কমলালেবুর বাকল আর রস দিয়ে আমার বাবা ননী পাল প্রথম ভেবেছিলেন কমলাভোগ তৈরির কথা
Published by: Robbar Digital
Posted on: February 20, 2025 6:52 pm
Updated: February 20, 2025 6:58 pm
বাংলার ভেনঘর কোনও ল্যাবরেটরির চেয়ে কম কিছু নয়। কত যত্নে, কত স্বপ্নে বুকে নিয়ে, হাজারও পরিশ্রম, প্রতিকূলতা পেরিয়ে বাংলার এক একটি মিষ্টির জন্ম হয়েছে। উত্তরের মাদারিহাটে কমলাভোগের জন্ম। মাদারিহাটে রয়েছে ননী পালের মিষ্টির দোকান (সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের উল্টো দিকে)। ননী পাল সুইটসের বয়স ৮০ বছরেরও বেশি। আজ থেকে বছর ৭০-৮০ বছর আগে ননী পাল প্রথম কমলাভোগ তৈরি করেন। সারা বছর কমলালেবু পাওয়া যাওয়া না, তাই শীতের কমলালেবুর খোসা সংরক্ষণ করা হয়। সংরক্ষিত খোসাগুলি ছানার সঙ্গে মিশিয়ে মিষ্টি তৈরি করা হয়। কমলাভোগ আবিষ্কারের কাহিনি রূপকথার চেয়ে কম নয়। সে কাহিনি জানিয়েছেন ননী পালের পুত্র নীতিশ পাল। তিনিই এখন প্রতিষ্ঠানের দেখভাল করছেন।
সৌভিক রায়
কমলাভোগের জন্ম আপনার বাবার হাতে, এই মিষ্টি আবিষ্কারের গল্পটা জানতে চাই?
বাবা দীর্ঘদিন হল গত হয়েছেন। আমাদের দোকানের বয়সও ৮০ পেরিয়েছে। এখন যেখানে দোকান ননী পাল সুইটস, এটাও শিফট হয়ে এসেছে প্রায় ৬০ বছরের উপরে হল। তার আগে আমাদের পুরনো প্রতিষ্ঠান, সেটাও ২০ বছর অতিক্রান্ত ছিল। বাবা যখন প্রতিষ্ঠান শুরু করেছিলেন, তখন অবিভক্ত জলপাইগুড়ির মাদারিহাট ছিল প্রত্যন্ত এলাকা। তখন জলদাপাড়া অভয়ারণ্য, ‘ন্যাশনাল পার্ক’ মর্যাদা তখনও মেলেনি জলদাপাড়ার। এলাকায় একমাত্র মিষ্টির দোকান ছিল ননী পালের দোকান। এলাকার আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে এই ছোট্ট মিষ্টির দোকান ছিল মাদারিহাটবাসীর আশা, ভরসা। এখন বাজারের স্বার্থে অনেক রকমারি মিষ্টি আমাদের বানাতে হয়। সেই সময় চার-পাঁচ ধরনের মিষ্টি বানানো হত। তখন বাবা হঠাৎ করেই নতুন একটা মিষ্টি শুরু করলেন। নাম দিলেন ‘কমলাভোগ’।
ননী পাল। কমলাভোগের জনক
তা কমলাভোগের জন্য তো কমলালেবুর প্রয়োজন। সেটার জোগান কোথা থেকে আসত?
