আমরা ভুলে যাই আমাদের সমাজে, রাষ্ট্রে ততদিন ‘প্রতিবন্ধী’ শব্দটি থাকবে যতদিন আমাদের পরিবেশটা প্রতিবন্ধকতা জয় করতে পারবে না। যেমন মুখ্যমন্ত্রীর সাময়িক যে প্রতিবন্ধকতা তা আদপে প্রতিবন্ধকতাই রইল না তার কারণ কার্নিভালের মঞ্চে র্যাম্প তৈরি হল। তেমনই আমাদের শহর, রাজ্য, দেশজুড়ে যদি প্রতি বিল্ডিংয়ে, অফিসে, বাড়িতে, রাস্তায় এমন র্যাম্পের ব্যবস্থা হত, তাহলে তো কোনও প্রতিবন্ধীই তথাকথিত ‘প্রতিবন্ধী’ থাকতেন না।
রেড রোডের ‘কার্নিভাল’ একটি অতীব আলোকজ্জ্বল অনুষ্ঠান। কলকাতার বাছাই-করা কয়েকটি বড় দুর্গাপুজোর প্রতিমা মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সামনে দিয়ে বিসর্জনে যাবে এবং সেই সঙ্গে আপামর দর্শকরাও সেই বিগ্রহ দর্শন করার সুযোগ পাবেন। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে সরাসরি সম্প্রচার হবে। তবে দেখা গেল, এবারের ‘কার্নিভাল’ খানিক হলেও আলাদা। এবারের মুখ্যমন্ত্রীকর্তৃক পুজো-উদ্বোধনও আগের বছরগুলোর থেকে ভিন্ন ছিল। এসবের মূল কারণ– পায়ের চোটে মুখ্যমন্ত্রী হুইলচেয়ার-বন্দি। খবরে প্রকাশ: সিঁড়ি ভাঙতে পারবেন না বলে কার্নিভালের মঞ্চে তৈরি করা হয়েছিল অস্থায়ী র্যাম্প। এই ‘র্যাম্প’ জিনিসটা কী? র্যাম্প হল খাঁজকাটা অথচ সিঁড়ি না ভাঙা পথ– যার মধ্য দিয়ে হুইলচেয়ার অনায়াসে চলে-ফিরে যেতে পারবে। এতে হবেটা কী? যাঁরা হুইলচেয়ার-বন্দি মানুষ, তাঁদের চলাফেরা করতে আর কোনও মুশকিল হবে না।
তা সত্ত্বেও আমরা এই ‘র্যাম্প’ বেশি দেখি না কেন? কথা হল, বেশি কেন, আমরা অনেকেই এই র্যাম্প অতি অল্পও দেখতে পাই না। কারণ, আমাদের শহর, রাজ্য এবং দেশ একেবারেই প্রতিবন্ধকতা-বান্ধব নয়। দেখা-শোনা-কথা বলার যে প্রতিবন্ধকতা, তা যদি আপাতত এখানে অনালোচিতও রাখি, তাও জানি চলাফেরার প্রতিবন্ধকতার জন্য যে সচেতনতা আমাদের সমাজে বা রাষ্ট্রে গড়ে ওঠা প্রয়োজন, তার কণামাত্র আছে কি না সন্দেহ! অথচ, ‘প্রতিবন্ধী-কার্ড’ আছে, কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া নবনামকরণ ‘দিব্যাঙ্গ’ শব্দটি আছে কিন্তু মানুষের নানা শারীরিক প্রতিবন্ধকতা কীভাবে অতিক্রম করা যায়, তা নিয়ে কোথাও কোনও গঠনমূলক চিন্তাভাবনা অন্তত রাষ্ট্র বা সরকারের তরফে নেই তেমন। বাসে-ট্রামে-মেট্রোয় ‘প্রতিবন্ধী-সিট’ আছে। কিন্তু একজন প্রতিবন্ধী সেই বাস-ট্রাম বা মেট্রো অবধি পৌঁছবেন কী করে, তার কোনও ভাবনা নেই!
