তোবড়ানো কেটলির কানা, তা’ বলে কি চা খাব না? একা হোক দোকা হোক, কিংবা সপরিবারায়ঃ, শ্রান্ত মন্দ্র ময়দানে উষ্ণতার টানে ভ্রাম্যমাণ চাওলাই সহায়ঃ। বিশ্ব চা দিবসের প্রাক্কালে তাই বেরিয়ে পড়েছিলাম, ময়দানে, ময়দানি চা-ওলার সঙ্গে খোশ জমাতে। পূর্বতন অভিজ্ঞতার বশেই, ধান্দা ছিল, চা-ওলাকেই তার বানানো চা খাওয়াব। তারপর বলতে বলব, ওয়াহঃ। কিন্তু, পৌঁছে দেখি, কোথায় চা! দারুণ দহনদিনে, এ তো নিম্বুপানির বিজনেস সামিট! সেখানে লিফলেট বিলি করার কিঞ্চিৎ সুযোগ পেয়েছে মশলামুড়ি পাপড়িচাট। দূরে-দূরান্তে চোখ ছোট করে একখান সাইকেল নজরে এল, কেরিয়ারে বেশ ইস্পাত আধার ঝোলানো। দিলাম হাঁক। কাছে এসে জানা গেল, ইডলি-দোসা! ক্ষমা চেয়ে নিয়ে হতাশ হয়ে যখন চোখ কিঞ্চিৎ ঘাসের দিকে রেখেছি, দেখি দূরে এক ছোট্ট ঢিপির মতো পশরা, আর তার উপর মরীচিকার কাঁপন। কিন্তু, আপাতত ওটাই মরুদ্যান। সত্য ভ্রমে পরিণত হওয়ার আগে ছুট মারলাম। এবং দেখা হল মিস্টার কামেশ্বর যাদব-এর সঙ্গে। আলাপ জমল। রোববার.ইন-এর তরফে তাঁর সঙ্গে খোশগপ্পে মাতলেন সুপ্রিয় মিত্র।
‘মিস্টারটা বাদ দেওয়া যাবে না।’ কামেশ্বরবাবুর মেজাজি সমন। রবিবারের মেদুর বেলায় সবে মাংস-ভাত নিয়ে বসেছেন, ওভেনের আঁচ করে দেওয়া আছে ঢিমে। ওভেনেরই পরতে ঝুলছে হরেক কিসিমের গুটকা, কফি শ্যাশে, এবং কৌটোয় সিগারেট। বিছিয়ে নিয়েছেন ট্রাফিক পুলিশের সতর্কবাণীবাহী ফ্লেক্স। শার্ট খুলে ঘরোয়া মেজাজে বাবু হয়ে বসেছেন, কাগজের থালা পেতে। মাংস চিবোতে চিবোতেই গপ্প জমালেন। হিন্দি-বাংলা মেলানো মেশানো, সেই কথোপকথন, যথাসাধ্য বাংলায় তুলে ধরা হল।
দাদা, চা হবে?
আরে দৌড়কে আয়ে হো, পহেলে নিম্বু পানি পিও।
না, না, ঠিকাছে। চা হবে না?
সোব হোবে। লেবু চা চলবে? গরম থাকলে চা, ফুঁ দিলেই শরবত। কাজও হয়ে যাবে!
আপনি তো বেড়ে লোক মশাই। তা জানেন, আগামী কাল বিশ্ব চা দিবস?
তাই? ছুট্টি আছে না কি? কিছু হবেটবে এখানে? তবে আমাদের তাতে ছুটি হবে না। চা দিবসে তো চা-ই বেশি পিতে হবে, কী বলেন! তবে দাদা, এই গরমে কেউ চা দিবস করে!
মানে, চায়ের এখন সেল কম যাচ্ছে?
সেরকমও না। বাঙালিরা সারাক্ষণ চা খেতে পারে। কিন্তু, দুপুরে এই খোলা মাঠে কে চা খাবে, বলুন! একটু তো সেল কমেছে। লোক কম আসে। কিন্তু যতজন আসে, বেশিরভাগই চা খায়-ই খায়। লোক বেশি হলে, বেশি বিক্রি। লোক কম হলে, কম বিক্রি। কিন্তু, লোক আছে, চা খাচ্ছে না, এমনটা ময়দানে কম। এমনকী, এমনিতে হয়তো চা খায়-ই না, কিন্তু ময়দানে এসে চা খায়-ই খায়।
তাহলে, এরকম মাহোলে যখন চা না-খাওয়া লোকও চা চেয়ে ফেলে, আপনার মনে হয় না, আপনাদের চায়ের কোয়ালিটি ভাল করা উচিত। জলটা ঠিকঠাক দিলেই তো চায়ের স্বাদ চলে আসে। কেন খেয়াল রাখেন না?
আপনি বলছেন, আমার চা খারাপ? এরকম ইন্টারভিউ আমি দেব না।
আরে চটছেন কেন? কেউ কখনও বলেনি চা খেয়ে যে, চা-টা ভালো হয়নি?
