যন্ত্র আর শিল্পীর মধ্যে যোগটা আত্মিক। আন্তরিকও। সুরসৃষ্টির সাধনায় মোক্ষলাভই একজন প্রকৃত শিল্পীর মুখ্য উদ্দেশ্য। কিন্তু বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে আরও একজনের যে অন্তরের যোগ রয়েছে। যাঁকে আমরা বাদ্যযন্ত্রের কারিগর রূপে চিনি। তিনিই আদপে সুরলোকের আসল বিশ্বকর্মা। অথচ শিল্পীসত্তার বিচ্ছুরণে আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে যায়। আমরা সেই যন্ত্রপ্রস্তুতকারক মানুষগুলোকে ভুলে যাই। তাঁরাও থেকে যান প্রচারের আলোর বাইরে। তেমনই একজন কালীপদ হাজরা। শান্তিনিকেতনের গোয়ালপাড়ার একদম শেষে পশ্চিমপাড়া। সেখানেই তাঁর বাস। সকলের কাছে তিনি ‘কালোদা’। তাঁর হাতে তৈরি খমক থেকে ডুবকি, একতারা থেকে দোতারা সমাদর পায় গ্রাম থেকে শহর, দেশ থেকে বিদেশে। অথচ লোকচক্ষুর অন্তরালে নীরবে রয়ে গিয়েছেন কালোদা। বিশ্ব সংগীত দিবসে সেই কারিগর কালীপদ হাজরার কথাই তুলে ধরল রোববার.ইন। তাঁর একান্ত সাক্ষাৎকার নিলেন গৌরবকেতন লাহিড়ী।
বোলপুর ঘরানার দোতারা যাঁরা বাজান– তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই ‘কালোদা’র নাম শুনেছেন। ‘কালোদা’ নামেই আপনি অধিক পরিচিত। তবু আপনার পুরো নামটা সকলের জন্য একবার বলবেন?
আমার নাম কালীপদ হাজরা। থাকি গোয়ালপাড়ায়।
আপনি তো শুরুতে দোতারা বানাতেন না?
না, শুরুতে আমি একতারাই বানাতাম। পরে দোতারা বানানোর কাজে হাত দিই।
সেটা কোন সময়?
ওই ধরুন, ২০০৩ সালের দিকে হবে।
কীভাবে বানানো শিখলেন?
আগে বাড়িতে বাবাকে বানাতে দেখেছি। আমার বাবা সুধীর হাজরা ভালো বাদ্যযন্ত্র বানাতেন। বাবাকে দেখেই কাজটা শেখা আমার। বাবা নানারকমের বাদ্যযন্ত্র বানাতেন। গ্রামের ছোট-ছোট ছেলেমেয়ে আবদার করত। কখনও একতারা, কখনও ঢোল বানিয়ে দিত। আমি সঙ্গে থেকে দেখতাম। আমার মধ্যেও একটা কৌতূহল কাজ করত। পরখ করে দেখতাম, কেমন বাজছে। একতারায় সুর আসছে কি না। সেসব থেকেই আমার মধ্যেও বাদ্যযন্ত্র বানানোর ইচ্ছাটা তৈরি হয়েছিল। তখন আমার কতই বা বয়স, পনেরো-ষোলো হবে। তবে গ্রামে বিক্রিবাটা তেমন একটা হত না। তাই বাবা একটা সময়ের পর এসব বানানো বন্ধ করে দেয়।
এই যে বাদ্যযন্ত্র তৈরি, এটাই কি আপনাদের পেশা ছিল?
না, না। বাবা অন্য কাজ করতেন। বাদ্যযন্ত্র বানাতেন শখে। কোনও অর্ডার পেলে, কিংবা পাড়াপড়শির বাচ্চা কেউ বায়না করলে করে দিতেন। গাঁয়ের মানুষ ছিল তো, অনেক হাতের কাজ জানতেন।
আপনি কি শুরু থেকেই পেশাতেই আছেন?
