স্পেনের জাতীয় ফুটবল দলের মেয়েরা জানিয়ে দিয়েছে, তারা আর দেশের হয়ে খেলবে না, যতদিন না খেলায় মাঠে তাদের ওপর যৌন নির্যাতন বন্ধ হচ্ছে। একই কথা জানিয়েছিল আমাদের দেশের সাক্ষী মালিক, বজরঙ্গ পুনিয়া-রা। কেউ কর্ণপাত করল না। ভারতীয় রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে চক্কর খাচ্ছে যৌন হেনস্তার অভিযোগ। এই সরে যাওয়ার মতো সশব্দ, সশস্ত্র বিপ্লব আর কী আছে?
ওরা ময়দান ছেড়েছে। যে ময়দানে ওরা জান দিয়ে লড়ে দেশের জন্য বিশ্বকাপ নিয়ে এসেছিল, সেই ময়দানটাই। বিশ্বকাপ থেকে মুঠোটা আলগা করে দিয়েছে। কিন্তু ময়দান ছাড়েনি। মাঠ আঁকড়েই পড়ে থাকবে ওরা, তবে মাঠটা এবার বদলে গিয়েছে। এবার ওরা নামবে লড়াইয়ের ময়দানে। স্পেনের জাতীয় ফুটবল দলের মেয়েরা জানিয়ে দিয়েছে, তারা আর দেশের হয়ে খেলবে না, যতদিন না খেলায় মাঠে তাদের ওপর যৌন নির্যাতন বন্ধ হচ্ছে।
স্পেনীয় দেশের কোচ লুইস রুবিয়ালেস বিশ্বকাপ জয়ের মঞ্চে খেলোয়ার জেনিফার হারমোস-কে জোর করে ঠোঁটে চুমু খায়। তোয়াক্কা করে না জেনিফারের সম্মতির। রাগে-ঘেন্নায় ফেটে পড়েছিল ওরা, রুবিয়ালেস-কে বাধ্য করছিল পদ ছাড়তে। কিন্তু বিপদ সেখানেই শেষ হয়নি। ম্যানেজার হোর্হে ভিলদার বিরুদ্ধেও নিয়মিত যৌন হেনস্তার অভিযোগ করা সত্ত্বেও কোনও লাভ হচ্ছে না দেখে মহিলা জাতীয় দলের খেলোয়াররা শেষমেশ খেলা ছাড়তে বাধ্য হল। এক নির্যাতকের জায়গা অন্যজন নেয়। নির্যাতন চলতে থাকে পূর্বনিয়মে। নিজেদের আর বিশ্বজয়ী মনে হচ্ছে না ওদের, মনে হচ্ছে না এই জয়ের ততটা মূল্য আছে, যতটা মূল্য রয়েছে মেয়েদের জন্য নিরাপদ পৃথিবী তৈরি করায়। ওরা বিশ্বকাপ চায় না, চায় বিশ্বের সব মেয়ের জন্য নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে, উজ্জ্বল সম্ভাবনাসময় পৃথিবী উপহার দিতে। অন্যের চোখে যৌনবস্তু হয়ে থেকে যাওয়া, দ্বিতীয় নাগরিক হয়ে থাকা ওদের বারবার হারিয়ে দিচ্ছে। হারিয়ে দিচ্ছে তাদের প্রত্যেককে, যারা এখনও একটা বারের জন্যও জিততে পারেনি এই লড়াই।
জিততে পারেনি সাক্ষী মালিক, ভিনেশ ফোগাত, বজরঙ্গ পুনিয়ারা। দিল্লিতে দু’-দু’বার ধরনা মঞ্চে বসল ওরা। পুলিশ মেরে মেরে রক্তাক্ত করে দিল ওদের। তবুও এখনও অবধি চার্জশিট তৈরি হল না ‘রেসলিং ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া’-র প্রেসিডেন্ট ব্রিজভূষণ শরণ সিং-এর বিরুদ্ধে। যে দীর্ঘদিন ধরে মহিলা কুস্তিগীরদের ওপর যৌন নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। তার হাঁ মুখ থেকে ছাড়া পাচ্ছে না, এমনকী, কিশোরীও। ছিল মেরে ফেলার হুমকিও! দেশের হয়ে খেলবে না জানিয়েছিল, দেশের গর্ব এই কুস্তিগীররা। কেউ কর্ণপাত করল না। ভারতীয় রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে চক্কর খাচ্ছে যৌন হেনস্তার অভিযোগ।
