যে সমাজ লালন করে এক সভ্যতা, বেঁধে রাখে দুই হাত অটুট করে, সেখানেই ফাঁক এসে পড়ে সমাজ, পরিবার, বিদ্যালয়ের ছাদ-বারান্দা-উঠোনে। রুখতে হবে সেই স্রোত। পারস্পরিক অবিশ্বাসের বাতাবরণ সরিয়ে বপন করতে হবে একাত্মতার বীজ।
শিশু জন্ম নেয় পরিবারে। এক চোখ উচ্ছ্বাস। মন সবুজ। চারপাশে বিস্ময়ের বলয়। ঘোর না কাটতেই গৃহবন্দি জীবন ছেড়ে অন্য দুয়ারে কড়া। ছোট্ট পায়ে সব বাধা পেরিয়ে অন্য ঠিকানায়। অন্য বাড়ি। নাম বিদ্যালয়। কোলাহলের মধ্যেও মন কেমন করা হু হু বাতাস। শীতকাঁপুনি আসে অহরহ। স্যর-ম্যাডামের একটু আড়চোখও সয় না। একটু স্নেহে বেসামাল মোমের মতো গড়িয়ে পড়ে। ঘুরে ঘুরে আদর চায়। মনযোগ চায়। নিবিড়ভাবে নিজেকে খুঁজে পেতে চায়। নিজের অবস্থান নিশ্চিত করতে চায় অন্য বাড়িতে। আর এই বাড়ির গল্প বলে ওই বাড়িতে শেষ হয় না কিছুতেই। মায়ের চেয়ে তখন ম্যাডাম দামি। প্রছন্ন হুমকি থাকে কথায়– ওখানেই ভাল থাকি, বাড়িতে ভাল লাগে না। নাছোড়, নান্দনিক। দুরন্ত, অকপট। আমাদের খুদে পড়ুয়ারা ঠিক এমনই। এদের জীবনের প্রতিটি ইটে শিক্ষকের নাম লেখা। মানুষ গড়ার কারিগররা এভাবেই বানিয়ে চলে ইমারতের পর ইমারত। সেখানে লুকিয়ে থাকে অনেক গোপন ইতিহাস। কখনও ভাইরাল হয়। কখনও তা কৃষ্ণগহ্বরে মুখ লুকায়। শিশুমনের অস্ফুট কান্না বুঝি সমান মূল্য হয় না। এক হীনম্মন্যতা থেকে জন্ম নেয় নিজের শেকড় খুঁজে বেড়ানোর তাগিদ। তরতর করে বাড়তে চাওয়া গাছ হঠাৎ লতিয়ে পড়ে। অনেকটাই ম্রিয়মাণ। কিন্তু এসব কিছুর জন্য তার ভূমিকা হাতড়ে শিশুটি পায় না।
জন্মপরিচয় অর্পিত। তার ভিত্তিতে মানুষে মানুষে কী করে আলাদা হয়? এই অঙ্কটা মেলে না অপরিণত মাথায়।
সূজন টুডু তখন প্রাইমারি। নিজের নাম লুকিয়ে রাখত। ‘টুডু’ বলার সঙ্গে সঙ্গে বদল হয়ে যায় সামনের মানুষটির ব্যবহার। তাই নিজেকে ‘সুজান’ বলে পরিচয় করাত। কিন্তু প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া হত, ‘বল না তোর টাইটেলটা বল!’ সূজন আজ বাংলায় স্নাতকোত্তর পেরিয়ে আপশোস করে বলে, ‘বাঙালি হওয়ার পরীক্ষা দেওয়া যায় নাকি! তাও এভাবে! বিদ্যালয় চত্বরে খুব কষ্ট করে কাটিয়েছি। রাতেও ঘুম ভাঙলে মনে পড়ে যেত সেই ভেংচি কাটা কথাগুলো।’ একই অভিজ্ঞতা নাজমারও। সরকারি চাকুরিরতা নাজমার অতীত স্মৃতি মনের সরণি বেয়ে বিদ্যালয়ে ধাক্কা খায়। গেমস টিচার বলে দেয়, ‘সরস্বতী ঠাকুর একমাত্র বাঙালি ছাত্রীরাই পছন্দ করে নিয়ে আসবে!’ নাজমার ভাষায়, এই ক্ষতগুলি শুকিয়ে যায় হয়তো সময়ের সঙ্গে কিন্তু দাগ থেকে যায়। যখনই ধর্ম নিয়ে খোঁটা দেওয়া হয়, মন ডুকরে কেঁদে ওঠে। আমার নাম, ধর্ম তো আমি ঠিক করিনি তার সাজা আমায় কেন দফায় দফায় গুনতে হবে। মানুষ হয়ে কী এজন্য জন্মেছি! এই অতলস্পর্শী এক মর্মবেদনার ভার যখন এক ক্ষুদে বুকে বয়ে বেড়ায় তখন সে একা। পাশে কাউকে সে পায় না নিজের গ্লানি ভাগ করে নেওয়ার জন্য। মুখ খুললেই বিপদ! প্রশ্নজালে জর্জরিত। ঠিক-ভুল বোঝার আগেই চুপ করে যাওয়ার এক অভ্যাস গড়ে ওঠে।
