Robbar

ছেলেবেলার রেনকোট পাল্লা দিয়ে বড় হয় না কেন?

Published by: Robbar Digital
  • Posted:July 5, 2025 6:50 pm
  • Updated:July 5, 2025 7:12 pm  

বৃষ্টি এলেই কেলেঙ্কারি মনে হত এককালে। ইশকুল, যাত্রাপথ জলথইথই। রেনি ডে হোক না না-হোক, আগে তো পৌঁছই। ছাতা ব্যবহার করা মহা ঝঞ্ঝার! হারাই হারাই সদা মনে হয়। কিন্তু রেনকোট, দিব্যি গায়েগতরে সাঁটে। ব্যাগখানাও একচুল ভেজে না। পাড়ার এক পাগল, শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা– ছাতায় নয়, রেনকোটেই ভরসা করেছিল। সুপারহিরোর না, আমআদমির বাদলবর্ম রেনকোট। ফুড ডেলিভারির এজেন্ট হোক, কিংবা ভোরবেলার কাগজের হকার, রেনকোট ছাড়া তাঁদের চলে না। ঝড়বৃষ্টি যতই বাহাদুরি দেখাক, ছাতা যতই উড়ে-উল্টে যাক, রেনকোট বড় কাজের। লোকে তেমন দাম দিল না, এই যা। 

সুমন্ত চট্টোপাধ্যায়

১.

বাবুন পাগলের কথা আপনাদের মনে আছে? উ– কী বললেন? ঠিক চিনতে পারছেন না! তা, না চেনারই কথা। বাবুন পাগলা তো আর জননেতা নয়! টিভি টক শো-তে চেয়ার গরম করে, কথার তোড়ে হাতি-গণ্ডারও মারে না। ফলে না-চেনাই স্বাভাবিক। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। কিন্তু কথা যখন উঠল, তখন একবার পরিচয়টা না করিয়ে ঠিক শান্তি হচ্ছে না।

ওই যে মাঠের ওধারে পোড়ো বাড়ি, ওই বাড়ির একতলার পিছন দিকে, একটা স্যাঁতসেঁতে ঘরে বাবুনের বাসা। বাবা-কাকার মুখে শুনেছি, এককালে নেভিতে নাকি চাকরি করত বাবুন পাগল! মানে, তখনও পাগল হয়নি। মুখে বড় সিগারেট, বাইক হাঁকিয়ে পাড়ায় ঘুরত ধোপদুরস্ত পোশাকে। গায়ে বিলিতি সেন্ট। সে তখন জ্যোতিবাবুর জমানা। শুনেছি, পোড়ো হয়ে যাওয়া বাড়িটা, যার পিছনের একটা পিছল-ঘরে বাবুনের বাস, যদিও গোটা বাড়িটাই নাকি আসলে বাবুনের। কী? তাহলে বাবুন সামনের দিকে থাকে না কেন? থাকে না, কারণ, সামনের দিকে তো পার্টি অফিস!

উ– কী বললেন? হঠাৎ বাবুন পাগলার কথা বলছি কেন? বলছি, বলছি। সেই কথাই তো বলার। এমন সহায়-সম্বলহীন বাবুনকে আমার মতো একটা তিন নম্বরি লোক মনে রেখেছে একটাই কারণে। আসলে ওর একটা রেনকোট ছিল!

ছেঁড়া-ফাটা। ঘন কালো। একটা তেলচিটে চেন-কাটা রেনকোট। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা– বাবুন পাগলার ওই রেনকোট ভরসা। ঠাঁ-ঠাঁ গরম হোক, কী হাড়কাঁপানো শীত, বর্ষা হলে তো কথাই নেই– বাবুনের গায়ে রেনকোট লেপ্টে থাকত সবসময়। শোয়ার সময় ওটাই হয়ে যেত মখমলে চাদর।

সেই রেনকোট গায়ে বাবুন পাগলাকে দেখতাম ইতিউতি ঘুরে বেড়াতে। ঘোরা মানে বীরদর্পে ঘোরা। এই ধরুন, সকাল দশটার বাজার-চত্বর। জমাটি ভিড় ঠেলে বাজারের ভর্তি ব্যাগ সমেত পাড়ার প্রদীপ মেসো বাড়ির রাস্তা ধরেছেন। আচমকা তাঁর সামনে দু’হাত প্রসারিত করে আবির্ভূত বাবুন পাগলা! সারামুখে কিলবিলে দাড়ি। উসকো-খুসকো চুল হাওয়ায় এলোমেলো। গায়ে সেই গন্ধমাদন রেনকোট, মুখের গন্ধে মূর্ছা যাওয়ার জোগাড়। প্রদীপ মেসো সহসা এমন অভ্যর্থনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তাঁর তখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা! অথচ পাগলা বাবুন নাছোড়। তার একটা রেনকোট চাই!

