দুই বোন মিলে গড়ে তোলেন ফুলবাহিনী– চন্দ্রমল্লিকা। মহিবা খুরশিদ ও আরাবিয়া খুরশিদ। এই সামাজিক সংস্থা ধীরে ধীরে সশস্ত্র সংস্থা হয়ে ওঠে। মায়ের কোলে দশ বছরের ফিলিস্তিনি শিশুকে মাথায় গুলি খেতে দেখেন মহিবা। বদলে যায় তাঁর দেখার অহিংস চোখ। এলাকায় ফিলিস্তিনি জনসংখ্যা শেষ হয়ে যেতে দেখেন চোখের সামনে। তারপর শেষমেশ উদ্বাস্তু জীবন বেছে নিতে হয়। জাতিগতভাবে নির্মূল হতে থাকা ফিলিস্তিনি জনসংখ্যার সামনে কোনও মহিলা ইউনিয়নের আনুষ্ঠানিক সংগঠন ছিল না তখনও। তবু কাজ থেমে থাকেনি। উদ্বাস্তু মহিলাদের প্রতিরোধ ছিল অব্যহত। গাজা-সহ বিপুল এলাকা ইজরায়েলের দখলে চলে যাওয়ার পর ফিলিস্তিনি মহিলারা ঝাঁপায় একযোগে।
আজকেও সংঘাত অব্যহত। ইজরায়েলি হত্যাযজ্ঞে নিহত বহু নারী থেকে শিশু। শিশুহত্যার সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে, এত বড় নৃসংশতা পৃথিবী এর আগে কমই দেখেছে। ফিলিস্তিনি নারীরা মৃত্যুস্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে শান্তির দাবি জানাচ্ছে। কিন্তু সেই দাবি আত্মপরিচয়ের প্রশ্নকে সামনে রেখেই। দেশহারা, জমিহারা মেয়েরা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে নিজের মাতৃভূমির জন্য। কিন্তু এ লড়াই ফিলিস্তিনি মহিলাদের আজকের নয়।
১৯৩৬। ফিলিস্তিনি ঐতিহাসিক সুবি বিয়াদসেহ বাকা আল গারবিয়াহ গ্রামের একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে নারীদের প্রতিরোধের উদাহরণ দিয়েছেন। ব্রিটিশরা গ্রামের সমস্ত পুরুষকে বন্দি করেছিল। তারপর মেয়েরা তাদের সন্তান বুকে নিয়ে থরে থরে পাথর সাজিয়েছিল। সামরিক ব্যারাকের দখল নিয়েছিল। অবশেষে মুক্তি অর্জনে সফলও হয়েছিল। প্যালেস্তিনীয় নারীরা যুদ্ধক্ষেত্রেই বেড়ে ওঠে, তারা জানে কীভাবে লড়াইয়ের জমি শক্ত করতে হয়। কীভাবে ব্যারিকেড গড়ে তুলতে হয়। ফিলিস্তিনি মহিলাদের হত্যালীলা বাড়তে থাকলে সংগঠিতভাবে শক্তিশালী করে তোলে নিজেদের ওরা। গড়ে ইউনিয়ন। অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বিষয়ের উন্নতি নিয়ে ভাবার সঙ্গে সঙ্গে আরব নেতাদের সাহায্যের জন্য আবেদনও করতে থাকে। ভূমির অধিকার ফিরে পেতে বধ্য পরিকর তারা। তখন থেকেই মা-বোন-স্ত্রীর ভূমিকা থেকে বেরিয়ে এসে যুদ্ধের জন্য গয়না বেচা থেকে খাদ্য সরবরাহ-সহ সশস্ত্র প্রতিরোধে শামিল হয় ফিলিস্তিনি নারীরা।
