Robbar

যারা পালিয়ে বিয়ে করেছিল, তাদের সাক্ষী শিকবাঁকানো এক জানলা

Published by: Robbar Digital
  • Posted:January 21, 2025 4:10 pm
  • Updated:January 21, 2025 4:10 pm  

শুধুমাত্র মনের মতো একটা শীতকালীন জানলা পেলাম না বলে ছোটবেলা থেকে এই শহর আর সংসারের ওপর রাগ আমার। ঘরটা যদি বাড়ির সামনের দিকে হত, তাহলে জানলা হত গলির দিকে। সেখানে একফালি হলেও শীতের রোদ। রাত আরও বাড়লে চাদর মুড়ি দিয়ে অন্য দু’-একটা  জানলার নীচে ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করে প্রেম। যার বেশিরভাগই ভবিষ্যতে বিবাহসূত্রে পাড়াছাড়া।

গ্রাফিক্স: অর্ঘ্য চৌধুরী

অনুব্রত চক্রবর্তী

গলির শেষে যে তিনতলা বাড়ি তার ছাদের নিচে জানলা। সেই জানলাটি শীতঋতুর ব্যক্তিগত সম্পত্তি। ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে স্কুলের ছুটিতে সেই জানলায় যে সদ্য কিশোরী এসে বসে দুপুরবেলা, খাওয়াদাওয়ার পর, এলোচুলে এবং হাতের ওপর চিবুক আলতো রেখে, সে পাড়ার আপামর কুমার কিশোরের কাছে আগাম বসন্তের হাতছানি। মাঝে মাঝে সে সরু আঙুলে পরম যত্নে খোসা ছাড়িয়ে কমলালেবু খায়। এক কোয়া, কখনও দু’কোয়া। বেহায়া এক ব্যাটা কাকের ভাগ্যেও জোটে তার দাঁতে কাটা নরম বিকেল। তার হাসি শোনা যায় যতক্ষণ রোদ ছুঁয়ে থাকে জানলার শিক, যারা গরাদের মতো দাঁড়িয়ে থাকে রাতভোর। বন্ধুরা বেমক্কা তর্ক জুড়ি, শীতকাল ওই জলছবির ডিরেক্টর, নাকি ওই জানলার টানেই আসে অমন মোলায়েম শীতরোদ্দুর, সঙ্গে তার নায়িকাকে নিয়ে। একটু ওম পাওয়ার পর যে কিশোরী তার গায়ের শাল খুলে ফেলে অবলীলায়। আমরা যে যার নিজস্ব জ্যামিতিক অবস্থান থেকে এই ছবি দেখি, কেউ ছাদে, কেউ গলির মুখে ঘাড় উঁচু করে, কেউ বা দোতলার বারান্দা থেকে। কিশোরী কী দেখে, তা সেই জানে, আর জানে তার শীতের জানলা। 

‘নয়ি পরোসন’ ছবির একটি দৃশ্য

একটা শীতকাল বুঝতে গেলে গোটা একটা জানলা লাগে এইটুকু অন্তত বুঝেছি বয়ঃসন্ধিতে। মিঠু ডানকুনির বাড়ি থেকে ফিরে বলেছিল, তার ঘরের জানলা দিয়ে আদিগন্ত মাঠ দেখা যায়। সেই মাঠ যা ভবিষ্যতে বাড়ি, আরও বাড়ি আর আরও জানলায় ভরে উঠবে। আমার তাতে কিছুই যায় আসেনি, কারণ আমার ঘরের জানলা দিয়ে দেখা যেত একটি আখাম্বা পাঁচিল এবং অতিপ্রয়োজনীয় আর একটি ঘর– পায়খানা। এমনিতেই আমার শোয়ার ঘর বছরভর স্যাঁতসেঁতে। যেটুকু রোদ্দুর উৎসাহ নিয়ে পা বাড়াত জানলার দিকে, ওই পাঁচিলে ধাক্কা খেয়ে আবার বড় রাস্তায়। তাই, ঘরের জানলা থেকে বাইরে তাকিয়ে শীতকাল এসেছে কি না, বোঝার একমাত্র উপায় পায়রা বা চড়াই। যদি দেখি তারা পাঁচিলে বসে গা ফুলিয়েছে সকাল সকাল তাহলে সেই দুপুরে গলিতে বের হব, সেটা নিশ্চিত। আর রাতে নিজের জানলার কবজা খুলে নিয়ে ওই তিনতলা বাড়ির জানলা লাগিয়ে নেব ঘুমঘোরে। শুধুমাত্র মনের মতো একটা শীতকালীন জানলা পেলাম না বলে ছোটবেলা থেকে এই শহর আর সংসারের ওপর রাগ আমার। ঘরটা যদি বাড়ির সামনের দিকে হত, তাহলে জানলা হত গলির দিকে। সেখানে একফালি হলেও শীতের রোদ। অয়নকাল, উত্তরায়ণ না দক্ষিণায়ণ? ভূগোলের বই খুলি। সন্ধেবেলা ওই বাইরের জানলার কানেই ডেকে যায় ঘুগনি আর নতুন আলুর দম। রাত আরও বাড়লে চাদর মুড়ি দিয়ে অন্য দু’-একটা  জানলার নিচে ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করে প্রেম। যার বেশিরভাগই ভবিষ্যতে বিবাহসূত্রে পাড়াছাড়া। এমনকী, সেই যুগলেরও ছাড়াছাড়ি হয় যাদের পালিয়ে বিয়ে করার মন্ত্রণা দিয়েছিল শীতকাল, এক সন্ধ্যায়। পুরো ঘটনার সাক্ষী বাঁকানো শিকের অবিন্যস্ত এক জানলা। যার ফাঁক দিয়ে পিঠেপুলি-র গন্ধ নাকে আসছিল রাতে, ক্লাবে ক্যারাম খেলা শেষ করে বাড়ি ফেরার সময়ও।

