ধর্মান্ধরা ভেবেছিল আঁধারে ঠেলে দিলেই আলোর স্বপ্নকে খুন করা যায়! তারা নার্গেস মহম্মদিদের চেনে না, নার্গেসরা অন্ধকার যত গভীর হয়, ততই ভোরের স্বপ্নে বিউগেল বাজান। নার্গেস নিজেই বলেছেন, ‘সরকার আসলে বুঝতে পারছে না যে যতই আমায় জেলে পাঠানো হবে, ততই আমার মনোবল দৃঢ় হবে।’ নার্গেস মহম্মদিরা আছেন, থাকবেন। যেমন বসন্ত আসবেই। সেই বসন্তের দিনকে বিশ্বাস করেই সংগ্রাম।
নারী-জীবন-আজাদি– কুর্দিশ মহিলাদের তৈরি এই স্লোগানটি নানা সময়ে উঠে এসেছে পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর বিরুদ্ধে মহিলাদের লড়াইয়ে। জিনা মাহশা আমিনির মৃত্যুর প্রতিবাদে ইরানের নারীরা যখন প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে, তখনও এই স্লোগানটি হয়ে ওঠে সেই লড়াইয়ের মূল স্লোগান। নারী মাত্রই জানে স্লোগানটির শেষ দুটো শব্দ– জীবন ও আজাদির স্বপ্ন পূরণের লড়াইয়ে নারীদের যে বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়, তার দলিল রাষ্ট্র, দেশ, ক্ষমতা মুছে দিতে চায়। সকলের অগোচরে মুছে দিতে চায় বলেই নার্গেস মহম্মদিকে পাঠানো হয় এভিন নামক কুখ্যাত কারাগারে। এভিন কারাগারকে বলা হয়, ‘ইরানের বস্তাইল’।
সেখানকার ধর্মান্ধরা ভেবেছিল আঁধারে ঠেলে দিলেই আলোর স্বপ্নকে খুন করা যায়! তারা নার্গেস মহম্মদিদের চেনে না, নার্গেসরা অন্ধকার যত গভীর হয়, ততই ভোরের স্বপ্নে বিউগেল বাজান। নার্গেস নিজেই বলেছেন, ‘সরকার আসলে বুঝতে পারছে না যে যতই আমায় জেলে পাঠানো হবে, ততই আমার মনোবল দৃঢ় হবে।’ (‘What the government may not understand is that the more of us they lock up, the stronger we become’)
অন্ধকারের বিরুদ্ধে, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে, গণতন্ত্রের পক্ষে যুগে যুগে গর্জে উঠেছেন নারীরা। নার্গেসের নোবেল প্রাপ্তি অবশ্যই একটি বড় স্বীকৃতি, তাতে যতই পাশ্চাত্য-হস্তক্ষেপের গন্ধ থাক। প্রখ্যাত মানবাধিকার কর্মী নার্গেস, সব মিলিয়ে ১৩বার জেলে কাটান। নার্গেস হলেন গোটা পৃথিবীর সেই সব মহিলাদের প্রতিনিধি, যাদের মেরুদণ্ড ভয়ে ন্যুব্জ হয় না, স্বপ্ন দেখার আস্পর্ধা আরও সোজা করে দাঁড় করিয়ে দেয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর বিরুদ্ধে। ইরান সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে নার্গেসকে দিতে হয়েছে অনেক বড় মাশুল। সন্তান, স্বামীর থেকে আলাদা হতে হয়েছে। ৫১ বছর বয়সি নার্গেস প্রথম গ্রেপ্তার হন ২০১১ সালে। আর সাম্প্রতিককালে গ্রেপ্তার হয়েছেন নীতিপুলিশের হাতে মাহশা আমিনির মৃত্যুর প্রতিবাদে। ইরানীয় নারীদের অধিকার, তাদের ওপর নেমে আসা মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে সোচ্চার নার্গেস মহম্মদি। তাই নার্গেস মহম্মদির নাম ঘোষণা করতে গিয়ে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি যখন বলেন, ‘তিনি ইরানীয় নারীদের ওপর হয়ে চলা অত্যাচারের প্রতিবাদে আর মানবাধিকারের প্রচারের জন্য গোটা জীবনটাই উৎসর্গ করেছেন’, তখন অত্যুক্তি হয় না।
১৯৭২-এ জন্ম নার্গেস মহম্মদির। ১৯৭৯ সালের ইরানীয় বিপ্লবের পর থেকে মারাত্মকভাবে নারীদের স্বাধীনতা খর্ব করা হয় ইরানে। ১৯৭৯ সালের ইরানীয় বিপ্লবের পর পার্লামেন্ট গঠিত হলেও, ক্ষমতা থাকে ধর্মীয় মৌলবাদীদের হাতে আর শরিয়া আইন দিয়ে ইরানকে পরিচালনা করা শুরু হয়। বামপন্থী, ট্রেড ইউনিয়ন-সহ স্বাধীন চিন্তার পক্ষে দাঁড়ানো কণ্ঠস্বররা প্রতিবাদ শুরু করে। আর বিরোধী কণ্ঠস্বর রোধ করতে গ্রেপ্তার করা হয় প্রচুর প্রতিবাদী স্বরকে। যাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়, তাঁদের মধ্যে ছিলেন নার্গেসের চাচা ও দুই ভাই।