না, প্রথমে এদিক-ওদিক গ্রামে নানা কাজ করতাম। তারপর আস্তে আস্তে যখন এই বাজার-হাট এদিকে চালু হল, দেখতাম, অনেকে বাদ্যযন্ত্র বিক্রি করছে। দেখে আমারও ইচ্ছা জাগল যে, আমিও বানাই। প্রথমে নারকেল দিয়ে একতারা বানাতাম। বোলপুর থেকে দু’-পাঁচ টাকা করে কিনে আনতাম। খুঁটিনাটি বিশেষ তখন কিছুই জানতাম না। বানিয়ে নিয়ে হাটে যেতাম, যেখানে বাদ্যযন্ত্র সব বিক্রি করে। রং করিয়ে আনতাম একতারাগুলো। বেশি না পাঁচটা-ছ’টা করে বানাতাম। বিক্রিও হয়ে যেত। একেকটা ২৫ টাকা, ৩০ টাকায় বেচতাম। দেখতে দেখতে পাঁচটা থেকে দশটা লোক, দশটা থেকে কুড়িটা। তারপর পঞ্চাশটা। এমন করে কেনার লোকের ভিড় বাড়তে লাগল। চাহিদা বাড়ল। আমিও বুঝতে পারলাম, খালি একতারা বানালে হবে না, আরও বাদ্যযন্ত্র বানাতে হবে। তারপর একতারার সঙ্গে সঙ্গে দোতারা বানানোয় হাত দিলাম। তারপর খমক। এখন ডুবকিও বানাই। আরও অনেক কিছু। হাত আসলে সেট হয়ে গিয়েছে।
একতারা আর দোতারা দুটো সম্পূর্ণ আলাদা মেকানিজমের যন্ত্র। দুটো তৈরির পদ্ধতির মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। একতারা তৈরি করা তুলনায় সহজ। কিন্তু দোতারায় অক্ষের দৈর্ঘ্য, খোলের গহ্বরের মাপজোক, সরস্বতীর অবস্থান, প্লেট, কান, মঞ্জরী– সবক’টাই বেশ সূক্ষ্ম এবং জটিল বিষয়। পুরো ব্যাপারটা কীভাবে রপ্ত করলেন, একটু যদি বলেন?
দেখুন, কেউ হাতে ধরে তো শিখিয়ে দেয়নি। দেখে দেখে শিখেছি বলতে পারেন। কাজ করতে করতে হাত সেট হয়ে গিয়েছে। কেউ শিখিয়ে-পড়িয়ে দেয় না। আমাদেরই শিখে নিতে হয়। এখন যদি কেউ এসে বলে আমায় শিখিয়ে দাও, আমি কি শেখাব? না। প্রথমে নিজের ছেলেকে বলব। যদি সে শেখে, ভালো।
যন্ত্রের ক্ষেত্রে, প্রত্যেক কারিগরের তো একটা নিজস্বতা রয়েছে। একটা ছাপ। আপনার যন্ত্রে সেই ছাপটা তৈরি হল কীভাবে?
একদিনে তো সেসব তৈরি হয় না। ধীরে ধীরে হয়। প্রথম প্রথম যখন চার-পাঁচটা দোতারা করতাম, ভালো হত না। একদমই পারতাম না। হয়তো একটা বানানোর চেষ্টা করছি, হঠাৎ মাথাটাই ভেঙেচুরে গেল। এমন হয়েছে। বহুবার হয়েছে। আবার চেষ্টা করতাম। হয়তো কাঠামোটা বানাতে পারলাম। কিন্তু সুরটা ধরল না। কী করব! রেখে দিতাম সেটা। যারা দোতারা বাজায় তারা খবর পেয়ে আসত। নেড়েচেড়ে দেখত, বলত কাঠিটা এ জায়গায় বসাও। সুর আসবে। শুনতাম সেসব। সেই অনুযায়ী করতাম। এভাবেই পথ চলতে চলতে কাজটা শিখেছি।
এখানকার হাটে যে ছোট একতারা পাওয়া যায়, আর যে একতারা বাজিয়ে গান গাওয়া হয় তার মধ্যে তো তফাত আছে। প্রথমটা মূলত শো-পিস, দ্বিতীয়টায় টিউনিং, বেস ইত্যাদি ঠিক রাখতে হয়। ঠিক কবে থেকে মনে হল, ঘর-সাজানোর একতারা ছেড়ে প্রকৃত যন্ত্র বানাবেন?