‘অপুর সংসার’ ছবির দৃশ্যে

জানলায় শীত না পাওয়ার দুঃখ নিয়ে শহর ছেড়ে দক্ষিণ ভারতের যে শহরে এলাম যৌবনে, সেখানে আবার প্রায় সারা বছরই গ্রীষ্মকাল। শুধু ডিসেম্বরে পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে ফিরতি বর্ষা। তাই, যে জানলা বয়ে এনেছি অদৃশ্য সুটকেসে, সে বন্দি হয়েই পড়ে থাকে। এখানে ঘরের জানলা খুললে উল্টোদিকের বাড়ির রান্নাঘর। নারকোল তেলের কৌটো। ফেলে আসা শহরের প্রতিবেশী বাপির বাড়ির জানলায় শীতকালে রাখা তেল জমে যাওয়া কৌটোর মতো নয় সে মোটেও। তারও পর বিজাতীয় ভাষায় বিচিত্র কথোপকথন কানে আসে। প্রেমের সংলাপ না কি ঝগড়া, বোঝা দায়। সবচেয়ে বড় সমস্যা যে সময়কে শীত ভেবে বড় হয়েছি, রংবাহারি সোয়েটারে গা ঢেকেছি, গলায় জড়িয়েছি বেমানান মাফলার, সেই মাসগুলো জুড়ে যখন তখন বৃষ্টি। অগত্যা জানলা বন্ধ! তাই, কোনও রকমে কয়েক বছর কাটিয়ে, একবুক শীতজানলা নিয়ে সোজা মার্কিন দেশে, ইস্ট কোস্ট। সেখানে সত্যিই শীত, পাঠ্যবইয়ের নিয়ম মেনে। এবং রাতে ঘুম ভেঙে জানলা দিয়ে তুষারপাত। ল্যাম্পপোস্টের হ্যালোজেন আলো সাদা ঝুরঝুরে বরফ কমলালেবুর রঙে ধুয়ে দিয়ে গেল। জানলা খুলে সিগারেট ধরাতে যাই। কনকনে হাওয়া, ভূতের সিনেমার মতো শোঁ শোঁ আওয়াজ। বরফ-ঢাকা পার্কিং লট পেরিয়ে প্রতিবেশীর জানলা দেখা যায়। সেখানে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার।

The ambiance felt from the window of the cabin on a cold snowy winter day | Snowstorm Sounds 8 Hours

যে শীতকালের জন্য, শীতজানলার জন্য হাজার হাজার মাইল উজিয়ে, মায় অতলান্তিক পেরিয়ে সম্পূর্ণ অচেনা এক দেশে ঠাঁই গেড়েছি, সেই শীত আমার অসহ্য লাগে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই। এমনকী, বসন্ত এলেও শীতভাব কাটে না। সুটকেস থেকে জানলা বের করি, খড়খড়ি খুলি। কোনটা খোলে, কোনটা নিমরাজি। আমি ওই জানলায় রোদ্দুর ঢেলে গ্রীষ্মের রং দিতে চাই। কিন্তু সে রং শুকনোর আগেই মুছে যায়। আর কোথা থেকে এক অলপ্পেয়ে হাওয়া এসে বলে, শীত আছে কিন্তু মনের মতো জানলা নেই তোমার এই বাড়িতেও। যে জানলা আঁকড়ে আছ তাতে সেই শীতের রোদ্দুর নেই, চড়াই নেই, পায়রা নেই। কমলালেবুর খোসা, এমব্রয়ডারি করা শাল, এলোচুল– নেই। জানলা থেকে রাস্তার রকে চোখ মেলান্তি খেলা নেই। অর্থাৎ, তোমার চারপাশে প্রেম নেই। আমার প্রেম নেই? ভাবতে ভাবতে এক ভীষণ শীতের রাতে জানলার ধারে এসে দাঁড়াই। সেদিন আকাশ পরিষ্কার, চাঁদ ছিল। এবং এই প্রথম একা জানলা দিয়ে চাঁদ দেখা। জ্যোৎস্নার নির্দেশে আবার সুটকেস গুছোই। দেশ বলে, ফিরে এসো খোকা।

