এ যেন অদ্ভুত সহাবস্থান! শহরের দেওয়ালে আঁকা নিখোঁজ মেয়েদের কথা। আর তার ঠিক পাশেই মাসাজের নামে দুষ্টচক্রের অবাধ বিজ্ঞাপন। দেওয়াল লিখনের এই বৈপরীত্য যেন মহিলাদের অদৃষ্টলিপি হয়েই ধরা দিয়েছে। এ-ই কি তবে কাম্য ছিল? অস্বস্তির এ-প্রশ্ন দলা পাকিয়ে ওঠে গলার কাছে। লিখছেন তিতাস রায় বর্মন।
শহরে আজকাল আর রাত নামে না, আলো নেভে না। রাত বাড়তে থাকলে দেওয়ালগুলো জেগে ওঠে, চকমকিয়ে ওঠে। বিজ্ঞাপনী চর্চা রাতভর, দিনভর। কেনাবেচা, বেচাকেনা। কচি কলাপাতা রঙের, উজ্জ্বল কমলা রঙের বিজ্ঞাপন দেওয়াল জুড়ে, সারি সারি। কোনও এক মেয়ের মাসাজ পার্লার। একটা টলমল পা হিসি করতে শুরু করে সেই বিজ্ঞাপনের দিকে তাকিয়ে। কেউ নাম্বারটা টুকে নিচ্ছে। কেউ যৌনাঙ্গ এঁকে দিয়েছে। মেয়ে বিক্রি শুরু হয়েছে। হইহই করে। উল্লাসে ফেটে পড়ছে শহর।
সরে আসি। এগিয়ে যাই তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে। যা দেখলাম, তা ভুলে যেতে হবে এখুনি। হাঁটতে হাঁটতে থমকে দাঁড়াই আবার। হঠাৎ সব রং নিভে গিয়েছে, একটা দুর্ভেদ্য কালো রং শহরের দেওয়াল ফুড়ে বেরিয়ে আসছে যেন। একটা মেয়ের কালো অবয়ব, নীচে লেখা ‘মিসিং ১০৯৮’। দেশ থেকে মেয়েরা একে একে হারিয়ে যাচ্ছে, অবয়ব হয়ে যাচ্ছে।
কিছুদিন তাদের তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ হাল ছেড়ে দেয়। ততদিনে তারা সীমান্ত পেরিয়ে গিয়েছে। অন্য শহরে পাচার হয়ে গিয়েছে। গত ছ’বছরে গড়ে প্রতিদিন ৯৩০টি করে কেস ফাইল হয় থানায়, নিখোঁজ মেয়ের কেস। সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দাহাড়’ সিরিজে আমরা দেখি নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েগুলো হারিয়ে গেলে, পুলিশ গা করে না। সিরিয়াল কিলারের অ্যাঙ্গেল পেলে, তবেই পুলিশ এগিয়ে আসে।
ওই কালো অন্ধকার অবয়ব ঘন হতে থাকে, বড় হতে থাকে, আকাশ ছুঁয়ে ফেলে। কৃষ্ণগহ্বর যেন, সামনে গেলে চুম্বকের মতো টেনে নেয়, ওখান থেকে কেউ ফেরে না। কিন্তু এ দেশ যে মেতে থাকে মেয়েদের বিক্রিবাট্টায়। চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়া কেনাবেচার বিজ্ঞাপনের পাশে হারিয়ে যাওয়া মেয়ের কালো অবয়ব– আমার দেশ। ২০১৫ সালে লীনা কেজরিওয়াল এই ‘মিসিং’ ক্যাম্পেন শুরু করেন দেশজুড়ে। হারিয়ে যাওয়া মেয়েদের যাতে ভুলে না যায় এ দেশ– শুরুতে উদ্দেশ্য ছিল তাই-ই। তবে পরে এই ক্যাম্পেন আরও বড় আকারে শুরু করার জন্য লীনা একটি অনলাইন গেম বাজারে আনেন। যেখানে একটি মেয়ে হারিয়ে গেলে, পাচার হয়ে গেলে কোন কোন অবস্থার মুখোমুখি হয়, তা গেমের এক-একটি পর্যায় পার হতে হতে জানা যায়। খেলাটার প্রক্রিয়া হল ওই অবস্থার মুখোমুখি হওয়া ও বেঁচে ফিরে আসা। লীনা জানান, এই গেমটা তিনি আনেন মিলেনিয়াল প্রজন্মের জন্য, যাতে তারা নিজেরাই নিজেদের বাঁচিয়ে, পালিয়ে আসতে শেখে।