দুই বোন মিলে গড়ে তোলেন ফুলবাহিনী– চন্দ্রমল্লিকা। মহিবা খুরশিদ ও আরাবিয়া খুরশিদ। এই সামাজিক সংস্থা ধীরে ধীরে সশস্ত্র সংস্থা হয়ে ওঠে। মায়ের কোলে দশ বছরের ফিলিস্তিনি শিশুকে মাথায় গুলি খেতে দেখেন মহিবা। বদলে যায় তাঁর দেখার অহিংস চোখ। এলাকায় ফিলিস্তিনি জনসংখ্যা শেষ হয়ে যেতে দেখেন চোখের সামনে। তারপর শেষমেশ উদ্বাস্তু জীবন বেছে নিতে হয়। জাতিগতভাবে নির্মূল হতে থাকা ফিলিস্তিনি জনসংখ্যার সামনে কোনও মহিলা ইউনিয়নের আনুষ্ঠানিক সংগঠন ছিল না তখনও। তবু কাজ থেমে থাকেনি। উদ্বাস্তু মহিলাদের নিয়ে সামাজিক কর্মকাণ্ড ছিল অব্যহত। গাজা-সহ বিপুল এলাকা ইজরায়েলের দখলে চলে যাওয়ার পর ফিলিস্তিনি মহিলারা ঝাঁপায় একযোগে। প্রকাশ্যে সক্রিয় হয় সশস্ত্র নারী আন্দোলন। শাদিয়া আবু গাজালাহ ফিলিস্তিন ত্যাগে অস্বীকার করেন। ১৯ বছরেই নিজের তৈরি বোমার বিস্ফোরণে নিজের শহরে নিহত হন। লীলা খালেদ ‘পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অফ প্যালেস্তাইন’-এর অন্যতম সদস্য, বিমান হাইজ্যাক করেন। এই কাজের জন্য তাঁর ছিল সৎ ও সরল স্বীকারোক্তি– আমার জনগণের জন্য সংগ্রামে আমার অবদান। বিশ্বের কাছে তাঁর ঘোষণা দেওয়ার ছিল ফিলিস্তিনিরা অন্যায়ের মধ্যে বাস করছে, তাদের পাশে এসে যেন গোটা বিশ্ব দাঁড়ায়। লীলা খালেদ বিমান হাইজ্যাক করে কাউকে আঘাত করেননি। বার্তা দিতে চেয়েছিলেন, প্রতিরোধ ছাড়া মুক্তি পাওয়া যায় না। শুধু বিক্ষোভ নয়, দরকারে অস্ত্র ব্যবহার ও তা জনপ্রিয় করার জন্য মহিলারা প্রস্তুত। দালাল মোগরাবি এক যাত্রীভরা বাস হাইজ্যাক করেন। ‘প্যালেস্তাইন অথরিটি’ গড়ে ওঠার আগে ইজরায়েলের সহিংস দখলদারির সামনে মহিলারা সমানভাবে প্রতিরোধ গড়ে। ইজরায়েলি আক্রমণের দ্বিতীয় দফায় ফিলস্তিনি মহিলারা প্রবল প্রতিরোধে নামে। আত্মঘাতী বোমা হামলায় শরিক হন। শরণার্থী শিবিরে বাস করা অষ্টাদশী আয়াত আল আখরাস নিজের শরীরে বাঁধা বোমার বিস্ফোরণ ঘটান।
স্কুলে খেলার মাঠেই নিহত হয়েছে দশ বছরের মেয়ে নোরান দিইব। গ্রেপ্তার হয়েছে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি নারী। দুই মাসের শিশু গর্ভে নিয়ে জেলবন্দি সমর সাবিহ ছিল মাসকুবিয়া শিবিরে। ৬৬ দিন চলা ১৮ ঘণ্টার জিজ্ঞাসাবাদে তাঁকে গর্ভপাতের হুমকি দেওয়া হয়েছিল। হাত-পা ছিল বাঁধা। জোর করে সিজারিয়ান ডেলিভারি করা হয়েছিল। মাত্র ৩০ মিনিটের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছিল হাত। মায়সুন আল হায়েকের ঘটনা মন ভারাক্রান্ত করে। পরিবার-সহ গুলি খেয়ে লিফটে জন্ম দেন কন্যার। পরে জানতে পারেন স্বামী মৃত এবং শ্বশুর ৪০ দিন কোমায় থাকার