তিনের দশকের মাঝামাঝি বাংলাদেশে এসেছিল রিকশা এবং ১৯৩৭ সালে ঢাকায়। ১৯৪০ সালের জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারিতে নারায়ণগঞ্জের পাট কোম্পানি রেলি ব্রাদার্সের এক কেরানি কলকাতা থেকে একটি রিকশা নারায়ণগঞ্জে নিয়ে আসেন। তারপর থেকে ঢাকা পরিচিতি পেতে শুরু করে ‘রিকশার শহর’ হিসাবে। ৬ ডিসেম্বর ঢাকার ‘রিকশা ও রিকশাচিত্র’ বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায় আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোর থেকে। সেই উপলক্ষে রইল শিল্পী মোহম্মদ হানিফ পাপ্পুর সাক্ষাৎকার।
শহর প্রকৃতপক্ষে মানুষের হয়। ‘রিকশার শহর’ হিসেবে পরিচিতি পেলেও, ঢাকা আসলে মানুষের শহর। ৪০০ বছরের এই ঢাকা শহরের প্রধান বাহন ছিল গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি। মালামাল টানার জন্য ঠেলাগাড়ি। সেইসময় ঢাকায় যেমন ছিল গলি, তেমনই ছিল খাল। অনায়াসেই বুড়িগঙ্গা হয়ে শহরের ভেতরে বিভিন্ন খালে ঢুকে যেতে পারত বিভিন্ন নৌকা।
ঢাকার আত্মস্মৃতি পাঠ করতে গিয়ে পাই কবি শামসুর রাহমান, যাঁর জন্ম ১৯২৯ সালে, তাঁর রচিত আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘স্মৃতির শহর’ বইয়ের পাতায় পাওয়া যায়– ‘শহরের নাম ঢাকা। এ শহরে একটা সরু গলিতে যখন আমি প্রথম চোখ খুলেছিলাম, তখন ঢাকা ছিল ফাঁকা ফাঁকা। এত দরদালান ছিল না, মোটর ছিল না, এমনকি রিকশাও ছিল না। রাস্তায় রাস্তায় ছিল না সারি সারি পিঁপড়ের মতো মানুষের ভিড়। ছিল ছোট ছোট পথ, একটি কি দুটি বড় রাস্তা।’
শামসুর রাহমানের লেখা থেকে বুঝতে পারলাম, ১৯৩০ সালের দিকেও রিকশা আসেনি এই শহরে। এরপর ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনের লেখা ‘স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী’ বইয়ের পাতায় পাওয়া যায় রিকশা আগমনের সম্ভাব্য দিন-তারিখ। ‘স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী’– ‘‘১৯৩০ দশকের মাঝামাঝি বাংলাদেশে এসেছিল রিকশা এবং ১৯৩৭ সালে ঢাকায়।… ১৯৪০ সালের জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারিতে নারায়ণগঞ্জের পাট কোম্পানি রেলি ব্রাদার্সের এক কেরানি কলকাতা থেকে একটি রিকশা নারায়ণগঞ্জে নিয়ে আসেন। তাঁর মতে, ‘পূর্ব বঙ্গে তার আগে কেউ রিকশা দেখেনি।’ প্রথম রিকশার মালিকের নাম যদুগোপাল দত্ত। প্রথম রিকশা চালকের নাম নরেশ। এর কয়েক দিন পর যদুগোপাল দত্তের প্রতিবেশী শিশির মিত্র ৪টি রিকশা আমদানি করেন, রিকশা আমদানি হতে থাকে। হাতে টানা কিছু রিকশাও আমদানি করা হয়েছিল কিন্তু ‘বিরূপ’ প্রতিক্রিয়া হওয়ায় মিউনিসিপালিটি তা বন্ধ করে দেয়।’’
রিকশার চাকা যখন ঘুরছে, তখন এই ঢাকা কেমন ছিল, তার কিছুটা চিত্র পাই ‘মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা’র সম্পাদক মীজানুর রাহমানের ‘ঢাকা পুরাণ’ গ্রন্থে–‘‘১৯৪৮-এর ঢাকা। ব্রিটিশ আমলের পুরো গন্ধ তো ছিলই, মোগল আমলের ছিটেফোঁটা লালবাগ, আমলিটোলা, চকবাজার, মোগলটুলি, ইসলামপুর– এসব এলাকার অলিগলিতে যেন বা সেকালও উঁকি মারত। আমাদের এই হিসেবে প্রাউডলকের উদ্যান নগরী শ্যামলী রমনা হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো এক বিস্ময়। এ কথা বলা যাবে না নবাবি আমলের ঢাকা সম্পর্কে। বিদ্যুতের ব্যবহার তখনো সর্বগামী ছিল না। ফলে সন্ধে নামলেই সেকালের জেলা শহরগুলোর মতোই অন্ধকার নেমে আসত ঢাকার শিরা-উপশিরায়, বাড়ি বাড়ি জ্বলে উঠতো হারিকেন লণ্ঠনের আলো। মাঝে মাঝে খাপছাড়াভাবে কোনো কোনো ভাগ্যবানের বাড়ির জানালা গলিয়ে বিদ্যুতের ঝলমলে নরম আলো এসে পড়ত খোয়াভাঙা রাস্তার ওপর।… ১৯৫০ সালের কথা। তখনো ঢাকায় ঘোড়ার গাড়ি ও রিকশারই দাপট। আর লোকসংখ্যা রাজধানীর গুণে বেড়ে লাখ পাঁচ-ছয় হবে। কাজেই নারিন্দার মতো ঘিঞ্জি এলাকাতেও তেমন লোকজনের ভিড় ছিল না। সারা দিন রিকশার টুং টাং এবং মেয়েদের স্কুলের সময় ঘোড়ার গাড়ির ছড়ছড়-টগবগ শব্দ ছাড়া একরকম সুনসানই ছিল পরিবেশ। সন্ধে রাত পার হতে না-হতেই গ্রামের মতোই ঝিমিয়ে পড়ত পাড়াটা। আমাদের বাড়ির পুব পাশ ঘেঁষে বয়ে যেত ধোলাই খাল। শুকনো মৌসুমে পানি নেমে যেত একেবারে নিচেয়।’’
বর্তমানে ঢাকায় লোকসংখ্যা দুই কোটির অধিক। টুং টাং শব্দে, সীমিত গতিতে, হালকা চালে, দমে দমে প্যাডেল মেরে চলছে প্রায় দশ লাখ রিকশা।
ঢাকার ‘রিকশা ও রিকশাচিত্র’ বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায় আনুষ্ঠানিকভাবে ৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোর থেকে।
সেই উপলক্ষে রইল শিল্পী মোহম্মদ হানিফ পাপ্পুর সাক্ষাৎকার—
ঢাকার ‘রিকশা ও রিকশাচিত্র’ নিয়ে চারিদিকে এত আলোচনা হচ্ছে। আপনিও খুব ব্যস্ত রয়েছেন টেলিভিশন পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দেওয়া নিয়ে। কেমন অনুভব করছেন?
পাপ্পু: খুব ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে যে কিছু একটা করেছি জীবনে। মাঝের সময়ে বাবার কথা মনে পড়ত। আমার বাবা বলছিলেন তাঁর সঙ্গে ব্যবসা করতে, কিন্তু আমি গেলাম ছবি আঁকা শিখতে। আজ মনে হচ্ছে আমার শিল্পীজীবন সার্থক। পয়সা পাই নাই, কিন্তু সম্মান পাইছি।
পরিবারের কথা শুনে মনের কথা শুনলেন। মনের তাগিদে বেছে নিলেন ছবি আঁকার পথ। কীভাবে শুরু করলেন ছবি আঁকা?
পাপ্পু: ’৬৮ সালের দিকে ওস্তাদ গিরিন দাসের কাছে কাজ শেখা শুরু করি। ওস্তাদের কোম্পানির নাম ছিল ‘সীতারা আর্ট’। আমার মায়ের ছোটভাই রফিক মামা আর্টিস্ট ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানে। স্কুল ছুটির পর মামার জন্য দুপুরের খাবার নিয়া যাইতাম সীতারা আর্টে। তখন বসে বসে কাজ দেখতাম যে, সিনেমার ব্যানার আঁকতাছে সবাই। আমার দেখতে খুব ভালো লাগত এইসব আঁকা দৃশ্য।
স্কুল ছুটির পর আসতেন সীতারা আর্টে। এরপর স্কুলকেই ছুটি দিয়ে দিলেন এই আর্টের জন্য। কোন স্কুলে পড়তেন?
পাপ্পু: আরমানিটোলার আহমেদিয়া বাওয়ানী স্কুলে কয়েক ক্লাস পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি। বইয়ের, সিনেমার, সিনেমার ব্যানার টানত বেশি। আমার বাবা অনেক চেষ্টা করছেন তাঁর ইমপোর্ট-এক্সপোর্টের ব্যবসায় ঢুকাইতে, কিন্তু পারেন নাই।
আপনার বাবা কী ধরনের ব্যবসা করতেন?
পাপ্পু : আমার বাপ (আব্দুল গাফফার) এইখান থেকে (বাংলা বাজার, শ্যামবাজার) আরত থেকে পান কিনে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়া যাইতেন আর সেখান থেকে থান কাপড় আইনা এই ইসলামপুরের পাইকারি মার্কেটে সাপ্লাই দিতেন।
আপনার পরিবার বিষয়ে বিস্তারিত যদি বলেন। আপনার ছোটবেলার ঢাকা কেমন ছিল। তখন ঢাকার রিকশা কেমন ছিল?
পাপ্পু: পোস্ট অফিসের পাশে ৬৬নং নবাবপুরের নানা বাড়িতে আমার জন্ম। আমার মায়ের নাম জামিলা বেগম। আমার বাপ বাদে দুই চাচা ঢাকায় থাকতেন। তাঁরা আসছিলেন মুম্বই থেকে। গ্রামের নাম দৌড়াদি, গুজরাত। আমরা সুন্নী মেমান মুসলিম। নারায়ণগঞ্জের আদমজি জুট মিলের কাজের জন্য বাবা-সহ অনেকেই এই দেশে আসছিলেন। পরে মায়ের সঙ্গে বিয়ে হয় এবং এই দেশেই থাইকা গেলেন। আমি যখন সিনেমার ব্যানার শিল্পী হিসেবে কাজ শেখা শুরু করি, তখন ঢাকায় এমন রঙিন রিকশা ছিল না। রিকশার সংখ্যাও কম ছিল। রিকশায় যাত্রী উঠলে বিশেষ করে মহিলা যাত্রী উঠলে একটা কাপড় দিয়া ঢাইকা দিত। একটা পর্দা করা হইত। যেন রাস্তার লোকজন বা রিকশাওয়ালা কেউ যাত্রীকে দেখতে না পায়। ধর্মীয় কারণে এইটা করা হইত। আর ঢাকার প্রধান রাস্তা বলতে সদরঘাট থেকে নবাবপুর রোড। এইটা ঢাকার প্রধান রাস্তা। নর্থ সাউথ থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত খাল ছিল। ধোলাইখালে নৌকা চলত।
ঢাকার রিকশা রঙিন হইল কবে?
পাপ্পু: স্বাধীনতার পর পর রিকশার পর্দা গেল গা। রিকশা রঙিন হইতে শুরু করল। আমিও সিনেমা ব্যানার বাদে রিকশার কিছু কিছু কাজ করা শুরু করলাম। বিশেষ কইরা রিকশার পিছনের অংশে বিভিন্ন সিনেমার দৃশ্য আইকা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন মহাজন আসত আমার কাছে।
আপনার বাবা ভারত থেকে আসলেন। মা এই দেশের। ঢাকার স্থানীয় বাসিন্দা। ছোটবেলায় কোন ভাষায় কথাবার্তা বলতেন বাড়িতে আপনারা?
পাপ্পু: আমরা বাড়িতে ঢাকার ভাষাতেই কথা কইতাম। শুনতে উর্দু মনে হইতে পারে। হিন্দি, উর্দু, বাংলা তিনটা মিলানো মিশানো এই ঢাকার আদি ভাষায়। স্বাধীন হওয়ার পর বাংলা বলার চলটা বাড়তে থাকল।
সিনেমা ব্যানার আঁকা দিয়ে কাজ শুরু করলেন, এখন রিকশাচিত্র শিল্পী হিসেবে কাজ করছেন। এই দুই মাধ্যমে কাজের অভিজ্ঞতা, অর্জন, প্রাপ্তি নিয়ে কিছু বলুন।
পাপ্পু: মাধ্যম দুইটা হইতে পারে, কিন্তু কাজ আমি একটাই করে যাচ্ছি। ছবি আঁকছি। আর এইটা করেই খাচ্ছি। ডিজিটাল ব্যানার আসার আগে দেশে অনেক সিনেমা হল ছিল, সিনেমা অনেক চলত, হাত ভর্তি কাজ ছিল– অনেক কাজ করছি। ঢাকায় যে সিনেমা হলগুলিতে (নাজ, মধুমিতা, গুলিস্তান) ইংরেজি সিনেমা চলত সেইসব হলের ব্যানার আমি করতাম। ঢাকার ইংরেজি সিনেমার সব ব্যানার একা আমিই করতাম। এখন হল নাই আর সেই আঁকা ব্যানারের চাহিদাও নাই। রিকশা বাড়ছে। রিকশার কাজও বাড়ছে। এই শিল্পী হিসাবে ২০১৩ সালে ডেনমার্ক গেলাম। একটা প্রদর্শনীর জন্য। জীবনে এই প্রথম বিদেশ গেলাম। এরপর ২০২২ সালে জার্মানি গেলাম। আর ইউনেসকোর এই ঘোষণার পর সকলেই খোঁজ নিতাছে এইসবের জন্য ভালো লাগাটা বাইড়া গেছে। আনন্দ হইতাছে।
রিকশা পেইন্টিং বাদে আর কিছু করেন?
পাপ্পু: ছবি আঁকা বাদে আর কোনও কাজ জানি না। ঘরে বউ আছে। একমাত্র মেয়ের বিয়া দিয়া দিছি। সংসার ছোট হইয়া গেছে। যখন থেকে নিজের প্রতিষ্ঠান গড়েছি, অনেক সাগরেদ ছিল, অনেক কাজ আছিল, কাজ কমার সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই অনেক দিকে চইলা গেছে। এখন একজন শিষ্য নিয়া এই বকসিবাজারের দোকানটায় বসি। রিকশা পেইন্টিং বাদে বিভিন্ন বিয়ের অনুষ্ঠানের কাজ করি। ঘর সাজানোর জন্য হারিকেন, গয়নার বাক্সে ছবি আঁকি। সামনে ইচ্ছা আছে রিকশা পেইন্টিংয়ে বিভিন্ন কাপড়ে করমু। ইচ্ছা আছে নতুন বছরে ‘পাপ্পু ৬২’ নামে নতুন একটা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করামু। এইখান থেইনা রিকশাচিত্রের বিভিন্ন বিষয় নিয়া জামা বানামু। আর কেউ যদি কাজ শিখতে চায়, তারে কাজ শিখামু।
কোনও বিশেষ কাজের স্মৃতি মনে পড়ে?
পাপ্পু: ’৭২ সালে ইন্দিরা গান্ধী ঢাকায় আসছিল। তখন রেসকোর্স ময়দানে মঞ্চের সামনে বিশাল একটা নৌকা বানানো হইছিল। নৌকার এক পাশে বঙ্গবন্ধুর ছবি আরেক পাশে ইন্দিরা গান্ধীর ছবি আঁকা ছিল। এই ছবিতে আমি কাজ করছি ওস্তাদ গিরিন দাসের প্রধান সহকারী হিসাবে। এই কাজ আমাদের দিছিল শিল্পী নিতুন কুন্ডু।
প্রতিষ্ঠানের নাম ‘পাপ্পু ৬২’ রাখার কারণ কী?
পাপ্পু: ’৬২ আমার জন্মসাল। তাই এই নাম রাখছি। রিকশা সামনে চলে, চারপাশে নকশা থাকে। মূল চিত্রটা থাকে পিছনে। এই চিত্রটাই এই সময়ের রিকশা চালক মজাজনের গল্প। এই সময়ের গল্প। তাই নামের পিছনে আমার জন্মসালটা রাখছি।