এই ঘটনা কি আমাদের ইতিহাসে কালো দাগ রেখে গেল না? এখনও তো আমাদের জানা নেই আরও ক’টি ঘটনা এমন ঘটেছে? তার চেয়েও বড় ট্রাজেডি– প্রতিবাদী, সচেতন, আত্মনির্ভর মণিপুরি তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের মেয়েদের নিরাপত্তাবোধ কোন তলানিতে গিয়ে ঠেকবে? লিখছেন যশোধরা রায়চৌধুরী।
বহুস্তরীয় ভয়াবহতার ছেদবিন্দু যেন। বহুকৌণিক প্রশ্নের কাটাকুটি। ৭৮ দিন ধরে চলা মণিপুরের জাতিহিংসা নিম্নতম বিন্দুটি স্পর্শ করল। প্রায় তিন মাস ধরে চলা অশান্তির পর শান্তিস্থাপনের জন্য প্রশাসনের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন উঠে যায় এমনিতেও।
২০২৩-এর মে মাসে মণিপুরে হঠাৎ কুকি বনাম মৈতেই চূড়ান্ত হিংসার বাতাবরণ সৃষ্টি হয়। সেই হিংসার নেপথ্যের গল্পও বহু পরত বিশিষ্ট অত্যন্ত জটিল। কিন্তু মে মাসেই ঘটে যাওয়া এই ঘটনার বিভীষিকার কোনও তলকূল নেই। প্রশ্ন ওঠে, সে ভিডিও এতদিন পরে কেন বাইরে এল? ৪ মে, কাংপোকপি জেলায় থৌবল-এ ৮০০ থেকে ১০০০ মৈতেই জনতা তিনটি কুকি মেয়েকে বিবস্ত্র করে টানতে টানতে মাঠে নিয়ে যায়। মেয়ে তিনটির একজনের বাবা ও ভাইকে সর্বসমক্ষে হত্যা করে সেই জনতা। ওই মেয়েদের বয়ান অনুযায়ী, নংপোক সিকমাই থানার পুলিশ রক্ষা করার বদলে উন্মত্ত ভিড়ের হাতে ছেড়ে দিয়েছিল তাদের। দুই নারীকে বিবস্ত্র করে ঘোরানো এবং যৌন অত্যাচার, তাদের একটি মেয়েকে সর্বসমক্ষে গণধর্ষণ। অবাধে এই ঘটনা ঘটাচ্ছে যারা, তাদেরই কেউ কেউ ভিডিওতে ছবি তুলছে। একুশ শতকের এ ঘটনা চূড়ান্ত সীমা স্পর্শ করল।
যে কোনও হিংসার অভিমুখ শেষমেশ কেন নারী নির্যাতনের সহজ টার্গেট খুঁজে নেয়, নাৎসি অত্যাচার থেকে সার্বিয়া বা কোরিয়া, সর্বত্র ক্ষমতার প্রদর্শন কেন শেষমেশ নারীধর্ষণে ফলিত রূপ পায়?
চিরকাল দেশে দেশে নারীশরীরকে যুদ্ধক্ষেত্র বানানো হয় কেন? এইসব প্রশ্নের পরেও আসে এই প্রশ্ন, যে, একটা ফেক ঘটনার গুজব হোয়াটস্যাপ মাধ্যমে প্রচার করে (কোনও একটি অন্য নারীহিংসার ঘটনার ছবিকে মৈতেই মেয়ের ধর্ষণের নামে চালানো), ধর্ষণের জন্য একটি গণপ্রতিক্রিয়া তৈরি করা।
এই ঘটনা কি আমাদের ইতিহাসে কালো দাগ রেখে গেল না? এখনও তো আমাদের জানা নেই আরও ক’টি ঘটনা এমন ঘটেছে? তার চেয়েও বড় ট্রাজেডি– প্রতিবাদী, সচেতন, আত্মনির্ভর মণিপুরি তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের মেয়েদের নিরাপত্তাবোধ কোন তলানিতে গিয়ে ঠেকবে?