আমাদের পার্শ্ববর্তী ভুটান, সেখানকার একটা করিডরের নাম টোটোপাড়া। টোটোপাড়া আর ভুটানের মধ্যে কোনও সীমানা প্রাচীর বা কাঁটাতারের বেড়া ছিল না। তদানীন্তন সময়ে ভুটানের পাদদেশে যে কমলালেবু চাষ হত, তা টোটোপাড়া হয়ে মাদারিহাটে নামত সপ্তাহান্তে ফি শনিবার। মহিষের গাড়ি করে সেগুলো এসে নামত। রবিবার সাপ্তাহিক হাট বসত। এখনও বসে। বুধবার ছোট বাজার আর রবিবার বড় বাজার। মাদারিহাটের বিভিন্ন জনজাতির মানুষ সেখান থেকে বাজার করত। কারণ দৈনিক বাজারের সুযোগ ছিল না। রবিবার সবাই বাজার করতেন। রবিবারের হাটকে কেন্দ্র করে আমাদের দোকানেও ভিড় জমত। টোটোপাড়ার কমলালেবু বাবা নিজেও কিনতেন। খুব স্বাদের ছিল। ভুটানের কমলার বাকল ছাড়ানোর পর দারুণ সুবাস পাওয়া যেত। বাকল যখন ছাড়াতাম সুন্দর সেন্ট পেতাম। অসাধারণ ছিল। বাকল ছিঁড়ে কমলা খাচ্ছি, বেশ কিছু দূর অবধি স্বল্প সময়ের জন্যে হলেও সেই গন্ধ পাওয়া যেত। এর থেকেই বাবার মাথায় আসে কমলাভোগ বানানোর কথা। তিনি ভাবলেন, কমলালেবুর বাকল আর রস দিয়ে কোনও একটা মিষ্টি বানালে কেমন হয়! এই ভাবনা থেকেই শুরু। আমাদের ‘ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট’-র সঙ্গে যাঁরা জড়িয়েছিলেন, তাঁদের কাছে বাবা এই ভাবনার কথা উত্থাপন করলেন। তাঁরা বললেন হতে পারে, সম্ভব। পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হল উৎপাদন। ছানার সঙ্গে মিশল কমলালেবুর বাকলের রস। রংটাও এল কমলা। জন্ম হল কমলাভোগের। বাবার অনুভূতি দিয়েই তৈরি হল কমলাভোগ। সুস্বাদু মিষ্টি হিসাবে কমলাভোগ আস্তে আস্তে বিস্তার লাভ করল মানুষের কাছে।
কমলালেবুর বাজার। ছবিটি প্রতীকী
এখনও কি সেই একই ভাবে কমলাভোগ তৈরি করেন?
বাবা সারাজীবন মিষ্টির গুণমান নিয়ে ভেবেছেন। চেষ্টা করেছেন সেরা জিনিস মানুষের সামনে পরিবেশন করতে। যেদিন থেকে এই দোকানটা বাবা শুরু করেছিলেন, সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত একই মান বজায় রাখা চেষ্টা করছি। বাবা গুণমান বজায় রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে গিয়েছেন, আমরা তাঁর উত্তরসূরিরা চেষ্টা করে যাচ্ছি, যাতে ‘কোয়ালিটি’-র দিক থেকে এক চুলও সরে আসা না-হয়। ৮০ বছর ধরে কমলাভোগের মান একই রেখেছি।
সারা বছর তো কমলালেবু পাওয়া যায় না। বছরের অন্যান্য সময় কমলাভোগের জন্য কমলালেবু পান কোথা থেকে?
কমলা খেয়ে, বাকলটা আমরা রেখে দিতাম। অক্টোবরের শেষ থেকে শুরু হয়ে ডিসেম্বর-জানুয়ারি পর্যন্ত দার্জিলিং, ভুটান সংলগ্ন অঞ্চলে কমলালেবু পাওয়া যায়। দার্জিলিংয়ের কমলালেবু বা ভুটানের কমলালেবু এখনও ব্যবহার করা হয় আমাদের দোকানে। খাঁটি কমলালেবুর জন্যেই আমাদের দোকানের কমলাভোগের এত খ্যাতি। খাঁটি জিনিসই আমরা ব্যবহার করি– এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কোনও প্রশ্নও নেই।
কমলাভোগ
আপনাদের ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট দিয়ে বাকল সংরক্ষণ যা হত, তাতেই কাজ চলে যেত?