West Bengal Monsoon: আবহাওয়ায় বদল, ভারী বৃষ্টির জন্য ক'দিনের অপেক্ষা!  কেমন থাকতে চলছে আগামী ৫ দিন | West Bengal Monsoon: A change in the weather,  waiting for a few days for heavy

এলাকাবাসীর জানা ছিল, এটাই বাবুন পাগলের রোজনামচা। চেনা-মুখ খুঁজে পেলেই হল! সটান তার সামনে ‘ডিডিএলজে’-র শারুখ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়া, আর ‘আমায় একটা রেনকোট কিনে দিবি?’ বলে সকাতর অনুরোধ। কিন্তু পাগল তো আর প্রেমিক নয়, যে তার দাবি রাখতে হবে। প্রদীপ মেসোরাও রাখতেন না। পরম্পরা এবং অনুশাসন মেনে আমরাও রাখিনি। বরং হয়েছিল ঠিক উল্টোটাই।

এক ভরদুপুরে ইশকুল-ফেরত আমরা আবিষ্কার করেছিলাম, পোড়োবাড়ির সামনে বড়সড় জটলা। সেই জটলার ফাঁকে একটা নরম কাঠের খাটিয়া। তার ওপর সাদা চাদর। কালো রেনকোট ছেড়ে সেই সাদা চাদরের ওম নিয়েই বাবুন পাগলা চলে গেছিল এলাকা ছেড়ে, অনুরোধে কাউকে অপ্রস্তুত না করে।

২.

বাবুন পাগলাকে আপনাদের মনে না-ই থাকতে পারে। কিন্তু বিভাস বাঁড়ুজ্যে? না, না, এমএলএ, এমপি নন। তা হতে যাবেন কেন? এমএলএ, এমপি, মন্ত্রী-সান্ত্রী হলেই কি তাঁদের মনে রাখতে হবে? বাকিরা কি বেনোজলে ভেসে এসেছে?

শুনুন, বিভাস বাঁড়ুজ্যেকে আমি বিভুকাকা বলে ডাকতাম। আমাদের এলাকায় বাড়ি বাড়ি কাগজ দিতেন। সেই ছোট্টবেলা থেকে দেখছি। আর দেখছি, ওঁর ওই একঘেয়ে রেনকোটখানা। একঘেয়ে বলে একঘেয়ে! ঘোরবর্ষায় যদি চারিদিকে বৃষ্টির তোড়ে সাঁঝ নেমে আসে, আর তার মাঝে যদি কাউকে দেখেন সাইকেলে চেপে বাড়ি বাড়ি পেপার দিচ্ছে রেনকোট গায়ে, বিলক্ষণ জানবেন, ওটি বিভুকাকা– আর কেউ নয়।

তো এই বিভুকাকাই আমায় এনে দিতেন চাঁদমামা। তাঁর কাছেই গল্প শুনতাম ইমার্জেন্সির! বলতেন, সন্ধের পর রাস্তায় বেরলেই নাকি পুলিশ ধরত। আর একবার তাদের খপ্পরে পড়লে নিস্তার নেই! প্রশ্নে প্রশ্নে জেরবার। একবার কাকভোরে পেপার আনতে গিয়ে তেমনই চেকিং-এ পড়তে হয়েছিল বিভুকাকাকে। এক্কেবারে নাকি সার্চলাইট মুখে ফেলে, বন্দুকের নল উঁচিয়ে দু’হাত খাড়া করে সাদা-পুলিশ কয়েক ঘণ্টা বিভুকাকাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল! চিরুনি-তল্লাশি চালিয়ে ছিল আগাপাশতলা।

Rain batters India from north to south, yellow alert in Telangana | Top  points | Latest News India - Hindustan Times

ফেলে আসা অতীত, তাকে বিশ্বাসযোগ্য করতে উদ্বাহু হয়ে দেখাতেন বিভুকাকা। দেখতাম, বৃষ্টিতে সপসপে রেনকোটটা ছেঁড়া বগল বরাবর। তার ভিতর থেকে উঁকি দেওয়া কমলা গেঞ্জি– সেটাও ভিজে সপসপে।

সেই বিভুকাকাই একদিন কাটা পড়ল ট্রেনে! শুনেছিলাম, তুমুল বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বেরিয়েছিল ঠিক ভোরবেলা। লাইন পেরনোর সময় ঘটে বিপত্তি। ওপাশ থেকে ছুটে আসা ডাউন ট্রেনের ঝাঁঝালো আলো বুঝতে মনে হয় একটু দেরি করে ফেলেছিল। নাকি ভেবেছিল, ওই ভোর আসলে এমাজেন্সির? ওই আলো আসলে সার্চলাইট? বিহ্বল বিভুকাকা কি তখন দু’হাত উপরে তুলে ধরেছিল? গায়ে কি ছিল ওই ভেজা সপসপে রেনকোটখানা?