অনেক জায়গায় র্যাম্প আছে, লিফ্ট আছে কিন্তু একজন হুইলচেয়ার-বন্দি মানুষ অপ্রশস্ত দরজা থাকলে সেসব স্থলে বাথরুম ব্যবহার করবেন কী করে, সেটা আমরা চিন্তা করি না কখনও। আবার ‘প্রতিবন্ধী’ শব্দটায় আমাদের মনে ভেসে ওঠেন এমন কিছু মানুষ যাঁরা চলতে ফিরতে পারেন না, চোখে দেখতে পান না, কানে শুনতে পান না কিংবা কথা বলতে পারেন না। এর বাইরেও আরও নানা রকম শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতা থাকতে পারে। কিন্তু আমরা ভুলে যাই আমাদের সমাজে, রাষ্ট্রে ততদিন ‘প্রতিবন্ধী’ শব্দটি থাকবে যতদিন আমাদের পরিবেশটা প্রতিবন্ধকতা জয় করতে পারবে না। যেমন মুখ্যমন্ত্রীর সাময়িক যে প্রতিবন্ধকতা তা আদপে প্রতিবন্ধকতাই রইল না তার কারণ কার্নিভালের মঞ্চে র্যাম্প তৈরি হল। তেমনই আমাদের শহর, রাজ্য, দেশজুড়ে যদি প্রতি বিল্ডিংয়ে, অফিসে, বাড়িতে, রাস্তায় এমন র্যাম্পের ব্যবস্থা হত, তাহলে তো কোনও প্রতিবন্ধীই তথাকথিত ‘প্রতিবন্ধী’ থাকতেন না। সকলেরই চলে-ফিরে বেড়ানোর সুযোগ থাকত। তাছাড়া, আমরা অনেক সময় মনে করি প্রতিবন্ধী বুঝি একটা গোষ্ঠীমাত্র– যাঁরা জন্মগতভাবে বা দুর্ঘটনায় শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং সেহেতু তাঁদের তথাকথিত সাহায্যের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে কখনও রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক দয়াদাক্ষিণ্যেরও! কিন্তু আমাদের প্রতিবন্ধকতা না-থাকাটা যে কেবলমাত্র ‘সাময়িক’, সেটা আমরা ঠাহর করি না। আমরা মনে রাখি না তথাকথিত অ-প্রতিবন্ধী যাঁরা, তাঁরা যে-কোনও সময়েই প্রতিবন্ধকতার কবলে পড়তে পারেন। দুর্ঘটনা ও তাতে শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবার অনুষঙ্গ তো আছেই এমনকী, বার্ধক্যও যে আমাদের জীবনে প্রতিবন্ধকতা বয়ে আনতে পারে, সেটা ভুলে গেলে চলে না। সেসবের জন্য কী ব্যবস্থা রেখেছি আমরা? হয়তো কিছুই না। তা নাহলে ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং শুধু হুইলচেয়ার-বন্দি বলে সংসদের পিছন দিকে একেবারে বেরিয়ে যাওয়ার দরজার মুখে বসে থাকার নির্মম ছবি আমরা খবরে দেখেছি! যদি সংসদেরই নির্মাণ প্রতিবন্ধকতা-বান্ধব না হয় তবে ভারতের নানা শহরে, রাজ্যে সেই সচেতনতা গড়ে উঠবে এমন আশা করাই বৃথা!
আসলে এসবের নেপথ্যে একটা সংখ্যাগরিষ্ঠের রাজনীতি কাজ করে। মোটামুটি একটা বেশি সংখ্যক মানুষের যা হলে চলে যাবে, সেই আকারেই সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে উঠতে চায়। এই রাজনীতিই চায় এক ভাষা, এক পোশাক-পরিচ্ছদ, এক ধর্মাচরণ, এক রকমেরই যৌনতা– যাতে রাষ্ট্রকে শাসনে রাখতে সুবিধা হয়। ভিন্নতাকে এ রাজনীতি সম্মান করে না। সে-কারণে ভিন্ন চেতনা রাষ্ট্রের কোনও ভাবনাতেই স্থান পায় না। রাষ্ট্রে, রাজ্যে, শহরে, গ্রামে র্যাম্পওয়ালা নির্মাণ করতে প্রাচুর্যের প্রয়োজন পড়ে না। থাকতে হয় সংখ্যালঘুকে সমাজে মিশিয়ে নেওয়ার, একটা শাসনযন্ত্রকে গণতান্ত্রিক করে তোলার মানবিকতা। সেই মানবিকতা থেকেই আমরা ভাবব যে-কোনও দিন প্রতিবন্ধকতা আমাদেরও গ্রাস করতে পারে। যে-কোনও দিন হুইলচেয়ার-বন্দি বলেই আমার ঘরের বাইরে বেরনো বন্ধ হয়ে যেতে পারে, আমার চলে-ফিরে বেড়ানোর জগতে নেমে আসতে পারে অন্ধকার। আমি অচিরেই হয়ে উঠতে পারি তথাকথিত ‘প্রতিবন্ধী’। সেদিন আমার জন্য হয়তো কোনও র্যাম্প তৈরি হবে না, কেউ তা করবে না। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে, র্যাম্প লাগানোর এতসব আনন্দ আয়োজনের নেপথ্যে আমারও একটা ভোট ছিল।