পর ফুসফুসে বুলেট লাগার কারণে মারা যান। সামরিক চেকপোস্টে আটকে দেওয়া হয়েছিল ৬৯ জন গর্ভবতী মায়েদের। হাসপাতাল যেতে দিতে অস্বীকার ও দেরি করায় প্রায় ৩৫ জন নবজাতকের প্রাণ যায়। গর্ভবতীরা নবজাতকের জন্য পান না সঠিক যত্ন ও চিকিৎসা। আন্তর্জাতিক নিয়ম লঙ্ঘন করে রাখা হয়নি মহিলা বন্দিদের জিজ্ঞাসাবাদ, পাহাড়া ও দর্শনের জন্য মহিলা পরিদর্শক ও কর্মী। বদলে রয়েছে স্ট্রিপ সার্চ, মার, হেনস্তা, স্বীকারোক্তি আদায়ের পিতৃতান্ত্রিক কৌশল। ‘নারীর মুক্তি ছাড়া স্বাধীন নয় স্বদেশ’– এই ব্যানারে পথ উত্তাল করে মিছিলে গলা ফাটায় ওরা।
১৫ শতাংশের বেশি কর্মজীবী ফিলিস্তিনি মহিলাদের জুড়ে থাকার বড় জায়গা ছিল অলিভ বা জলপাই উৎপাদন। পরিবারের আয়ের পথ দেখাত এই গাছ। জলপাই ছিল সম্মান, সাধনা ও মনোবলে অবিচল থাকার প্রতীক। জলপাই পাড়ার জন্য কাজে ঘোষিত ছুটি মিলত ওদের। এই গাছ ইজরায়েলি সেনা হাজারে হাজারে নষ্ট করে দেয়। গাছ হারিয়ে প্রিয়জন হারানোর মতোই শোকে কাঁদত ওরা। রিমা কারিউতি জলপাই গাছ রক্ষায় নেমেছিল ভয়, হয়রানি উপেক্ষা করে। আয়ের উৎস ও শৈল্পিক অনুপ্রেরণা ছাড়াও জলপাই, সুস্বাস্থ্য-পুষ্টি, খাদ্য ও রন্ধন সংস্কৃতির সঙ্গে ছিল জড়িয়ে। কবি ফাদোয়া তুকান, জলপাই গাছকে মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে ঐক্যের বাঁধন এবং ফিলিস্তনিদের পুনর্নবীকরণের ও পুনর্জন্মের আশার প্রতীক হিসেবে দেখেছিলেন। এই গাছ বাঁচানো এবং পুনরায় রোপণ আসলে ফিলিস্তিনি নারীদের পরিবার, রান্নাঘর, খাবার টেবিল সাজিয়ে রাখার লড়াই ছিল।
আবারও ফিলিস্তিনি নারীরা নতুন করে তুলে দিচ্ছে প্রসঙ্গ। আলোচনা। যা ঘুরেফিরে সমষ্টিগত জীবনকেই চেনায়। আন্দোলন আসলে যখন এক আটপৌরে অভ্যাস। এক লাগাতার জীবনমুখী প্রক্রিয়া। বিশ্বের নানা নারী আন্দোলনের ইতিহাস দেখিয়ে এসেছে, নারী আন্দোলন মানেই শুধু নারীদের সমস্যা অগ্রাধিকার দেওয়া, এমনটা নয়। দেশের প্রায় সমস্ত মানুষ যখন তাদের মানবিক ও জাতীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তখনও নারী আন্দোলন প্রাসঙ্গিক। প্যালেস্তাইনের ইতিহাসের পাতায় পাতায় সেই কথার রেশ খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিরোধে নারীদের ভূমিকা ছিল আম নাগরিকের যুদ্ধরত অবস্থানই।
ফিলিস্তিনি মহিলারা তাদের একমাত্রিক সংগ্রামের সঙ্গে সুস্থ জীবনের দাবী ও অধিকারবোধের নানা ধারার মিলন ঘটিয়েছে। সাংস্কৃতিক থেকে সহিংস, আন্দোলনের সব খাতেই বয়ে গেছে রাতের ঘুমটুকুর খোঁজ।