শিক্ষকও মানুষ। এই সমাজের অংশ। এক ভুল বিশ্বাস ও ভাবনা যখন কালো পাথরের মতো আকার নিয়েছে তখন সেই পাথরে মাথা ঠুকে কে-ই বা মরতে চায়! তাই কোরবানির মাংস নিয়ে যে মিথ তাতেই সিলমোহর দেয়! বলে ফেলে ‘আরে! তোরা তো মাংস পচিয়ে খাস মাসের পর মাস!’ এই ‘তোরা’ যে কারা, খুঁজতে বসে বাচ্চা। কখনও সাপের মুখে, কখনও সাপের ল্যাজে আটকে থাকে। লুডো খেলা চলতেই থাকে। উত্তর মেলে না। খাদ্যাভাস পরিবার ও ধর্ম তৈরি করে। তাতে শিশুর কী ভূমিকা। নয় সে বর্জন করতে পারে, নয় গ্রহণ করতে পারে সেটা তার পছন্দ ও চাহিদা অনুযায়ী বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বদলায়। এর ভিত্তিতে কেউ সমাজে ছোট বা বড় হতে পারে না। এবং শাস্তির ফতোয়া বা বিধান বর্তানোর পরিস্থতি তৈরি হতে পারে না। যদি পৃথিবীর কোনও এক প্রান্তে এটা ঘটে, তবে সেটা সামাজিক লজ্জা। শিক্ষার প্রতি অবিচার করা। এগুলিকে প্রকাশ্যে নিন্দা করার প্রাত্যহিক অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
পরিবার ও বাইরে যখন এমন প্রতিনিয়ত বিষ নিশ্বাস তখন খুশির বাতাবরণ বয়ে নিয়ে আনে মানুষই। বুকে টেনে নিয়ে চোখের জল মোছায়। সুন্নিকে তার হাতের লেখার জন্য বিদ্যালয়ে শুনতে হয়েছিল, ‘তোদের’ হাতের লেখা কেন এত খারাপ হয় রে! সহপাঠীর এই অদ্ভুত প্রশ্নে সুন্নির কিছু বোঝার ছিল না। কিন্তু বাড়িতে এসে বলার পর সকলের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় এই ‘তোরা’ আসলে কারা! আর এই উক্তিটির জন্য বাচ্চাটিকে দায়ী করা অসম্ভব। কেননা চর্চার এক ভিন্ন পরিবেশ তাকে শিখিয়েছে যে সুন্নি ওদের মতো নয়, ওদের লেখা থেকে পরা-খাওয়া সবটাই আলাদা। সুজান বা নাজমা বা সুন্নি সকলেই যখন তাদের অভিজ্ঞতার বয়ান দেয়, তখন উঠে আসে এক অসহযোগিতা ও অ-সভ্যতার ভাষা। সুন্নির মাকে সরকারি আবাসনে কাটাতে হয়েছে সিঁদুর পরে। শুধু একটিই আশা। ছেলে-মেয়েকে যেন কেউ দূরে ঠেলে না দেয়। ওদের শৈশব যেন সংখ্যাধিক্যের দলে পড়ে বঞ্চনার বাতাস থেকে দূরে থাকে। বিদ্যালয়ে নিজের ভাষায় কথা না বলার জন্য বারবার মুখস্থ করানো হয়েছে বিভিন্ন সম্পর্কের নাম ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের নাম। তাতেও শেষরক্ষা হয়নি! রাস্তা ঘাটে ধর্মপরিচয় ধরে ফেলে এড়িয়েছে মানুষ। তার মাঝেই হাত ধরে বন্ধু টেনে নিয়ে গিয়েছে একদম ঠাকুর ঘরে। বলেছে ‘বস তো! আমি পুজো করে নিই, তারপর একসঙ্গে খাব!’ সেই স্মৃতির বয়ানে ছল ছল করে উঠেছে সুন্নির মায়ের চোখ! সন্তানের বেদনা একেবারে পরিবারের বুকে বেদনার মতো গাঁথা হয়ে গেছে।