মহাভারত কথিত মণিপুরকন্যা ছিল চিত্রাঙ্গদা। রবি ঠাকুরের কলমে আত্মবলে বলীয়ান মেয়েটি বলেছিল, আমি চিত্রাঙ্গদা, আমি রাজেন্দ্রনন্দিনী।/নহি দেবী, নহি সামান্যা নারী।/পূজা করি মোরে রাখিবে ঊর্ধে/সে নহি নহি/হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে/সে নহি নহি।
আজও মূল ভূখণ্ডের তুলনায় অনেক বেশি করেই উত্তর পূর্বে মেয়েরা তাঁদের সমাজে অর্ধেক আকাশের চেয়ে বেশি। ভৌগোলিক কারণেই, উত্তর পূর্বের পার্বত্য অঞ্চলের ভূমিপুত্রীদের কাছে যুদ্ধ, শিকার, বাহুবল সবই সহজ। আজও ৪০০-র কাছাকাছি উপজাতির উত্তর পুববাসিনীর মধ্যে অধিকাংশই সামাজিক সম্মানে, কর্মকুশলতায়, আর্থিক স্বাধীনতাতেও পুরুষের থেকে এগিয়ে। সাতটি উত্তর পুবের রাজ্যের পাঁচটিতেই জনগণনার নিরিখে নারীর সংখ্যা বেশি। নারী-পুরুষ অনুপাত সারা ভারতের সংখ্যাতত্ত্বকে লজ্জায় তো ফেলবেই। ভোটার লিস্টেও মেয়েরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। মেঘালয়ের মাতৃতান্ত্রিক সমাজের কথা আমাদের জানা। মণিপুর বহুদিন মেয়েদের সক্ষমতার প্রতীক থেকেছে। ১৯৩৯ সালে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে মণিপুরের মেয়েরা রাস্তায় নেমে তৈরি করেছিলেন ‘নুপি লানা’ (নারী যুদ্ধ) বিদ্রোহ।
মায়েদের বাহুবলের রাজ্য মণিপুর। সারা দেশের মধ্যে একমাত্র ইম্ফলেই আছে মেয়েদের চালিত প্রায় একশো বছরের পুরনো বাজারের প্রথা। ‘ইমা কেইথাল’ বা ‘মায়েদের বাজার’। দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য। এই ইমা-দের বয়স গড়ে পঞ্চাশ থেকে সত্তর।
অনন্য এইসব সক্ষমতার প্রেক্ষিতেই মণিপুরের সাম্প্রতিক নারীহিংসার ঘটনা আরও বীভৎস।
আমাদের মনে আছে মনোরমার কথা। আস্ফপা বলে বলীয়ান সেনার আস্ফালনের বিরুদ্ধে, মণিপুর তরুণী মনোরমাকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ ও খুনের বিচার চেয়ে ২০০৪ সালে বয়স্কা মাতৃসমারা আসাম রাইফেলস হেডকোয়ার্টারের সামনে ‘এসো আমাকে ধর্ষণ করো’ বলে কাপড় ফেলে দাঁড়িয়েছিলেন প্রতিবাদে।
এই প্রদেশের মায়েদের এমন সক্ষমতাও আন্দোলনের মুখ, এই জটিলতম সময়ে, নাকি ঘুরে গিয়েছে ভুল দিকে। বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে ‘মেইরা পাইবি’ গোষ্ঠী, অর্থাৎ মায়েদের গোষ্ঠী। এক সময়ে এঁরা গ্রামের ছেলেদের মদের নেশা ছাড়াতে সহিংস হয়ে উঠেছিলেন। একদা ছেলেরা ভয়ে কাঁপত, মদ্যপান, মদ বিক্রি বন্ধ হয়েছিল মায়েদের ত্রাসে। এখন গোষ্ঠীদ্বন্দ্বর প্রেক্ষিতে মেইরা পাইবি খুব ভয়াবহ ভূমিকায়, শোনা যাচ্ছে। পাহাড় আগত আদিবাসীদের বাড়ি জ্বালানো, খুন, ধর্ষণেও তাঁরা মদত দিচ্ছেন, উঠে আসছে এমন তথ্য।
রাজ্য সরকারের ভীতি, হাত গুটিয়ে থাকা এতে আরও মদত দিচ্ছে না কি? এ জটিল পরিস্থিতিতে কোনও পক্ষ নেওয়া এবং বিশেষ অবস্থান নেওয়াও বিপজ্জনক। এও জানা যাচ্ছে, মহিলা কমিশনের অগোচরে ঘটেনি নারী অবমাননার ঘটনাগুলো! কিন্তু রেখা শর্মা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে উত্তর চেয়ে পাননি বলে এতদিন চুপ করেছিলেন! দীর্ঘ নীরবতার পর মুখ খুলেছেন মানবাধিকার কমিশনও। সুপ্রিম কোর্ট আদেশ দিয়েছেন যথাসম্ভব দ্রুত ব্যবস্থা নিতে।
কয়েকটি লোক গ্রেপ্তার হয়েছে। বাকি সব? এই খুন, হিংসা, আগুন, ধর্ষণের কোনও বিরতি হবে? না কি কাহানিতে আরও কদর্য টুইস্ট, আরও অদ্ভুত জটিল সত্য দেখা যাবে।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved