এটা কি খুব উচ্চমানের শিল্প-চর্চা? না, একদম নয়। এটা এখন কিছুদিন চলবে। রফির কণ্ঠ, মান্নার কণ্ঠ, কিশোরের কণ্ঠ– সব ফিরে ফিরে আসবে। প্রয়োজনীয় কি না, বলতে পারব না তবে চমক তো বটেই। কিছু মানুষ গিমিক বা চমক দিতে ভালবাসে আর কিছু মানুষ চমকাতে। মানুষ যদি গিমিক বুঝতে না পারে তাহলে তারা গিমিকটা গিলবে আর গিমিকের সর্দার মিটমিট করে হাসবে আর পরের গিমিকের কথা ভাবতে শুরু করবে। কিন্তু সে চমকই হোক বা গিমিক-ই হোক, তাতে কী? একটা নতুন কিছু নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট তো হচ্ছে! এই গলা নকল করতে গিয়ে হঠাৎ দারুণ কিছু একটা পেয়ে যেতে পারি আমরা।
নতুন কিছু আসলেই একদল মানুষ ‘গেল গেল’ করতে শুরু করে দেয়। ১৯৮০-র দশকে দেশে কম্পিউটার আসার সময় অনেক প্রোটেস্ট আমরা দেখেছি (ভারতীয় মজদুর সংঘ এবং অন্যান্য)। পশ্চিম বাংলাতেও বহু ট্রেড ইউনিয়ন লাগাতার বিরোধিতা করেছে কম্পিউটার ব্যবহারের বিরুদ্ধে (ব্যাঙ্কিং সেক্টর এবং অন্যান্য)। সরকার সমর্থন করেছে এইসব। বুদ্ধদেববাবু এই নতুন শতকের শুরুতে বলেছেন, সেইসব কিছু ভুল ছিল। ঐতিহাসিক ভুল ছিল। আজকে বাংলাতেও সিলিকন ভ্যালি হতে পারত, কিন্তু হয়নি। আমাদের ছেলেমেয়েরা এখানেই চাকরি পেতে পারত, কিন্তু পায়নি। বেঙ্গালুরু, হায়দ্রাবাদ যেতে হত না কাউকে। আমরা পারিনি। আর এখন, এত বছর বাদেও বাংলাতে উন্নয়ন কিছুতেই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না। বাংলার মুখে কাদা মাখাচ্ছে সন্দেশখালির মতো লজ্জাজনক ঘটনা।
যাক গে। মূল প্রসঙ্গ থেকে দূরে চলে আসছি। এখন প্রসঙ্গ এআই। ভালো না খারাপ? অবান্তর প্রশ্ন! যুদ্ধটা চিরদিনই কনজারভেটিভ বনাম লিবেরাল। প্রাচীনপন্থী বনাম নতুন দল। আমি নতুনে থাকতে চাই। এআই এসে গেছে। রাতারাতি অনেক কিছু বদলাবে। আপনি বা আমি আটকানোর কেউ নই। যদি বাধা দেন, নির্বোধের মতো কাজ করবেন। আমাদের দেশের সন্তানরাই দেশ-বিদেশে এআই নিয়ে ফাটিয়ে কাজ করছে। মাইক্রোসফ্ট, গুগল, মেটা এবং অন্যান্য যত বড় টেকনোলজি কোম্পানি আছে, সবাই কাজ করছে এআই নিয়ে। NVIDIA-র শেয়ারের দাম গত বছরে কতটা বেড়েছে বাঙালি জানে? ৬৩%! সমস্যা হচ্ছে, ফেসবুকে বাতেলা মারা বাঙালি নীতিপুলিশ এসব নিয়ে ভাবে না। বিশ্ব কোথায় এগিয়ে চলে গেছে খবর রাখেনি, এখনও রাখে না। এখানে তো মানুষের চাষের জমি মেরে দিয়ে মাছের ভেড়ি বানাতে ব্যস্ত আমরা। চণ্ডীগড়ে মেয়র ইলেকশনে প্রকাশ্যে ঘাপলা করছি আর সিসিটিভিতে ধরা পড়ছি। সরি সরি, আবার সরে যাচ্ছি মূল প্রসঙ্গ থেকে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আমরা সত্যি-মিথ্যে