ক্যানসারটা যখন অনেকটা স্প্রেড করে গিয়েছে, তখন বাবা জানালেন ওঁর গণেশ সংগ্রহের বড় একটা অংশ ভারতীয় সংগ্রহশালায় উপহার হিসেবে দিয়ে দিতে চান। বাবা তখন এই সংগ্রহশালার ট্রাস্টি বোর্ড মেম্বার। তখন সংগ্রশালার ডিরেক্টর ছিলেন শ্যামল চক্রবর্তী। বাবা শ্যামলদাকে জানালেন তাঁর ইচ্ছের কথা। শ্যামল চক্রবর্তী গভর্নর বীরেন জে. শাহ-র সঙ্গে মিটিং ঠিক করলেন দ্রুতই। দিনটা এখনও স্পষ্ট মনে আছে। ৪ জুন, ২০০০। একটা অ্যাম্বুলেন্স এসেছিল। বাবা সেই অ্যাম্বুলেন্সে করেই পৌঁছলেন ভারতীয় সংগ্রহশালায়। সেখানেই গণেশ সংগ্রহটা হস্তান্তরিত হয়।
খুব ছোটবেলাতেই আমাদের বাড়িতে রিঠে ফুটিয়ে রিঠের জল করা হত। বাবা কখনও জিনিসপত্র সাফসুতরোর জন্য কেমিক্যাল ব্যবহার করতেন না, কেমিক্যালের বিকল্প ছিল রিঠের জল। মাঝেমধ্যেই বাবা জিজ্ঞেস করতেন, ‘তোমাদের টুথব্রাশগুলোর কী অবস্থা?’ আসলে, টুথব্রাশ খানিক পুরনো হলেই টুথব্রাশে রিঠের জল লাগিয়ে বাবা নিজের সংগ্রহ নিয়ে বসে পড়তেন পরিষ্কার করতে। মূলত দুটো জিনিস ঝকঝকে করে তোলার প্রতি বাবার নজর ছিল, তা হল কয়েন এবং গণেশ। তাছাড়াও, বাবা অনেকটা সময় দিতেন কয়েন পড়ায়। একটা ছোট আতশকাচ দিয়ে কয়েনের পরিচর্যা করতে করতেই পড়ে নিতেন, ঝালিয়ে নিতেন তার ইতিহাস। এ জিনিসটা গণেশের ক্ষেত্রেও করতেন। কখনও বাবা কয়েন বা গণেশ সম্পর্কে কোথাও একটা লেখা পড়লেন হয়তো– তার পরপরই গণেশের মূর্তি বা কয়েন নিয়ে বসে পড়তেন দীর্ঘক্ষণ। কয়েনের সাল, গায়ের লেখা-ছবি এবং গণেশের নানা অঙ্গভঙ্গি ও বৈচিত্র খুঁটিয়ে দেখতেন।
বাবার এই সংগ্রহের জিনিস ফিরে দেখা, নতুন করে পড়াশোনা করা ও পরিচর্যা ছিল নেশার মতোই। অল্পবয়সে দাদা একবার মায়ের সঙ্গে মামার বাড়ি গিয়েছিল। সারাদিন কাটিয়ে যখন ফিরে এল বাড়িতে, দেখল– বাবা অ্যালবামের ওপর আধশোয়া হয়ে আতশকাচ দিয়ে কয়েন দেখছেন। সেটা বড় কথা নয়– কিন্তু এই এক দৃশ্য দেখেই ওরা সাতসকালে বেরিয়েছিল বাড়ি থেকে। ফিরেও তা-ই দেখেছিল। বাবার এমনই ছিল কয়েন-প্রীতি।
আমার যখন ১০-১২ বছর বয়স, তখন বাবা জিজ্ঞেস করলেন, আমি নতুন একটা ভাষা শিখতে চাই কি না। সেই ভাষা– ফারসি। কিন্তু আমার তখন আরও অন্য ব্যাপারে আগ্রহ ছিল। যদিও একেবারেই অনাগ্রহ ছিল নতুন ভাষা শেখায়, তা নয়। কিন্তু শেষমেশ শেখা হয়নি। বাবা অত্যন্ত মৃদুভাষী, কোনও শাসন করা, বকাবকি করা ছিল না চরিত্রে। ‘না’ গ্রহণ করার ভদ্রতা ছিল ওঁর মধ্যে। এ ঘটনার ক’দিন পর দেখলাম বাবার কাছে একজন মাস্টারমশাই আসছেন। যাঁর কাছ থেকে বাবা শিখছেন উর্দু ও ফারসি।
বাবার যখন ক্যানসার ছড়িয়ে পড়েছে শরীরে, আমাকে তখন একদিন বলেন, মুঘল-সুলতান কয়েনগুলো– যা উর্দু ও ফারসিতে লেখা, তা বিক্রি করে দিচ্ছেন এক খ্যাতনামা সংগ্রাহককে। আমার এ ব্যাপারে কোনও আপত্তি ছিলই না। তখন বাবা শুধু একবারের জন্যই বলেন, ‘তুমি তো এই কয়েনগুলো পড়তে পারবে না। কারণ উর্দু ও ফারসিটা শিখলে না। তুমি যদি পড়তে পারতে, তাহলে কয়েনগুলো তোমার জন্য রেখে যেতাম।’ প্রায় ২৫ বছর পর বুঝতে পেরেছিলাম, কেন বাবা চেয়েছিলেন আরেকটা ভাষা শিখি। কারণ কয়েনগুলোকে তাহলে বুঝতে পারব। কয়েনগুলো শুধু সংগ্রহ হয়ে পড়ে থাকবে, বাবা চাইতেন না, চাইতেন তার যথাযথ কদরও।
গণেশকে আমরা ঠাকুর নয়, দেখতাম ‘মূর্তি’ হিসেবেই । বাড়ির সদর দরজা খোলা থাকলে বাইরে থেকে সেই গণেশের মূর্তিগুলো দেখা যেত। মজার ব্যাপার, বাবা কাউকে কখনও চাঁদা দিতেন না। চাঁদা দিতে আসা লোকজন বলতেন, ‘আপনাদের বাড়িতে এত গণেশ, ঠাকুর মানেন, অথচ চাঁদা দেন না!’ বাবা বলতেন, ‘আমার কাছে এসব ঠাকুর না, মূর্তি। আমার বাচ্চাদের পুরনো টুথব্রাশ দিয়ে এগুলো সাফ করি।’ তাতে চাঁদা নিতে আসা লোকজন বিস্মিত হয়ে ফিরে যেত।
আমার ঠাকুরদা সিদ্ধেশ চৌধুরী। খুব বেশি বাঁচেননি তিনি। ‘সিদ্ধেশ’ মানে সিদ্ধি বা সাফল্যের দেবতা, তার মানে তো গণেশই। বাবার হয়তো এই সূত্র ধরেই গণেশ সংগ্রহের প্রতি এক ধরনের ঝোঁক গড়ে উঠেছিল। এছাড়া, আরও একটা কারণ, যা মনে হয়– বাবা জন্মেছিলেন নাগপুরে। বড় হয়েছেন সেখানেই। দক্ষিণ ভারতের গণেশপুজো বিরাট ব্যাপার। আমি নিজেও দীর্ঘ সময় বোম্বেতে কাটিয়েছি, গণেশপুজোর বহু ছবিও তুলেছি। প্রায় বিশ্বাস হত না, এত মানুষ! সত্যি বলতে কী, আমাদের দুর্গাপুজোর চেয়েও অনেকটা বড়।
নাগপুরের প্রসঙ্গ এল যখন বাবার কলেজের একটা গপ্প বলার লোভ সামলাতে পারছি না। বাবা নিজের নাম ইংরেজিতে ‘Basanta’ লিখতেন না, লিখতেন ‘Vasant’। বাবার কলেজের সহপাঠী ছিলেন কংগ্রেসের মন্ত্রী বসন্ত শাঠে– Vasant Sathe। পরবর্তীকালে তিনি তথ্যপ্রযুক্তি দফতরের মন্ত্রী হয়েছিলেন। ইচ্ছে করেই কলেজে পড়াকালীন বাবা ও বসন্ত শাঠে একই বেঞ্চে বসতেন। বসন্ত শাঠেকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কেন এইরকম করতেন?’ বসন্ত শাঠে মজা করে বলেছিলেন, ‘‘অশান্তি করতে চাইতাম তাই! আমাদের যখন কেউ ডাকত ‘ভসন্ত’ বলে আমরা দু’জনেই উত্তর দিতাম। অথবা কেউ-ই উত্তর দিতাম না।’’