না, অফ সিজনে যখন কমলালেবুর মরশুম শেষ হয় যায়। তখন কমলালেবুর শুকনো বাকল দিয়ে কমলাভোগ বানানো হয়। আমাদের পরিবারের বিভিন্ন আত্মীয়েরা, যাঁরা কর্মসূত্রে বিভিন্ন জায়গায় থাকেন তাঁরাও আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। আমার এক দিদি, বিবাহ সূত্রে রানাঘাটে থাকেন। কমলালেবুর মরশুমে তিনি কমলার বাকল সংরক্ষণ করেন। এমনভাবেই আমার দিল্লিনিবাসী দিদি, তিনিও কমলা খেয়ে বাকল রেখে দেন। বছর একবার যখন তাঁরা মাদারিহাটে ঘুরতে আসেন, তখন শুকনো বাকলটা যেটা তাঁরা রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করেছেন। সেই বাকলটা নিয়ে আসেন। আমার শ্বশুরবাড়ি লোকেরা এভাবেই কমলার বাকল সংরক্ষণ করেন। আমি গেলে ফেরার সময় তাঁরা হাতে তুলে দেন। ‘অফ সিজিন’-এ শুকোনো বাকল দিয়ে কমলাভোগ বানানো হয়।
লেবুর শুকনো বাকল দিয়ে কীভাবে কমলাভোগ বানান?
আমরা শুকনো বাকল গুঁড়ো করি না। ‘পেস্ট’ করি। শুকনো কমলালেবুর বাকল উষ্ণ গরম জলে দিলেই নরম হয়ে যায়। তারপর তা পিষে মিষ্টি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। কমলালেবুর সিজন শেষ হয়ে যাওয়ার পর এভাবেই কমলাভোগ তৈরি করা হয়। একই ভাবে ‘মেইনটেন’ করে যাচ্ছি। তবে দুধের মান আজকের দিনে ধরে রাখাটা ‘চ্যালেঞ্জ’। আমরা চাইছি, কিন্তু সেই জিনিসটা বাজারে খুঁজে পাচ্ছি না। ‘চ্যালেঞ্জ’ হয়ে দাঁড়াচ্ছে! কীভাবে আরও একটু ভালো করতে পারি চেষ্টা করছি। আমি পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ। বাবার প্রতিষ্ঠান আমাদের গর্বের, তা রক্ষা করার চেষ্টা করছি। এই প্রতিষ্ঠান দীর্ঘকাল ধরে আমাদের বাঁচার রসদ দিয়ে যাচ্ছে, কমলাভোগকে কেন্দ্র করে এই প্রতিষ্ঠানের মান, খ্যাতি যদি বজায় রাখতে না পারি, তাহলে কী করে হয়! জলদাপাড়ায় যাঁরা ঘুরতে আসেন, তাঁদের কাছেও আমাদের মিষ্টি সমাদৃত হচ্ছে।
কত রকমের কমলাভোগ বানান আপনারা? দাম কেমন?
কমলাভোগের দুটি ‘ভ্যারাইটি’ পাওয়া যায়। দাম যথাক্রমে বারো টাকা ও কুড়ি টাকা। কুড়ি টাকা পিসের কমলাভোগ রসে রাখা থাকে, সেখান থেকে পরিবেশন করা হয়। ছোট কমলাভোগটি হয় শুকনো। এটা মোটা রসের তৈরি করা হয়। খোয়া ক্ষীর ছড়িয়ে পরিবেশন করা হয়।
কোন কোন বিখ্যাত মানুষ আপনাদের দোকানের কমলাভোগ খেয়েছেন?
প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়, রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন খেয়েছেন। হাসিমারায় এয়ার স্টেশনের এক সরকারি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তিনি একদিনের সফরে এসেছিলেন। ওঁর মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের জলদাপাড়া ট্যুরিস্ট লজে তিনি রাত্রি যাপন করেন। আমার সুযোগ হয়েছিল ওঁর মেয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার। আমি একশৃঙ্গ গন্ডারের মূর্তি, ফুলের তোড়া আর আমার দোকানের মিষ্টি দিয়ে শর্মিষ্ঠা মুখোপাধ্যায়কে সম্মানিত করেছিলাম। আমার দোকানের সেই মিষ্টি তিনি রাষ্ট্রপতিকেও খাইয়ে ছিলেন। মিষ্টি খেয়ে তিনি আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলেন। আমায় দিল্লিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। পেটেন্টের ব্যবস্থা করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। আমরা পাঁচ ভাই ছিলাম, এখন দুই ভাই আছি। পরিবারের সদস্য সংখ্যা কমে যাওয়ায় এই বিষয়গুলো নিয়ে আর দৌড়ঝাঁপ করা হয়নি। এটা দুঃখেরই কথা।
মাদারিহাটে এসে রাজ্যের অনেক মন্ত্রীই আমাদের মিষ্টি খেয়েছেন। নানা পত্র-পত্রিকা, স্থানীয় চ্যালেন, বৈদ্যুতিন সংবাদ মাধ্যমে আমাদের মিষ্টি নিয়ে খবর প্রকাশিত ও সম্প্রচারিত হয়েছে। প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর ধরে যাঁরা আমাদের মিষ্টি খাচ্ছেন, তাঁরা আজও ভরসা ও বিশ্বাস রেখেছেন। এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
আজকের মিষ্টি-শিল্পপতিরা ফিউশন, ফিউশন করে নানাবিধ দাবি করেন। তাঁদের অহংয়ের অফস্ট্যাম্পে ইন সুইংয়ের মতো আছড়ে পড়ে ডুয়ার্সের মাদারিহাটের কমলাভোগ। কৃত্রিম সুগন্ধ বা এসেন্স নয়, মাদারিহাটে আসল কমলালেবু ছানায় মিশে কমলাভোগ ভূমিষ্ঠ হয়। ধীরে ধীরে জলদাপাড়া-পর্যটনের সঙ্গে মিশে গিয়েছে মাদারিহাটের কমলাভোগ এবং ননী পালের সৃষ্টি হয়ে উঠেছে জলদাপাড়ার ঐতিহ্য। সে সৃষ্টির গুণমান রক্ষায় পুরো পরিবারের লড়াইকে কুর্নিশ জানাতেই হয়।
খাস কলকাতায় ফিউশন গত আড়াই-তিন দশকের বস্তু। পাঁচ-দশ বছরে প্রচারের বহর বেড়েছে। আজ যখন ফিউশন ঘিরে মিষ্টি ব্যবসায়ীদের দাবি শুনি, তখন ননী পালের কীর্তির কথা মনে হয়। সত্তর-আশি বছর আগে কমলালেবুর খোসা আর ছানার মিলন ঘটিয়েছিলেন তিনি। তাঁকেই তো বঙ্গের মাটিতে ফিউশন মিষ্টির জনক বলতে হয়।
অমিয় চট্টোপাধ্যায়কে মেরে ফেলা সবচেয়ে জরুরি ছিল বোধহয়। জেল হাসপাতালের সামনে তাঁর সংজ্ঞাহীন শরীরটাকে ফেলে গলায় বাঁশ রেখে, তাতে দু’দিকে চারজন উঠে নেচে নেচে চাপ দিয়ে তাঁর মৃত্যু– না কি তাঁর অমরত্ব– নিশ্চিত করা হয়।
তথ্যনিষ্ঠায় বাঙালিদের অখ্যাতি মোচন করতে চেয়েছিলেন অমল হোম
যে উন্মত্ত জনতার ঢেউ রবীন্দ্রনাথকে প্রয়াণের পর ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, সেই ঢেউ হয়ে ওঠা জনতার অন্তর্গত মানুষগুলি কি জানতেন, তাঁদের এই মানুষটির প্রতি বিশ্বের মানুষের গভীর শ্রদ্ধার কথা! কয়েক মাস পড়ে, এই সংখ্যাটি কি হাতে নিয়ে দেখেছিলেন ভিড়ের মানুষেরা?
একজন অবতার-পুরুষ যুগকে কেন্দ্র করেই আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাই যুগের ব্যাধি, বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করতে কখনও ভুল করতে পারেন? আমরা এইবার কথামৃত পাঠ করব। ভগবানের কথা ব্যাখ্যা করার অধিকার আমাদের নেই। কিন্তু ভগবানের কথা স্মরণ ও ভাবার প্রয়োজন।