নার্গেসের নোবেল প্রাপ্তি সকল মেয়েকে সাহস জোগাবে। সাহস জোগাবে ভারতের নারীদেরও, যারা প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর বিরুদ্ধে লড়াই করছে। স্ট্যাটাস ক্যু ভেঙে যেসব নারী তছনছ করে সমতার দাবি করে, তাদের দাগিয়ে দেওয়া হয় নানারকম শব্দ দিয়ে, পুরে দেওয়া হয় জেলে। সেই জেল যেমন ‘বাড়ি’ নামক কয়েদখানা হতে পারে, তেমন হতে পারে রাষ্ট্রের নির্মিত জেলখানা। ইরানিয়ান কবি ফোরুখ ফারুখজাদের কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করবেন শুনে, অনুবাদকের পরিবারের প্রথম উক্তি ছিল– ‘কেন ওই বেশ্যার (ফোরুখ ফারুখজাদ) জন্য সময় নষ্ট করছ?’ (‘Why are you wasting your time on that whore?’)
ফোরুখ ফারুখজাদের অপরাধ ছিল যে তিনিও ছিলেন নারীবাদী, প্রথাবিরোধী ও বাক্স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। নার্গেস মহম্মদির মতো তিনিও চেয়েছিলেন নীতিপুলিশ মুক্ত এক সুন্দর ইরান। প্রথাভাঙা নারীরা চিরকালই নষ্ট মেয়ে। এক কবি যেমন বলেছেন–
‘ওরা বলে
স্বাধীনতা বেছে নিলে
মূল্য চুকাতে হবে।
আমি মূল্য চুকাই
আমার দিকে ধেয়ে আসা
গালি দিয়ে।
আব্বা আমায় বিদ্রোহী বলে।
আম্মা বলে– নষ্ট মেয়ে।
সমাজ বলে– পতিতা
আর আমার প্রাক্তন স্বামী বলে–
কুত্তির বাচ্চা।
আমার বোন বলে
আমি এক চরম ব্যর্থ,
আমি স্বামীকে ধরে রাখতে পারিনি।
আর আমার দেশ বলে আমি–
দেশদ্রোহী।
কিন্তু আমি নিজেকে বলি–
আমি একজন স্বাধীন নারী।
(মূল কবিতা: The Price Of Freedom, অনুবাদ: মৌমিতা আলম)
ইরানের নীতিপুলিশ সরকারি রাষ্ট্রের অংশ। আমাদের দেশে কি নীতিপুলিশ নেই? আমাদের দেশে বাড়ি, সমাজ, রাষ্ট্র হয়ে ওঠে নীতিপুলিশ। আর এর রোষানলে পড়তে হয় শুধুই নারীদের। ফোরুখ ফারুখজাদ, নার্গেস মহম্মদি আর আমাদের দেশে অনার কিলিংয়ের নামে মৃত মেয়েরা এক হয়ে যায় ‘চয়েস’ বা পছন্দের স্বাধীনতা নামক শব্দবন্ধে। তাদের সবার অপরাধ একই যে তারা তাদের ‘পছন্দের স্বাধীনতা’ দাবি করেছিল। নিজের ইচ্ছেমতো পোশাক পরার স্বাধীনতা বা নিজের জীবনসঙ্গী খোঁজার স্বাধীনতা। হিজাব পরা বা না পরার স্বাধীনতা। বাক্স্বাধীনতা দাবি করা নারীরা সবসময়ই রাষ্ট্রের চক্ষুশূল।
আর রাষ্ট্রের কাছে নিজের স্বাধীনতা দাবি করার মাশুল শুধুই ইরানে নয়, আফগানিস্তান থেকে ভারত, প্রতিটি দেশেই দিতে হয়েছে নারীদের বারবার। শিক্ষা অর্জন করতে চেয়েছিলেন বলে মৌলবাদীদের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন মালালা ইউসুফজাই।
রাষ্ট্রের কথার অমতে কথা বলেছিলেন বলে শিক্ষা দিতে গিয়ে সোনি সোরির যৌনাঙ্গে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় পাথর।
ভিন্নমত ও বাক্স্বাধীনতার কথা বলতেন বলে শিক্ষক দিবসের দিন শিক্ষা দিতে গিয়ে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয় গৌরী লংকেশকে। সোমা সেন, সুধা ভরদ্বাজ থেকে শুরু করে অরুন্ধতী রায়– বারবার শিকার হয়েছেন রাষ্ট্রের রোষানলের বা সমাজের নীতিপুলিশের কাছে। নার্গেস মহম্মদির আর্তনাদ মিলে যায় সোমা সেনের মেয়ের আর্তনাদের সঙ্গে, নার্গেসের লেখা বই ‘White Torture’-এ পাওয়া যায় সন্তানের থেকে আলাদা হওয়া নার্গেসের যন্ত্রণা ক্লিষ্ট অভিব্যক্তি: ‘আমার সন্তানেরা কি আমায় চিনতে পারবে যখন আমি মুক্ত হব (জেল থেকে)। তারা কি আমার গলার স্বর চিনতে পারবে? তারা কি আমায় আবার মা বলে ডাকবে?’ (‘I do not know if my children will know me when I come out in the coming years. Will they recognize my voice? Will they call me mother again?’)