দেখুন, এখন যে একতারা বা দোতারা বানাই, সেটা গায়কদের কথা ভেবেই বানাই। কিন্তু প্রথমদিকে যখন হাত-মকশোর ব্যাপার ছিল তখন ওইরকম মামুলি একতারা বানিয়েছি। কিন্তু ওগুলো বানাতে বানাতেই হাত সেট হয়েছে। এখন যন্ত্র দেখে বলে দিতে পারব তাতে সুর আসবে কি আসবে না। তবে কী জানেন, আমি পাঁচটা একতারা কিংবা দোতারা বানালাম, পাঁচটাই তো একসুরে যাবে না। চারটে হয়তো ভালো বাজবে, একটা নয়। ওই একটাকে ঠিক করে সুর বসাতে হবে।
এই যন্ত্রগুলোর বিক্রি কেমন হয়?
ভালো যন্ত্র কেনার বা তার কদর করার লোক এখন নেই। কী হয়, আমাদের মতো যারা একতারা বানায়, তারা বাজারে বিক্রির জন্য নিয়ে গেলাম। অন্য অনেকেও বিক্রির জন্য যায়। আমি কাউকে খারাপ বলছি না। আমি হয়তো যন্ত্রটার দাম একশো টাকা বললাম। কেউ বলল, ষাট। লোকে যেটা কম টাকায় সেটা কিনল। দু’দিন পর খারাপ হয়ে যেতে আফসোস করতে লাগবে যে, একটা একতারা কিনেছিলাম, কয়েক দিন যেতে না যেতেই সুর আলগা হয়ে গেল। আসলে দাম দিয়ে ভালো জিনিসটা কেউ এখন আর কিনতে চায় না। সস্তায় চায়। আমরা যেগুলো বানাই সব সুরে বাজবে। কিন্তু সুরের জিনিস কিনতে গেলে দাম দিয়ে কিনতে হবে। সমঝদার যারা হয়, তারা বোঝে, তারা কেনেও। যারা বোঝে না, ঠকে যায়।
একটা কথা বলুন, এখন তো শহরে এই সব বাদ্যযন্ত্রের বিক্রিবাটা অনেক বেড়েছে। সেসব জায়গায় ভালো বাদ্যযন্ত্র এই আপনাদের এলাকা থেকেই যায়। কিন্তু সেসব আপনাদের মারফত না গিয়ে রপ্তানি হয় মিডলম্যানদের হাত ধরে। অনেক সময় শোনা যায়, এখানে বাদ্যযন্ত্রের বিশাল দাম। সত্যি কি তাই?