যাচাই করতে চাই না। আমরা আমাদের মাথার ঘিলুটাকে ব্যবহার না করে করে সেটাকে পাথরে পরিণত করেছি। এবার আসি কেন এত কথা। কিছুদিন আগে হেমন্তবাবুর কণ্ঠ বসিয়ে আমার রচিত একটি গান ‘বাউন্ডুলে ঘুড়ি’ সোশাল মিডিয়াতে খুব শেয়ার হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই কিছু মানুষের ভালো লাগছে, কিছু মানুষের খারাপ। আমি নিজেও শেয়ার করেছি, করে লিখেছি ‘ইন্টারেস্টিং’। বিশেষণটি আমি ভেবেচিন্তেই ব্যবহার করেছি। এই কাজটি ভালো না খারাপ– সেটা বড় ব্যাপার নয়। কেউ দাবি করছে না যে, হেমন্তবাবু এটি গেয়েছেন, এটা আলোচনারই বিষয় নয়। পরিষ্কার বলা হচ্ছে, এটি এআই-এর সাহায্যে হেমন্তবাবুর কণ্ঠ নকল করে বানানো হয়েছে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আসলে সংগীতে এআই নিয়ে আলোচনাটা আমার কাছে খুবই তুচ্ছ লাগে। এআই অপরাধীরা ব্যবহার করা শুরু করলে, কী হতে পারে– সেই ভেবে বেশি চিন্তা হয়। শাসকদল নিজেদের প্রোপ্যাগান্ডার জন্য ব্যবহার করার কথা ভাবলে অশান্তি হয়। যদি কেউ নেতাজির মুখ কেটে একটা ভিডিও বানিয়ে দেয় যে, উনি বলছেন ‘দিল্লি চলো! আমরা মন্দির বানাব!’, হাজার হাজার মনুষ্যরূপী গাধা হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিওটি পেয়ে বিশ্বাস করতে শুরু করে দেবে যে, নেতাজি সত্যি এই কথা বলেছেন।
আমরা সত্যি-মিথ্যে যাচাই করতে চাই না। আমরা আমাদের মাথার ঘিলুটাকে ব্যবহার না করে করে সেটাকে পাথরে পরিণত করেছি। এবার আসি কেন এত কথা। কিছুদিন আগে হেমন্তবাবুর কণ্ঠ বসিয়ে আমার রচিত একটি গান ‘বাউন্ডুলে ঘুড়ি’ সোশাল মিডিয়াতে খুব শেয়ার হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই কিছু মানুষের ভালো লাগছে, কিছু মানুষের খারাপ। আমি নিজেও শেয়ার করেছি, করে লিখেছি ‘ইন্টারেস্টিং’। বিশেষণটি আমি ভেবেচিন্তেই ব্যবহার করেছি। এই কাজটি ভালো না খারাপ– সেটা বড় ব্যাপার নয়। কেউ দাবি করছে না যে, হেমন্তবাবু এটি গেয়েছেন, এটা আলোচনারই বিষয় নয়। পরিষ্কার বলা হচ্ছে, এটি এআই-এর সাহায্যে হেমন্তবাবুর কণ্ঠ নকল করে বানানো হয়েছে। গুণগত মানের প্রসঙ্গে পরে আসছি। প্রথম প্রশ্ন, উনি কি একটা চাইতেন? জানি না। পারমিশন ছাড়াই এ কাজ করা হয়েছে। অপরাধ? জানি না। আজকের আলোচনার বিষয় এটা নয়। আমাদের মধ্যেই কেউ একজন এটা চেষ্টা করেছেন এবং ডেফিনেটলি, ইটস আ গুড অ্যাটেম্পট । একটা তথ্য, শুধু এআই দিয়ে কিন্তু এটা হচ্ছে না, একজন সোর্স প্রয়োজন। অর্থাৎ একজন মানুষ যে অবিকল হেমন্ত-র মতো গাইতে পারবেন। অর্থাৎ কণ্ঠী এবং সলিড কণ্ঠী। যত ভালো নকল করতে পারবেন, এআই-এর