অর্থাইটিসে আক্রান্ত মায়ের জন্য জেলে একটি কমোড চেয়ে রাষ্ট্র থেকে কোর্টের দ্বারে দ্বারে ফিরতে হয় সোমা সেনের মেয়েকে। গোধরা হত্যাকাণ্ডের বিচার চাওয়া তিস্তা শেতলবাদকে সইতে হয় বারবার রাষ্ট্রযন্ত্রের হেনস্তা।
রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতায় নারীদের কাছে হারতে বসে পুরুষ, রাষ্ট্র বারবার সাহায্য নিয়েছে লাঠি ও ভাষার। ইন্দিরা গান্ধীকে বলা হয়েছে, ‘গুঙি গুঁড়িয়া’ তো অবজেক্টিফিকেশনের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে হেমা মালিনীর গালের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে রাস্তার। মমতা ব্যানার্জিকেও নানা সময় শুনতে হয়েছে নারীবিদ্বেষী শব্দ।
নার্গেস মহম্মদির লড়াই আরও গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বের সমস্ত নারীদের কাছে এই জন্যই যে, এটা সমস্ত নারীদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে এক ধর্মান্ধ, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র নারীদের জন্য সবসময়ই বিপজ্জনক। নারীদের ‘চয়েস’ শব্দটিকে ভয় পায় মৌলবাদী রাষ্ট্র। সেই মৌলবাদ যে ধর্মেরই হোক না কেন। আজকের দিনে তাই নার্গেস মহম্মদির নোবেল প্রাপ্তি সকল প্রতিবাদী মহিলাদের স্বীকৃতি। তার সঙ্গে স্বীকৃতি সমস্ত প্রতিবাদী নারী কণ্ঠস্বরের, যারা রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার– সব নীতিপুলিশের চোখে চোখ রেখে আশার কথা বলেন, আলোর কথা বলেন, মুক্তির কথা বলেন। যেমনটি ফারুখ ফারখাজাদ বলেছেন,
তোমরা তোমাদের অধিকার ছিনিয়ে নাও
তাদের কাছ থেকে যারা তোমাদের দুর্বল করে রেখেছে
যাদের নানারকম ফন্দিফিকির
তোমাদের ঠেলে দিয়েছে ঘরের এক কোণে।
(মূল কবিতা: To My Sister)
অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার এই জেদ, এই অদম্য সাহস নিয়েই নারীরা মুক্তির স্বপ্ন দেখেন। নার্গেস মহম্মদিরা আছেন, থাকবেন। যেমন বসন্ত আসবেই। সেই বসন্তের দিনকে বিশ্বাস করেই সংগ্রাম। আর জেলের দেওয়াল কখনই আলোকে আটকাতে পারে না।
বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর খুব সঠিকভাবেই ভারতের বিদেশনীতির ব্যাখ্যা করে আগাম বলে রেখেছিলেন, ‘হোয়াইট হাউস ডেমোক্র্যাট প্রার্থী না রিপাবলিকান প্রার্থীর দখলে গেল তা নিয়ে নয়াদিল্লি মোটেও চিন্তিত নয়। কারণ, ভারত ও আমেরিকার সম্পর্কের এতে কোনও পরিবর্তন ঘটবে না। গত পাঁচটি প্রেসিডেন্টের আমলেই ভারত ও আমেরিকার সম্পর্কের উন্নতি ঘটেছে।’