সেটা তো আলাদা মুদ্দা। আপনি যেভাবে বলছেন, তাতে অপমান আছে। দশ টাকায় চা বেচি, বইতে বইতে হাত ভারী হয়ে যায়। সেটা বড় কথা নয়। জলের কথা যে বলছেন, ওটা মিনারেল ওয়াটার। আমরা মিনারেল ওয়াটারে চা করলে, চায়ের দাম ২০ টাকা, আপনি নিজে দিতে রাজি হবেন? তখন তো বলবেন, চায়ে সুগার ফ্রি দিন। এখানে মানুষ চা বলতে ওই গরম ব্যাপারটাই খোঁজে। অত স্বাদটাদ লাগলে নিম্বু চিপে নিন। কফি মিশিয়ে দিলে আরও উমদা!
কত বছর হল, ময়দানে চা বেচছেন?
তা ১৫ বছর হয়ে গেল। (ইতিমধ্যে, আমাদের কথোপকথনের ছররায় জড়ো হয়েছেন আরও কয়েক জন চা-ওলা, হকার। তাঁদেরই একজন হাত তুলে বলে উঠলেন, আমি ৩০ বছর হল এই ময়দানে চক্কর কাটছি দাদা। কিছুতেই নাম বললেন না। ময়দানের বইমেলায় আগুন দেখেছেন, চা বিক্রি করতেন তখন, এখন মশলামুড়ি।)
কীভাবে এলেন এই প্রফেশনে?
কলকাত্তায় গাড়ি চালাত আমার এক মাসতুতো ভাই। আমি বিহারে তখন কলমিস্ত্রির কাজ করতাম। তার আগে গাড়ি সারানোর কাজ করতাম, কখনও মুটেগিরির কাজও করেছি। কিন্তু ভালো আয় হচ্ছিল না। তখন সেই ভাই আমাকে বলল, কলকাত্তায় চলে আসতে। এখানে চায়ের ব্যবসা ভাল। কিন্তু দোকানপাট না করে, ঘুরে ঘুরে চা বিক্রি করলে, কাউকে হপ্তাও দিতে হবে না। পুরো খাটনি নিজের পকেটে।
এখানে কাউকে হপ্তা দিতে হয় না?
না। ময়দানে এই ঘুরে ঘুরে ব্যবসা করতে গেলে, ময়দান থানার পারমিশন নিতে লাগে।
তা, একদম প্রথমে যখন এলেন, কেমন লাগত? এখনই বা কেমন লাগে? এত বছর ধরে একটাই মাঠে ঘুরে ঘুরে চা বিক্রি করছেন, বিরক্ত লাগে না?
প্রথম প্রথম যখন এসছিলাম, তখন বয়স আরও কম ছিল। ভাল লাগত। একমাসে যা জমত, তাই নিয়ে বাড়ি চলে যেতাম এক হপ্তার জন্য। প্রচুর পরিবার আসত। নতুন কালচার, নতুন হাওয়া। ভালোই লাগত। কাজ মানে তো আসলে লোক দেখা, দাদা। যত লোকের সঙ্গে কথা, তত বড় জীবন দাদা, মনে রাখবেন। টাকাপয়সা কী হবে, আজ আছে কাল নেই। মা-বাপ-বিবি-বেটা-বেটি সব পরায়া। ওই আর কী, ফ্যামিলি মানে কম পরায়া। এখন তিন-চার মাস অন্তর যাই ওই এক হপ্তার জন্যই। এখন আর অত গল্প ভালো লাগে না। চা থেকে গেলে, মাথা যন্ত্রণা হয়ে যায়। কত আর নিজের চা খেয়ে মাথাব্যথা কমাব।
এই যে বললেন, প্রচুর পরিবার আসত। এখন আর আসে না?
না দাদা। এত মেহঙ্গাই বাজারে, বাইরে বেরনো মানেই তো খরচা। মানুষ আর কোতো টানবে?
তাহলে, আপনার এখন কাস্টোমার বেস কারা?
ওই প্যায়ার কা চক্করে যারা আসে, যারা খেলতে আসে, অনেকে এমনিই একা একা আসে। ওদের সঙ্গেই বেশি গল্পগাছা হয়।
তাহলে এদের খরচ হয় না?
আরে দাদা, প্যয়ার কোরবে, এটুকু তো খরচ করবেই। এই বয়সে খরচের অত হিসাব থাকে না। সংসার পাতবে, তাহলে না বুঝবে খরচের ব্যাপার। কিন্তু, সরকারকে বুঝতে হবে। সরকার না বুঝলে তো ঘরে ঘরে রাগারাগি হয়ে যাবে, কী ঠিক বলছি? আর, যারা খেলতে আসে, তারা তো ছোট ছেলেপুলে। ওদের এখন বাপের মেরে খাওয়ার সময়। আমি এখানে খাটছি, আমার ছেলে বিহারে আমার মেরে খাচ্ছে। ওসব চলবে দাদা। অত ভাবলে চলবে না।
আচ্ছা, জানেন তো, চা বাগানের শ্রমিকদের ইউনিয়ন আছে। আপনাদের ইউনিয়ন নেই?