৩.

দাঁড়ান একটু জিরিয়ে নিই।

উ– কী বলছেন? আমার? হ্যাঁ, তা ছিল। দেশ যেবার স্বাধীন হল, তার ঠিক ৫০ বছরের মাথায় বাবা কিনে দিয়েছিল। আকাশি নীল রং। তার গায়ে মিকি মাউসের ছোট ছোট ইমেজ। বেশ বাহারি একখান রেনকোট!

মজা কী জানেন? তখন আমি কেজি কিংবা নার্সারি! ইশকুল ছুটির সময় সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে থাকতাম আমরা। বাইরে বৃষ্টি। এদিকে স্কুল-বারান্দায় রংবেরং-এর আস্ত একটা লাইন। যেন বাহারি বনফুল। কারও গায়ে গোলাপি, কেউ হলুদ, কেউ বা লাল– রেনকোট নয়, যেন রামধনু। তাদেরই মাঝে আকাশি নীলে আর মিকি মাউসে আমি একা হতেছি আলাদা!

পুজোয় যেমন নতুন জামা, শীতের রাতে লাল লেপ, তেমনই বর্ষায় রেনকোট। একবুক উষ্ণতা নিয়ে– সে আছে। যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল, তারা জানে না রেনকোটের স্পর্শসুখ। রেনকোট আসলে বর্ম– সুপারহিরোর নয়, সাধারণের। বৃষ্টির ফলা সেই বর্ম ছুয়ে পথ হারায়, রেনকোট পরা শরীর তখন নদীমাতৃক এক মানচিত্র। শাখা আর উপশাখায় মিলেমিশে এক জালিকাকার শিরাবিন্যাস।

এসবের মাঝেই একদিন ছিঁড়ে যায় রেনকোটের বোতাম। রাবারের চাকতি খুলে সেখানে জমাট বাঁধে শূন্যতা। সেই ফাঁক গলে অনুপ্রবেশ করে বৃষ্টির টোকোজল। ভিজিয়ে দেয় অন্তরকে। আমাদের নাবালকের পৃথিবীতে সেদিন থেকে সাবালকের চারা গজায়। তারপর কোনও এক ভরা বর্ষায় সিঁড়িঘরের পরিত্যক্ত পৃথিবীতে আবিষ্কার করি ছেলেবেলার রেনকোটকে, স্মৃতির সোঁদা গন্ধ তখনও তার গায়ে।

 

৪.

উ– কী বলছিলেন? রেনডম না কী যেন? না, না। শুনতে পাইনি। লিখতে লিখতে ভাবুক হয়ে পড়েছিলাম আর কী! কী, বিছানায় রেনকোট? এ বাবাহ্, ছিঃ! ছিঃ! সুযোগ বুঝে মশকরা করছেন! শুনুন, এসব কথা এখানে বলা ঠিক হবে না। দেশে সরকার বলে একটা ব্যাপার আছে, মাথার ওপর দাদা-দিদি আছে। তারা শুনলে কী ভাববে, বলুন তো?

তবে কী জানেন, ভুল তো মানুষ মাত্রেই করে, আমিও করি। এই দিনকয়েক আগেও করেছি। আকাশজুড়ে সেদিন মেঘ করেছিল, সূর্যি এক্কেরে পাটে গেছিল। তো ওই মেঘ ফুঁড়ে কখন বৃষ্টি নেমেছে, খেয়াল নেই। চোখেমুখে কয়েক ফোঁটা পড়তেই মন ভরে গেল! স্থান-কাল-পাত্র ভুলে গেলাম! তখন আর আমি এই আমি নেই। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছি। যেন ভাবসমাধিতে চলে গেছি। হঠাৎ চৈতন্য ফিরল এক সগর্জন অস্তিত্বে।

না, মেঘ ডাকেনি। বাজও পড়েনি। ডেকেছিল আমার গিন্নি! সুমধুর কিছু শব্দ বর্শার ফলার মতো ধেয়ে প্রবেশ করেছিল আমার কানে। তারপর আর খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে থাকার সাহস পাইনি। শুধু আড়চোখে তাকিয়েছিলাম আকাশের দিকে। দীর্ঘশ্বাসের মতো ঠেলে উঠেছিল একটা প্রশ্ন–

আচ্ছা, বলুন তো, মানুষ বড় হয়, ছেলেবেলার রেনকোটগুলো কেন পাল্লা দিয়ে বড় হয় না?

…………………………….

ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল

…………………………….