মিথ্যে কথা। আসলে কী জানেন, আমরা যন্ত্র বুঝি, যন্ত্রের সুর বুঝি। আমাদের কাছ থেকে সরাসরি যাঁরা কেনেন, তাঁরা কখনও ঠকেন না। কিন্ত আজকাল এখান থেকে যন্ত্রপাতি শহরে যায়, সেখানে বিক্রি হয় শুনি। অনেক বাউল এমন ব্যবসা করে থাকে, জানি। তারা আমাদের কাছ থেকে কম দামে জিনিসটা কেনে। হয়তো একটা খমক তাঁকে ৭০০-৮০০ টাকায় দিলাম। সে সেটা শহরে কাউকে ১৫০০-২০০০ টাকায় বেচল। লোকে জানল, জিনিসটার দাম এত বেশি। বাপরে বাপ! আসলে কিন্তু তা নয়। এতে আমাদের ক্ষতি হচ্ছে। যার খরিদ্দার তাদের ক্ষতি হচ্ছে। চাষের ক্ষেত্রে যেমন দালাল থাকে। এখন বাদ্যযন্ত্র কেনাবেচাতেও তেমন দালাল ঢুকে পড়েছে। লাভ তারাই করছে।
আচ্ছা, এতদিন যে এত একতারা, দোতারা বা আরও অনেক বাদ্যযন্ত্র বানালেন। কখনও নিজের বাজানোর ইচ্ছা জাগেনি?
দেখুন, সুর তো আমরা বাজিয়ে পরখ করে নিই। একটা একতারা, দোতারা বানানোর ক্ষেত্রে সবসময় আমাদের খেয়াল রাখতে হয় সুরটা আসছে কি না। সুর ঠিক থাকলে শিল্পীর মনের মতো হলে তবেই না সেটা পছন্দ হবে। তবে এই যন্ত্র বাজানোর চেয়ে বানানোর আনন্দটা অনেক বেশি। যে কিনছে, সে যাতে ভালোটা পায়। দাম দিয়ে খুশি হতে পারে, সেটাই আমাদের লক্ষ্য থাকে।
দোতারার ক্ষেত্রে তো এখন অনেক ইম্প্রোভাইজেশন চায় লোকে। অনেকে বেসটাকে বেশি রাখতে চান। কেউ সানমাইকার প্লেট ব্যবহার করেন কাটা-কাটা সুর পাওয়ার জন্য। আবার অনেকে দোতারায় মীরের কাজ, অর্থাৎ সরোদ কিংবা স্বরাজের মতো বাজ পছন্দ করেন। ফলে দোতারার যে আদিরূপ, তার থেকে বর্তমান দোতারায় অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা, বৈচিত্রের জায়গা তৈরি হয়েছে। আপনি কারিগর হিসেবে কোন ধরনের দোতারা বানাতে বেশি পছন্দ করেন?
যে কোনও জিনিস, যত সিম্পল রাখবেন তত ভালো। দোতারার ক্ষেত্রেও তাই। সিম্পল যত থাকবে তত ভালো বাজবে দোতারা। বেশি বেস থাকলে সেই সুর পাওয়া কঠিন। এখন অনেকে নতুনত্ব আনার চেষ্টা করছে। আমরা সেইরকম চাহিদা মেনে করেও দিচ্ছি। তবে সহজ জিনিসকে সহজ রাখাই ভালো। স্টাইল বেশি হলে মুশকিল। বড় বড় শিল্পীরা কিন্তু আগে কাঠের যন্ত্র, সহজ দোতারা বাজিয়ে গান শুনিয়েছে। সেগুলোই লোকে শুনতে চায়। এখন যেমন শিল্পী, সেইরকম যন্ত্র উঠেছে। এখনকার শিল্পীরা কাঠের যন্ত্র দোতারা, খমক নিয়ে বড় স্টেজে বাজাতে পারবে না।
বোলপুরের অনেক খ্যাতনামা শিল্পীর দোতারা তো আপনি বানিয়ে দিয়েছেন?