একটা সময় ভারত থেকে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিক চলে গিয়েছে বিলেতে। সরকার এ ব্যাপারে টের পেয়ে, একটা নিয়ম চালু করল যে, অ্যান্টিক দ্রব্য যেন ভারতেই থাকে। বাইরে যেন বিক্রি না হয়। বাবা সে জন্য খুবই তোড়জোড় করেছিলেন। বাবা চেয়েছিলেন, যত দ্রুত সম্ভব এটা আইন করে রদ করা হোক। মনে পড়ছে, ইউরোপ থেকে ফিরে এসে বাবা একবার বলেছিলেন, একটি মিউজিয়ামে গিয়ে ভারতের চমৎকার সব অ্যান্টিক দ্রব্য দেখেছেন। ভারতে থাকলে অনেকে যে দেখতে পেতাম, সে ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। বাবা আজীবন চাইতেন, ভারতের জিনিস ভারতেই থাকুক।
ক্যানসারটা যখন অনেকটা স্প্রেড করে গিয়েছে, তখন বাবা জানালেন ওঁর গণেশ সংগ্রহের বড় একটা অংশ ভারতীয় সংগ্রহশালায় উপহার হিসেবে দিয়ে দিতে চান। বাবা তখন এই সংগ্রহশালার ট্রাস্টি বোর্ড মেম্বার। তখন সংগ্রশালার ডিরেক্টর ছিলেন শ্যামল চক্রবর্তী। বাবা শ্যামলদাকে জানালেন তাঁর ইচ্ছের কথা। শ্যামল চক্রবর্তী গভর্নর বীরেন জে. শাহ-র সঙ্গে মিটিং ঠিক করলেন দ্রুতই।
দিনটা এখনও স্পষ্ট মনে আছে। ৪ জুন, ২০০০। একটা অ্যাম্বুলেন্স এসেছিল। বাবা সেই অ্যাম্বুলেন্সে করেই পৌঁছলেন ভারতীয় সংগ্রহশালায়। সেখানেই গণেশ সংগ্রহটা হস্তান্তর করেছিলেন বাবা। তখন কথা হয়েছিল, বাবার সংগ্রহের সমস্ত গণেশ নিয়ে একটা ক্যাটালগ হয়ে প্রকাশিত হবে।
২০০০ সালের ২০ জুন বাবা প্রয়াত হন। গণেশের সংগ্রহ হস্তান্তরের মাত্র ১৫ দিন পর। এরপর ১০ বছর কেটে গিয়েছিল, কোনও ক্যাটালগ বেরয়নি। ২০১১ সালে আমি সংস্কৃতি দফতরের জহর সরকারকে একথা জানাই। তাঁরই উদ্যোগে কয়েক মাস পরেই প্রকাশিত হয়েছিল ওই ক্যাটালগ। ছবি, ছবির পরিচয় ও সময়কাল ধরে তৈরি করা হয়েছিল ক্যাটালগটি। যত্ন সহকারে অনেকটা দায়িত্ব সামলেছিলেন শ্যামলদার স্ত্রী– শিপ্রা চক্রবর্তী, যিনি কাজ করতেন মিউজিয়ামেই। বাবার যখন ক্যানসারে শয্যাশায়ী, তখন থেকেই এই কাজ শুরু হয়েছিল। নার্সের চেয়ারে বসে শিপ্রা চক্রবর্তীই বাবাকে ছবিগুলো দেখিয়ে জেনে নিতেন কোন গণেশের কী বৃত্তান্ত। বাবার সংগ্রহের এই গণেশের ছবিগুলো তুলেছিলেন বিখ্যাত ফোটোগ্রাফার আহমেদ আলির পুত্র নিয়াজ আলি। বাবার সংগ্রহে ভারতীয় গণেশ তো ছিলই, ছিল নেপাল, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তিব্বত, চায়না, জাপান ছাড়াও আরও নানা স্থানের নানা প্রকারের গণেশ। যাদের সময়কাল অষ্টম শতক থেকে বিশ শতকের মধ্যে। কাঠের, পিতলের, টেরাকোটা ছাড়াও পোর্সেলিনের গণেশও ছিল।