আমাদের কোনও ইউনিয়ন নেই দাদা। যে যার মতো ব্যবসা করছে। কিন্তু বেরাদরি আছে।
বেরাদরি বলতে? ময়দানে কি সকলেই বিহারি চা-ওলা?
হ্যাঁ। মোট বিশ জন চা বিক্রি করে এখন ময়দানে। ওদিকে ঘোড়শাল বস্তি, ওদিকে এসপ্লানেড, জানবাজার, ক্যামাক স্ট্রিট, এদিকে ভবানীপুর থেকে আসে চা-ওলারা।
বাঙালি চা-ওলা নেই কেন?
বাঙালি থাকবে না কেন। আমরা সেই ১৪-১৫ বছর আগে তিন টাকা পাঁচ টাকায় চা বেচতাম। এখন বাজারের দাম বেড়েছে, জিনিসের দাম বেড়েছে, একটাই দাম এখন ১০ টাকা। কিন্তু বাঙালি এসে, আমাদের টেক্কা দিতে ওই একই পরিমাণ চা পাঁচ টাকায় বেচবে। কেন ভাই? তুমিও ১০ টাকায় বেচো। এখন তাই এখানে বেচে না, অন্য কোথাও বেচে হয়তো।
তা, মাসে কত কেজি চা লাগে আপনার?
ওই পাঁচ কেজি খানেক। তাতেই হয়ে যায়। রোজ ওই দুশো গ্রাম মতো চা-গুঁড়োয় ব্যবসা হয়ে যায়।
১৫ বছর ধরে ময়দান দেখছেন। এখন কী তফাত দেখেন?
অনেক তফাত। ওই যে, পরিবার আর তেমন আসে না। লাভাররাই বেশি আসে। মুখ চেনা হয়ে যায়। তাদের আর দেখতে না পেলে বুঝতে পারি, হয় সম্পর্ক ভেঙে গেছে, নয়তো বিয়ে হয়ে গেছে। খরচ বাঁচাতে আর আসে না। হা হা হা, বুঝলেন তো? আগেও লাভার ছিল, কিন্তু এখন যেন একটু বেশি খুল্লমখুল্লা হয়ে গেছে। আগে রাত অবধি ময়দানে বসা যেত। এখন পুলিশ আর বসতে দেয় না। তাতে আমাদের ব্যবসা অনেকটাই ক্ষতি হয়েছে।
এখন ক’টা থেকে ক’টা ব্যবসা চলে?
গরমের সময় ওই ভোর-সকাল থেকে বারোটা অবধি। তারপর আবার তিনটে থেকে সন্ধে আটটা। শীতকালে সকাল থেকে সন্ধে আটটা টানা চলে। আগে রাত দশটা, এগারোটা অবধি ব্যবসা করতাম।
পুলিশকে রিকোয়েস্ট করেননি কখনও?
পুলিশ আছে, তাই করে খাচ্ছি দাদা। পুলিশ বারণ করেছে মানে, ভালোর জন্যই করেছে। আমরা সাধাসিধা মানুষ।
তা, বাংলায় থেকে যে ব্যবসা করছেন, বাংলার রাজনীতির সঙ্গে বিহারের রাজনীতি কেমন আলাদা?
অনেক আলাদা। এখানে মানুষজন ঘুরতে পারে মনমর্জি। কেউ কাউকে অত দেখেটেখে না। যে যা করল, করল। বাঙালির ভালো গুণ। কিন্তু, এখন বাংলাতেও পেট মারা হচ্ছে। তাতে লোকের রাগ বাড়ছে। রাগ অন্যদিকে ছুটে যাচ্ছে।
অন্যদিকে ছুটে যাচ্ছে বলতে?
এই রাগারাগি, মারামারি। পেটের জ্বালাই আসল দাদা।
তা এবারে কাকে ভোট দেবেন?
কংগ্রেসকেই দেব। মহিলাদের কথা ভাবছে। সম্মান করে। টাকাও দেবে বলছে বছরে এক লাখ। বিজেপি সম্মান করে না।
ছবি তুলতে পারি আপনার? জামাটা পরে নেবেন একটু?
না, না। জামা পরতে পারব না। খাওয়া হয়ে গেছে, এখন খুশমেজাজে, হিরোর মতো সিগারেট ফুকব। আপনি ছবি তুলতে হলে তুলুন।
তা, কী নাম আপনার?
মিস্টার কামেশ্বর যাদব। মিস্টারটা মনে রাখবেন কিন্তু!
ফোটোগ্রাফি: সুপ্রিয় মিত্র
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
পড়ুন শিয়ালদহ স্টেশনের চা-ফেরিওয়ালা শঙ্কর চক্রবর্তী-র সাক্ষাৎকার: পানীয়র দৌড়ে জলতেষ্টা প্রথম, আর চা-তেষ্টা দ্বিতীয়
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..