আমার যন্ত্র কলকাতায় বেশি চলে। বিদেশেও গিয়েছে। এছাড়া বীরভূমের লক্ষ্ণণদাস বাউল আমার দোতারা ব্যবহার করেন। কঙ্কালীতলার অনেক নামকরা শিল্পী আমার কাছ থেকে যন্ত্র কিনে নিয়ে যায়। বাসুদেব দাস বাউল আমার কাছে নিয়মিত আসতেন। প্রথম বড় দোতারা ওঁর জন্যই বানিয়েছিলাম। উনি আমায় ভালো দোতারা বানানোর জন্য উৎসাহ দিতেন। ওঁর পরামর্শ কাজে লাগিয়ে এখনও কাজ করে চলেছি। ওঁর মতো এত সুন্দর দোতারা আর কাউকে আজ অবধি বাজাতে শুনিনি।
আচ্ছা, লোকমুখে তো আপনার অনেক প্রশংসা শোনা যায়। দোতারা বানানোর ক্ষেত্রে অনেকেই আপনার হাতের ওপর ভরসা করেন। কিন্তু প্রশংসার পাশাপাশি নিন্দাও কি জুটেছে কখনও?
দেখুন, ভগবানের কৃপায় এখনও অবধি যে ক’টা দোতারা বানিয়েছি, ফেরত আসেনি। এটা প্রশংসা বললে বলতেই পারেন। এ আমার প্রাপ্তি। তবে একবার একটা দোতারা ফেরত এসেছিল। এক পরিচিতই দোতারা বানানোর অর্ডার দিয়েছিল। কিন্তু তাগাদা ছিল প্রচুর। যেদিন রং করেছি, তার পরের দিন নিতে হাজির। তো রং শুকোয়নি। সে কী করেছে, দোতারাটাকে ছাদে রোদে শুকোতে দিয়েছে। তাতে কাঠে হালকা চিড় ধরে গিয়েছে। পরে সে আমায় সেটা ফেরত দিয়ে বলে, যন্ত্রটা ফেটে গেল, এ আমায় কেমন যন্ত্র দিলেন! তাঁকে আর কী বলব? বললাম, বেশ, ফেরত দিয়ে যান। আমি সেটা ফেরত নিলাম। তারপরের দিন বোলপুরের এক শিল্পী এসে সেই যন্ত্রটা কিনে নিয়ে গেল। এখনও বাজাচ্ছে। দারুণ চলছে সেটা।
মাসে ক’টা দোতারা বানান?
আমি তো একাই যন্ত্র বানাই। আমার ছেলে আমায় সাহায্য করে। একদিন হয়তো আধঘণ্টা খমক বানালাম। তারপর ডুবকিতে নজর দিলাম। একতারাও বানাই। তবে দোতারা বানাতে তো সময় লাগে। বছরে কুড়ি-পঁচিশটার মতো দোতারা তৈরি হয়। বেশি হয় একতারা, ডুবকি, খমক এগুলোই। হাটেও যেতে হয় আমাকে। ফলে বানানোর দিকে সবসময় নজর দিতে পারি না। তাই এখন কম তৈরি হচ্ছে দোতারা।
দোতারার মতো যে যন্ত্রগুলো– সরোদের কথা বলছি না, কিন্তু স্বরাজ বা রবাবের মতো যন্ত্র–অনেকেই তো শিখে বানান! আপনার তেমন কোনও পরিকল্পনা নেই?
না, এই মুহূর্তে তো নেই। আমি যা বানাতে পারি। আমি সেগুলোই বানাব। নতুন করে কিছু বানাব না। দোতারা, খমক, ডুবকি আর একতারা– এগুলিই পাবেন আমার কাছে। যাঁরা কেনে, তাঁদের চাহিদাও এটা। আমার কাছে তাঁরা এসবই চায়। আমি সেইগুলোই বানাব। অনেক সময় এমন হয়, আমি দিয়ে শেষ করতে পারি না।
যন্ত্রের সঙ্গে একজন শিল্পীর একধরনের আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিন্তু যাঁরা যন্ত্রটা বানান, আপনারা, আপনাদের সঙ্গে যন্ত্রের কোনও মানসিক সংযোগ গড়ে ওঠে না?