২০১১ সালে সেই ক্যাটালগ প্রকাশিত হওয়ার পর, আবারও বাবার গণেশ সংগ্রহ নিয়ে বিশেষ প্রদর্শনী হয়।
ধুতি-পাঞ্জাবি পরেই বাবা ৪ তারিখ ভারতীয় সংগ্রহশালায় গিয়েছিলেন। সাধারণত, একবার পরা ধুতি-পাঞ্জাবি না-কেচে আবার পরতেন না বাবা। কিন্তু যেহেতু অ্যাম্বুলেন্সে করে গিয়েছিলেন, কম সময়ের জন্য, সেই ধুতি-পাঞ্জাবি ছিল ঝকঝকে, পরিষ্কার। বাবা বলেছিলেন, ‘এগুলো কাচতে দিও না, হ্যাঙারে রেখে দাও। ক’দিন পরে তো আমি মারা যাব, তখন আমাকে এই ধুতি-পাঞ্জাবিটাই পরিয়ে দিও।’
বাবা প্রয়াত হয়েছিলেন ২০ জুন। তিন-চারদিন পর, দরজা খুলে দেখি চারজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী দাঁড়িয়ে। আমি ভাবলাম, বাবা মারা গিয়েছেন, কাগজে সে খবর পেয়ে হয়তো এসেছেন। বললাম, ‘কী ব্যাপার, বলুন।’ ওঁদের মধ্যে সবথেকে বৃদ্ধ সন্ন্যাসী ভাঙা ইংরেজি-হিন্দি মিশিয়ে বললেন, এক বৌদ্ধ মনেস্ট্রি থেকে তাঁরা এসেছেন। দমদম পার করে ওঁদের সেই মনেস্ট্রি। ওঁরা কেউই সংবাদপত্র পড়েন না, কিন্তু ওঁদের দারোয়ান পড়েন নিয়মিত। সেই দারোয়ানের কাছেই এক হিন্দি সংবাদপত্রে বাবার ছবি দেখে ওঁদের মনে পড়েছিল যে, এই লোকটাই ওঁদের মনেস্ট্রিতে যেতেন। তখন জানতে পারি, বাবা আরাকানি মুদ্রা নিয়ে লেখাপড়া করছিলেন। আরাকানে কয়েক বছর আগেই গিয়েছিলেন তিনি। বেশ কিছুদিন সেখানে ঘুরেছিলেন, তথ্য সংগ্রহও করেছিলেন নিজের লেখাপড়ার। বাবা আরাকানের মুদ্রা নিয়ে গিয়ে ওই বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের কাছে আরাকানি পড়ে জানতে চাইতেন, কী আছে সেই মুদ্রার নেপথ্যে!
আজ ২০ জুন। বাবা চলে যাওয়ার ২৫ বছর হল। নিজের সম্পর্কে প্রায় কোনও কথা না-বলা এই মানুষটার সম্পর্কে গত ২৫ ধরে বহু মানুষের কাছ থেকে নানা গল্পগাছা ক্রমে জেনেই চলেছি। বেঁচে থাকা অবস্থায় বাবাকে নিয়ে যেমন বিস্মিত ছিলাম, মৃত্যুর এই ২৫ বছর পরও সে বিস্ময়ে কোনও ছেদ পড়েনি।
…………………………………..
অনুলিখন সম্বিত বসু
বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর খুব সঠিকভাবেই ভারতের বিদেশনীতির ব্যাখ্যা করে আগাম বলে রেখেছিলেন, ‘হোয়াইট হাউস ডেমোক্র্যাট প্রার্থী না রিপাবলিকান প্রার্থীর দখলে গেল তা নিয়ে নয়াদিল্লি মোটেও চিন্তিত নয়। কারণ, ভারত ও আমেরিকার সম্পর্কের এতে কোনও পরিবর্তন ঘটবে না। গত পাঁচটি প্রেসিডেন্টের আমলেই ভারত ও আমেরিকার সম্পর্কের উন্নতি ঘটেছে।’