ইনসেপশনের দৃশ্যে লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও

একথা দেশে-বিদেশে সবাই একবাক্যে মানে যে, আমাদের শীতকাল ভ্রমণের উপযুক্ত সময়। রেস্ত অনুযায়ী ট্রেন-প্লেন। জানলার ধারের সিট নাও। একবার যদি শিখে নেওয়া যায় কীভাবে বেঁকেচুরে নরম করে নিতে হবে নিজের শীতজানলা, তাহলে যেকোনও জানলাতেই লেপে দেওয়া যায় নরম রোদ্দুর, সে ট্রেন হোক বা প্লেন, বেডরুম বা বাথরুম। সকাল, দুপুর, বিকেল– যেকোনও সময়ে। শুধু মাঝে মাঝে ফেলে আসা গলির তিনতলার জানলা ফিরে আসে কিছুটা অপ্রত্যাশিতভাবে। যেমন এসেছিল ভরা ডিসেম্বরে চিতোরগড়ে, লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো দেখার সময়।

সেই সন্ধেতেও কড়া শীত। খোলা চত্বরে বসার আয়োজন। চারদিকে প্রাসাদ ও মন্দির, আবছায়ায়। একসময় টিমটিমে আলোও নিভে গেল। শো শুরু হল। প্রাসাদের কোণে, ছাদের ঠিক নিচে একটিমাত্র জানলায় হালকা আলো জ্বলে উঠল। স্পিকারে জলদগম্ভীর স্বরে বলা হল ওটাই পদ্মিনীর ঘর। ধরে নিন, তিনি এই মুহূর্তে ওই ঘরে। এরপর যতক্ষণ চলল এই ইতিহাস বর্ণনা, মাঝে মাঝেই অন্ধকার হল চরাচর আর আচমকা জ্বলে উঠতে লাগল ওই ঘরের আলো। শেষে, ইতিহাসের নিদান অনুযায়ী, যখন আগুনের গল্প এল, কথন হল আত্মাহুতির, স্পট লাইট জ্বলে উঠল এক এক করে। ওই ঘর, জানলা আর আলাদা করে চেনা গেল না। যেমন চিনতে পারিনি পুরনো গলির শেষে তিনতলার জানলা।

This may contain: a building with three windows and a person sitting at the window sill looking out

একবুক শীতকাল নিয়ে শহরে ফিরেছি যখন সে গলি আর আমার নয়। নতুন ঠিকানা, অচেনা রোদ্দুর। অচেনা বয়স। চড়াই আর পায়রাদের নতুন জেনারেশন অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স-এর ঠিকানায় কার্নিশ খুঁজে নেয়। সুটকেস খুলে দেখি আমার ব্যক্তিগত জানলা রংচটা, কবজাবিহীন। সে হাট করে খোলা। রাখব না ফেলব ভাবতে ভাবতে তাকে দেওয়ালে টাঙাই, ছবির মতো। এককোনে টুনি বাল্ব লাগাই, প্রাসাদের ঘরের আলো। সারাবছর সে টিমটিমিয়ে জ্বলে দিন-রাত, আর অয়নকালে এক আশ্চর্য শীতরোদ্দুর ঢেলে দেয় ছুটির দুপুরে। সবাই বলে, এখন নাকি সে কমলালেবুও আর নেই!

তবু আমি কোনও এক অমোঘ আকর্ষণে গায়ে শাল জড়াই, কাঁচাপাকা চুল ওই রোদ্দুরে চুবিয়ে জানলায় ঠেস দিয়ে বসি। তারপর ঈষৎ কাঁপা আঙুলে লেবুর খোসা ছাড়াতে থাকি। একটা কাক কোথা থেকে উড়ে আসে, কে জানে। ডাকে না, জুলজুল চোখে অপেক্ষায় থাকে। আমি তাকে এক কোয়া প্রেম ছুড়ে দিই আমার শীতজানলা দিয়ে।

……………………………………………………

ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল

……………………………………………………