একটা মনের যোগ তো থাকে। নিষ্ঠা না থাকলে যন্ত্র বানানো যায় না। যন্ত্র আসলে কী? একটা কাঠের কাঠামো। তার ওপর চাম (চামড়া) লাগিয়ে, চারটে তার বসিয়ে, পালিশ করে, কারুকার্য করে কারিগর তুলে দেয় শিল্পীর হাতে। তাতে যখন সুর তোলে শিল্পী, যন্ত্র প্রাণ পায়। যে বানাচ্ছে, তাকেও মনোযোগ দিয়ে সেটা তৈরি করতে হয়। ধাপে ধাপে। তার জন্য সময় লাগে। খাটাখাটনি আছে। দেখবেন, প্রতিমা যে গড়ে, আশ্বিনে পুজো হলে সে মূর্তি গড়ায় হাত দেয় কত আগে। প্রথমে খড়ের কাঠামো, তারপর মাটি। তারপর রং-তুলির কাজ। ধাপে ধাপে সব হয়। নিষ্ঠা লাগে। ধৈর্য লাগে। আমাদের ক্ষেত্রেও তাই।
ভালো যন্ত্র পেলে শিল্পী বাজিয়ে সুখ পান। তাঁর নাম-যশ হয়। কিন্তু আপনারা, যাঁরা যন্ত্র বানান তাঁরা সবসময় প্রচারের আড়ালেই থেকে যান। খারাপ লাগে না?
না, খারাপ লাগবে কেন? আমাদের কাজই তো যন্ত্র তৈরি করে দেওয়া। আমার আনন্দ যে লোকে আমার কাছে আসে, বিশ্বাস করে যে, কালোদা ভালো যন্ত্র বেচে, বেশি দাম নেয় না। দূরদূরান্ত থেকে শহর থেকে লোক আসে কিনতে। তারা সুনাম করে যখন তখন ভালো লাগে। এটাই তো নেশা। আমি টাকায় চেপে কী করব, তার চেয়ে লোকে ভালো বললেই আমার মনের শান্তি।
আপনার জন্ম তো এখানেই?
হ্যাঁ। আমার জন্ম এখানেই। বড়ও হয়েছি এখানে।
ছোটবেলা থেকে তাহলে তো প্রচুর লোকসংগীত, বাউল-ফকিরি গান আপনি শুনেছেন?
ছোটবেলায় এক ফকির আসত পাড়াতে। বাড়ি বাড়ি ভিখ চাইত হাতের দোতারা বাজিয়ে। আমি অবাক হয়ে ওর যন্ত্রটাই দেখতাম। মনে হত, গানটা ওখান থেকে হচ্ছে। এমন কতদিন হয়েছে, ফকির-বাউলের পিছু নিয়েছি। গান আমায় টানত না, টানত ওই হাতের যন্ত্রটা।
গান শোনেন এখন? কার কার গান শুনতে ভালো লাগে?
এখনকার কোনও শিল্পীর গান ভালো লাগে না। পছন্দের শিল্পী বলতে বাসুদা, লক্ষ্ণণদার গান খুব ভালো লাগত। নিমাইদাস বাউলের গানও ভালো লাগত। শুনতাম। আমার কাছ থেকে উনি খমক নিয়েছিলেন। বাউল তো এখন আর চট করে কেউ গায় না। সেই চাহিদাটাও অনেক কমে গিয়েছে। বড় বড় শিল্পীদের অন্যদিকে ঝোঁক। এখন সবার নাচা-গানের দিকে বেশি ঝোঁক। শিল্পীও তাই। স্টেজে গিটার হাতে গাইবে। সবাই হাততালি দেবে, মিউজিক বাজবে। এসবেই খুশি। আগেকার শিল্পীদের সঙ্গে এখনকার শিল্পীদের অনেক তফাত।
আপনার কখনও মনে হয়েছে, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে একতারা-দোতারা না বানিয়ে গিটার বা ব্যাঞ্জো বানাই?
