্দন জানাচ্ছে। সত্যি তো তিনি একটি প্রতিরোধী বক্তব্য তুলে ধরেছিলেন। তাঁর কথাগুলো অনেক মানুষের মনের কথা। ওঁর চারিদিক থেকে যখন ভিড়টা হালকা হল, বললাম, ‘খুব ভালো বলেছেন। তবে আরও অনেক কথা বাকি রয়ে গেল।’ উনি অল্প হেসে উত্তর দিলেন, ‘জানি। আরও অনেক কথা, আরও অনেকের কথা বলা বাকি রয়ে গেল। সাধু মহারাজদের তো আর সব বোঝানো সম্ভব নয়!’
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved