জীবনে যা গেছে, তা কি একেবারেই গেছে? কবিগুরু বলেছিলেন, আমরাও ঢের টের পেয়েছি। গিয়েও যা যায় না তা হল হতচ্ছাড়া স্মৃতি! সময় কেটে গেলেও কেমন যেন জোরে হাওয়া বয়, আর টের পাওয়া যায়, মনের ভেতরে ঘুড়ি ও লাটাই এখনও টানটান। লিখছেন দেবজিৎ প্রামাণিক।
উচ্চমাধ্যমিকের সকাল,
বেহালা গার্লস, রোল-১৭, সেকশন-এ
কেমন আছিস? আমাদের কথা হয় না কেন আর? মনে আছে, মাধ্যমিক শেষ হয়ে যাওয়ার পর যে তিন মাসের জানলা থাকে… বেশ একটা ফুরফুরে হাওয়া গায়ে এসে লাগছিল তখন। ওটা আমাদের নেট প্র্যাকটিসের সময় ছিল, প্রথম দু’সপ্তাহে বইয়ের আকার-আয়তন দেখে নেওয়া– পরের দু’বছর সামলানো যাবে তো! সে বই আড়ে-বহরে প্রায় সুকুমার সমগ্রর কাছাকাছি। বাড়িতে বলে-টলে, প্রায় হুজুগের বশেই সায়েন্সটা নিয়েছিলাম। মানে মেনে নিয়েছিলাম যে, এটাই ভবিতব্য।
পাড়াতুতো দাদাদের থেকে বই নিয়ে নেট প্র্যাকটিসে যেতাম। পরে কনফার্ম হল। দেখলাম, কোনও একটা কারণে, ফিজিক্সটা ভালো লাগছে না। কেমিস্ট্রি পড়তে যেতে ভালো লাগত, পড়তে ভালো লাগত না। সারাদিন অঙ্কই করতাম। সৌরেন্দ্রনাথ দে, রুডিমেন্টস, সেন-চ্যাটার্জি। বাকি কিছুতে মন বসত না। সপ্তাহে দু’দিন ফিজিক্স পড়তে যেতাম, সকাল সাতটায়। মানে, সেই সময় যাওয়া উচিত। আমি খুব তাড়াহুড়োয় সাড়ে সাতটায় ঢুকে যেতাম। একেবারে টাইমে। আমার পাশে বসতিস তুই, বেহালা গার্লস, সবুজ সাইকেল। চোখে চশমা, চুলে একটা গার্ডার, কোনও দিন ছাড়াই থাকত। কপালের সামনে দিয়ে দু’একগাছি গাল বেয়ে নেমে এলে অনেক বাহানায় সরিয়ে দিতে চেয়েছি। তার আগেই ঠিক বুঝে নিয়ে চুল ঠিক করে নিয়েছিস প্রত্যেকবার।
সেসব সকালে কেমন কুয়াশামাখা শীত শীত ভাব, ছোট্ট ঘরটায় সবাই জুড়ে জুড়ে বসতাম। একটা ল্যাভেন্ডারের মিষ্টি গন্ধ সারা ঘর জুড়ে ম-ম করত, বোর্ডে মন বসত না। স্যর, কীসব এপসাইলনের আঁকিবুঁকি কাটতেন, আমার নাকে-মুখে বেগুনি ফুলের ঘ্রাণ এসে লাগত।
দু’-একদিন ইচ্ছে করেই আমার সাইকেলটা তোর’টার গায়ে গায়ে রেখে দিতাম। যাতে বেরনোর সময় একবার নাম ধরে ডাকিস। যদি কিনে নেওয়া যায় আরও দু’মিনিট। প্যাডেলে-প্যাডেলে বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর রাস্তা আলাদা হয়ে যেত। এইচএস-এর পর স্ট্রিম আলাদা, ফিজিক্সে কম পেলাম বলে ম্যাথস নেওয়া গেল না। আমি বায়োসায়েন্স, তুই কেমিস্ট্রি। আমি আশুতোষ, তুই সুরেন্দ্রনাথ। আমি মোহনবাগান, তুই ইস্টবেঙ্গল! কলেজে গিয়ে মিছিলের মাঝে প্রেম হল, চুমু হল, বিদ্রোহ-বিক্ষোভ হল– তবু এইটুকু দূরত্বে থেকেও আমাদের দেখা হল না। মাঝে তোদের অনেক ছবি-টবি দেখেছি আমি। শেষবার দিঘা গিয়ে, বেশ একটু হ্যাল খেয়ে আনফ্রেন্ড।
হঠাৎই টিচার্স ডে-তে পাঁচ বছর পুরনো একটা ছবি ফেসবুক ফিরিয়ে দিল, সেই টিচার্স ডে– সেই সকাল বেলা– সেই ফিজিক্স ব্যাচ, সবুজ সাইকেল! সব হু হু করে চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল। একটা লাইক, সেই নাম জ্বলজ্বল করছে। কী ব্যাপার!
তোরও কেটে গেল নাকি?
ইতি
পুরনো সকালের বন্ধু
১২.০৯.২৩