‘মিসিং’ ক্যাম্পেনের স্রষ্টা লীনা কেজরিওয়াল
কিন্তু নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার, পালিয়ে আসার দায় কি নিজেদের? মেয়ে-জন্ম কি শুধুই সার্ভাইভাল স্কিলে পারদর্শী হয়ে ওঠা? ভ্রুণ থেকে যার নিধন শুরু, তার কোনও দিনই এই বাঁচার লড়াই থেকে রেহাই নেই। দিনভর নিজেকে জীবিত রাখার প্রচেষ্টা। জীবনের পাশ কাটিয়ে আড়াল দিয়ে হেঁটে চলা। রাজপথ কখনও তাদের নয়। কিন্তু কথা ছিল বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব নেবে রাষ্ট্র, সমাজ। লক্ষ্মী-রুকসানারা হালকা পায়ে বেণী দুলিয়ে ঘুরে বেড়াবে। স্বাধীনতার গরিমায় উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। কিন্তু তাদের আজ শিখতে হচ্ছে পাচারকারীর সঙ্গে মোকাবিলা করার উপায়। যেচে পাচার হওয়ার অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। নিজেকে দেখতে হচ্ছে বন্দি, নিজেকে দেখতে হচ্ছে অন্যের কাছে বিক্রি হয়ে যেতে, দেখতে হচ্ছে কীভাবে মৃত্যুর থাবা লম্বা হয়, কীভাবে যেন মাংসপিণ্ডে পরিণত হয়েছে তারা, কীভাবে যেন মাংসাশী হয়ে উঠেছে গোটা পৃথিবী।
পুলিশ জানে, রাষ্ট্র জানে, নেতা জানে। কিন্তু কেউ গা করেনি। পুলিশের কাছে হারিয়ে যাওয়া মেয়ের কেস ফাইল উঁচু হয়েছে। আর ওই মাসাজ পার্লারের মেয়েগুলো? তাদের কেউ খুঁজতে এসেছিল? তাদের খোঁজ তো কখনও থামেনি। তাদের ঘিরে পুরুষের ভনভনানি। ওদের নাম নেই, ঠিকানা নেই, কেউ ওদের চেনে না।
২০১৭ সালে মুম্বই এবং পুণের একাধিক মাসাজ পার্লার থেকে ৪০ জন থাইল্যান্ডের মহিলাকে উদ্ধার করা হয়েছে। ২০১৮ সালে ওড়িশার স্পা মাসাজ পার্লার থেকে বাঁচানো হয়েছে একাধিক মেয়েকে। ২০২২ সালে গোয়ার মাসাজ পার্লার থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ২০ জনের বেশি মেয়েকে।
২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ভারতে নিখোঁজ সাড়ে ১৩ লাখ মেয়ে। প্রতি ২৬ সেকেন্ডে একটি করে মেয়ে হারিয়ে যায়। সীমান্ত পেরয়। সমুদ্র পেরয়। অন্য দেশের দেওয়ালে তাদের ছবি আর ফোন নাম্বার। যে দেশে কেউ চিনবে না ওদের।
অথচ ওদের পেরনোর কথা ছিল সাত সমুদ্র তেরো নদী। কারা যেন ফাঁদ পেতে রেখেছিল গলির সামনে।