না। কখনও মনে হয় না। আসলে এই যে বানাই, এটাই আমার আনন্দ। আমি যা শিখেছি, রপ্ত করেছি, আমার ছেলে জয়ন্তকেও তাই শিখিয়েছি। সে-ও এটাকেই ভালোবাসে। আমার মতো সে-ও একতারা, দোতারা, ডুবকি, খমকই বানাবে। অন্যকিছু নয়।
আপনার ছেলেও কখনও গিটার বানাবে না?
না। বানাবে না। ও নিজেই বলে, ডুবকি, খমক, একতারা বানিয়ে খুশি। পড়াশুনো ছেড়ে ও এই কাজে ডুবে থাকে। নিজেও বাজায়।
লোকবাদ্যগুলোর ক্ষেত্রে বেশ কিছু গুপ্ত টেকনিক থাকে। মানে সূক্ষ্ম কিছু ব্যাপার। সেগুলো রপ্ত করতে সময় লাগে– শিল্পী বা যন্ত্রী উভয়েরই। সেটা রপ্ত করলেন কীভাবে?
একদিনে তো হয়নি। যন্ত্র বানাতে বানাতে শিখেছি। এই ধরুন খমক, ওটায় তো একবারেই সুর আসবে না। অল্প অল্প করে তার ছাড়তে হবে। পরখ করতে হবে। তারপরে সুর বসবে ঠিকঠাক। চামড়ার ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করে।
কী চামড়া ব্যবহার করেন আপনি?
ছাগলের। ভেড়ার চামড়া পাতলা হয়। তাই ছাগলের চামড়া ভালো চলে। চামড়া ভালো না দিলে ডুবকি ভালো বাজবে না। একতারা, দোতারা যেমন হলেই হল, কিন্তু ডুবকি-তে ভালো চামড়া লাগবেই।
আচ্ছা, এই যে দোতারার কাঠামোটা, বিভিন্ন কারিগর বিভিন্ন কাঠ ব্যবহার করেন। সম্প্রতি আমকাঠের দোতারাও বানাতে দেখেছি একজনকে। আপনি প্রধানত কোন কাঠের দোতারা বানান?
নিম কাঠ খুব ভালো। হালকা। সবচেয়ে ভালো হল কাঁঠাল। তবে সবসময় মেলে না। দামও বেশি। কদম কাঠেও ভালো দোতারা হয়।
কারিগর হিসেবে এই যে যন্ত্রের কাজ করেন, এই ব্যবসার কোন ভবিষ্যৎ দেখেন?
ভবিষ্যৎ ভালো না খারাপ হবে, সে তো বলতে পারব না। কিন্তু তখন যারা থাকবে তাদের এগিয়ে আসতে হবে। কাজটাকে অবহেলা, অশ্রদ্ধা করলে চলবে না। ভালোবেসে কাজ করতে হবে। টাকা কামানোর কথা ভাবলে চলবে না। নয়তো এসব হারিয়ে যাবে, শহরের মিউজিকে যেমন সব হয়, সেসবই চলবে।
শেষ প্রশ্ন। কারিগর জীবনে কোনও আক্ষেপ আছে কালোদা, কোনও দুঃখ?
না। তেমন কিছু নেই। লোকে আমার নাম করে, ভালো যন্ত্র পায় বলে, আমার কাছে। যন্ত্রের আওয়াজ শুনে খোঁজ করে কোন জায়গায় কেনা। শিল্পীরা আমার নাম বলে। অনেকে বলে না। ভাবে, কিনে এনেছি টাকা দিয়ে। কারিগরের নাম বলব কেন! কিন্তু যারা আমার নাম করে, তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তাদের আরও নামযশ হোক। ভালো বাজাক। ভালো গান করতে গেলে, এই কাঠের যন্ত্রই বাজাতে হবে। এই একতারা, দোতারা, খমক, ডুবকি বাজাতে হবে। এগুলো বানিয়েই আমার আনন্দ। আমার কোনও দুঃখ নেই।
প্রতিটি ছবিই গৌরবকেতন লাহিড়ীর তোলা।