পরিবেশে নিজেকে মিলিয়ে-মিশিয়ে নিতে পারার মতো বড় শিক্ষা আর কিছুই নেই। সুন্নি নিজেকে মিলিয়ে-মিশিয়ে একজন সুনাগরিক হয়ে উঠেছে। পিছন ফিরে দেখলে ছোট্ট ছোট্ট ঢেউয়ের মতো ঘটনা এসে পড়ে। ভাসিয়ে দিয়ে যায় নদীর পার। প্রত্যাখানে কষ্ট নেই। কিন্তু অপমান বড় পীড়াদায়ক। সেটাও পূর্বপুরুষদের নাম তুলে! নাজমা হেসে বলে, ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে তো একবার মুখের উপর বলেছিল, ‘এই চাকরিটা আপনাদের জন্য নয়’। আসলে ‘এই ফ্ল্যাট আপনাদের জন্য নয়, এই অনুষ্ঠান আপনাদের না কি?’ এসব শুনে শুনে ভেঙে গেছে মন। তারপরেও এই মাটিতে জন্ম আমার। ঋণ শোধ করতে চাই। সমাজ থেকে ভাল মিলেছে যা কিছু তা নিয়ে নিজের পরবর্তী প্রজন্মকে আরও ভাবনায় শক্তিশালী করতে চাই। সুজানরা মানুষের মুখ ফিরিয়ে নেওয়া, ঘৃণা সব পেরিয়ে আজও আশায় বুক বাঁধে। পরিবারে নিজে ও নিজের বোনকে শিক্ষিত করে জবাব ছুড়ে দেয় সকলের মুখে। বাংলা ভাষায় ডিগ্রি অর্জন করে বলে দেয় বাংলা যে জানে, বোঝে এবং বাঙালি বলে সে গর্ব করে। তার শিক্ষা, সাধনা কোনওটিই তার টাইটেল দিয়ে বিচার করা যায় না।
যে সমাজ লালন করে এক সভ্যতা, বেঁধে রাখে দুই হাত অটুট করে, সেখানেই ফাঁক এসে পড়ে সমাজ, পরিবার, বিদ্যালয়ের ছাদ-বারান্দা-উঠোনে। রুখতে হবে সেই স্রোত। পারস্পরিক অবিশ্বাসের বাতাবরণ সরিয়ে বপন করতে হবে একাত্মতার বীজ। একজন মুসলিম একজন আদিবাসীকে তাঁর পরিচয়ের জন্য গ্লানি নয় গর্ব করতে শেখাতে হবে। অপমান নয়, কমিউনিটির ইতিহাসের উজ্জ্বল দিক নিয়ে পর্যালোচনার সুযোগ দিতে হবে। ব্যক্তি ঘৃণাকে সরিয়ে রেখে সামগ্রিকভাবে মানুষ হিসেবে নিজেদের আত্মগর্বের ইতিহাস ধারাবাহিকভাবে বলে যেতে হবে। এক তৃপ্তি দেবী ব্যক্তি কাঠগড়ায় দাঁড়ালেও সমাজের রেহাই পাওয়ার কথা নয়। দিনের শেষে ওই সমাজবদ্ধ মহিলাটির মতো হাজার মানুষ চারপাশ জুড়ে এক অসুস্থতা বহন করেছে। আমরাও তার বাহন হয়েছি হয়তো কোথাও। সেই বাহন হওয়াটা বন্ধ করার চিরাচরিত উদাত্ত আহ্বান ছিল কিছু মানুষের। অবহেলার বিরুদ্ধে এই কণ্ঠস্বরগুলি বাঁচাতে হবে। বিভেদের বিরুদ্ধে এগুলিকে হাতিয়ার হিসেবে সামনের সারিতে বসিয়ে যেতে হবে। পরিবর্তনের এক নিরন্তর প্রবাহ আছে। তাতে শামিল হতে হবে আপামর পক্ষপাতহীন দর্শনের মানুষদের। লক্ষ্য এক আদর্শ সমাজ, যা মানুষের বিবেককে জাগায় নিয়ত। অসুখের ঘুম ভাঙাবে জোর করে।