সরে গেছে স্পেনের মেয়েরা, সরে গেছে সাক্ষী মালিকরা। কিছু কিছু সময় লড়াই থেকে সরে যাওয়া ভাল। কখনও লড়াইটাকে মজবুত করতে, কখনও গ্লানি থেকে মুক্তি পেতে। সব লড়াই সমান নয়। সব লড়াই একভাবে জেতা যায় না। কখনও লড়াই থেকে সরে গিয়েই যুদ্ধটা জিতে নেওয়া যায়। রক্ত ঝরাব তখনই, যখন সেই রক্তের বিনিময়ে জিতে যাওয়ার সম্ভাবনায় আকাশ কমলা হবে। নচেৎ রক্তাক্ত হব না। সেটাও কি জেতা নয়? খেলা ছেড়ে দেব, লেখা ছেড়ে দেব, ছবি আঁকা ছেড়ে দেব, গান গাওয়া ছেড়ে দেব– কিন্তু বেঁচে থাকা ছাড়ব না। সসম্মান বেঁচে থেকে দ্যাখাব বেঁচে থাকা কাকে বলে। তোমাদের দেশীয় আহ্লাদে আমি যোগদান করলাম না, তোমাদের দেশ আমাকে নগ্ন করেছে, তোমাদের দেশ আমাকে বন্দি করেছে। দেশে থেকে দেশে ছড়িয়ে পড়ছে এই ঘোষণা। সাক্ষী মালিকের ঘোষণা শুনেছে জেনিফার হারমোস। জেনিফার কথা শুনতে পাচ্ছে দেশান্তরের মেয়েরা। মেয়েরা আর তোমাদের মাঠে, তোমাদের নিয়মে খেলবে না। তোমাদের নিয়মে বেনিয়মের ধ্বজা ওড়াবে, তোমাদের বিশ্বাসে অবিশ্বাসের জয়গান করবে, তোমাদের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অসহযোগিতা করে যাবে। আজ তারা নিজেদের মাঠ তৈরি করছে, নিজেরা নিয়ম বানাবে, নিজেরা খেলবে, বাঁচবে, হাসবে, অগোছালো থাকবে, আনমনা থাকবে, অসতর্ক থাকবে। পিছনে কেউ সেখানে লুকিয়ে নেই ছোবল মারার জন্য।
এই সরে যাওয়ার মতো সশব্দ, সশস্ত্র বিপ্লব আর কী আছে? গোটা দুনিয়া দেখুক অপমান কাকে বলে, একবার জেনে নিক অসম্মানে বেঁচে থাকার থেকে সরে যাওয়া ভাল। উপেক্ষা আসবে, বলবে, কী লাভ হল সরে গিয়ে? দেশের সম্মান বাঁচাতে পারলে না? নিজে কী পেলে? এতই যদি প্রিয় হয় খেলা, তাহলে ছেড়ে দিয়ে কোন সুখ লাভ করলে? প্রতিযোগিতার মানসিকতা নেই, খেলার জোর নেই। তোমরা ভিতু, তোমরা দুর্বল। শুনে নেব এসব কথা অনায়াসে। যেভাবে আইসল্যান্ডের মেয়েরা শুনে নিয়েছিল। তবুও ফিরে যায়নি সেদিন ঘরে, কাজে, মাঠে।
১৯৭৫ সালে আইসল্যান্ডের ৯০ শতাংশ মেয়ে কাজ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। রেডিও, টেলিভিশন, খবরের কাগজ, ব্যক্তিগত চিঠিতে খবর রটিয়ে দেওয়া হয়েছিল দেশজুড়ে। কর্মক্ষেত্রে পুরুষের সমান বেতন না পাওয়ার বিরুদ্ধে মেয়েরা একজোট হয়েছিল। ২৪ অক্টোবর, দুপুর ২টো ৫-এ খেলার ময়দান ছেড়েছিল তারা। তারা কর্মক্ষেত্র ছেড়েছিল, পরিবারের দেখভাল ছেড়েছিল, রান্না বন্ধ করেছিল, সন্তান লালন-পালন ছেড়েছিল, ঘর সামলানো ছেড়েছিল, দোকান যাওয়া বন্ধ করেছিল। মোটে একদিনের ধরনা। তাতেই আইসল্যান্ডের ব্যবসা-বাণিজ্য ধসে পড়েছিল। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কারখানা, ব্যাঙ্ক। সারি সারি দোকান ঝাঁপ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছিল। পুরুষরা সন্তানদের নিয়ে কর্মক্ষেত্রে গিয়েছিল, ঘরে ঘরে টেলিফোন বেজে যাচ্ছিল, ফোন ধরার জন্য ঘরে কেউ ছিল না। কিছুক্ষণের মধ্যে দোকানে সসেজ ফুরিয়ে গিয়েছিল, কারণ পুরুষরা সসেজ ছাড়া অন্য কিছু রান্না করতে পারেনি। মেয়েরা সেদিন সব ছেড়ে রাস্তায় এসে জড়ো হয়েছিল। সশব্দে।
ওই ভিড়েই ছিলেন এক মহিলা, স্বামীহীন, এক কন্যাসন্তানের হাত ধরে। এই ঘটনার পাঁচ বছর পর দেশের প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট হলেন সেই মহিলা, ভিগদিস ফিনবোগাদত্তির। ভুল বললাম, পৃথিবীর প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট। পাঁচ বছর লেগেছিল। কিন্তু ছেড়ে আসা লড়াই জিতে গিয়েছিল আইসল্যান্ডের মেয়েরা। আজ সে দেশে নারী ও পুরুষের বেতন সমান।