কাজ তত নিখুঁত হবে। এআই দিয়ে কোনও কিছু ডিজাইন তৈরি করাও তাই, একটি প্রম্পট লাগে। প্রম্পট যত ভালো হবে, আউটপুট ততটাই। প্রম্পট-এ যদি আপনি মলত্যাগ করে ফেলেন, তাহলে এআই ওই বিষ্ঠা নিয়ে সোনা তৈরি করতে পারবে না। তাই হেমন্তবাবুর কণ্ঠের জন্যও শুরুতে একজন চমৎকার হেমন্তকণ্ঠী লাগবে। তারপর আসছে এআই, তাকে ট্রেন করা, নুয়ান্সেসগুলো বোঝানো। সেটা আলাদা ট্যালেন্ট এবং খাটনি।
এবার পরের প্রশ্ন– এটা কি খুব উচ্চমানের শিল্প-চর্চা? না, একদম নয়। এটা এখন কিছুদিন চলবে। রফির কণ্ঠ, মান্নার কণ্ঠ, কিশোরের কণ্ঠ– সব ফিরে ফিরে আসবে। প্রয়োজনীয় কি না, বলতে পারব না তবে চমক তো বটেই। কিছু মানুষ গিমিক বা চমক দিতে ভালবাসে আর কিছু মানুষ চমকাতে। মানুষ যদি গিমিক বুঝতে না পারে তাহলে তারা গিমিকটা গিলবে আর গিমিকের সর্দার মিটমিট করে হাসবে আর পরের গিমিকের কথা ভাবতে শুরু করবে। কিন্তু সে চমকই হোক বা গিমিক-ই হোক, তাতে কী? একটা নতুন কিছু নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট তো হচ্ছে! এই গলা নকল করতে গিয়ে হঠাৎ দারুণ কিছু একটা পেয়ে যেতে পারি আমরা। বিলায়েত খাঁ-এর সেতার বেজে উঠতে পারে নতুন একটি আধুনিক বাংলা গানে। সেটা কি দারুণ কোনও শিল্প হবে? না, হবে না। কিন্তু যদি একটা দারুণ কোনও সুর সৃষ্টি করা যায় এআই-এর মাধ্যমে! এবার? এবার তো হল। এখনও তা সম্ভব হয়নি, তবে ভবিষ্যতে হতেই তো পারে।
আমার তো মনে হয়, যত চেনা ছক আছে সব ছিঁড়ে ফেলা উচিত। ভুল হোক, ঠিক হোক– নতুন কিছু করে দেখার চেষ্টা করা উচিত। মরার আগে বলতে পারব, অ্যাট লিস্ট উই ট্রায়েড। টেকনোলজি আমাদের শত্রু নয়, আমাদের সহায়ক। এত কিছু তো এল, শ্রেয়া ঘোষাল এখনও শ্রেয়া ঘোষাল। অরিজিৎ সিংহ এখনও অরিজিৎ সিংহ। জাকির হুসেন এখনও জাকির হুসেন। কাজ হারানোর ভয়টা অন্যভাবে ট্যাকল করতে হবে। কম্পিউটার এসে বহু মানুষের কাজ গেলেও, চাকরি জেনারেট কিন্তু করেছে তার চেয়ে অনেক বেশি। কূপমণ্ডূক হয়ে থাকাটা আরও বিপজ্জনক। সম্ভাবনার সমস্ত দরজাগুলো খুলে দেওয়া দরকার। তারপর দেখাই যাক না কী হচ্ছে!
পরের সমস্যা: সত্যি বনাম মিথ্যে। নকল নিয়ে আমাদের সভ্যতা সারা জীবন যুদ্ধ করেছে। একদল মানুষ যা বানিয়েছে, অন্য একদল মানুষ তার নকল বানিয়ে বাজারে চালিয়েছে। মানুষ মানুষকে আগেও ঠকিয়েছে, ভবিষ্যতেও ঠকাবে। মানুষ কারেন্সি নোট বানিয়েছে আর অন্য একদল মানুষ তার নকল। গান্ধীর মুখ আলোর দিকে মেলে ধরে দেখতে হয় কালো সুতো আছে না নেই। তাও বোঝা যায় না মাঝেমাঝে। যামিনী রায় ছবি এঁকেছেন, মানুষ এন্তার কপি করেছে, প্রদর্শনী করেছে, বিক্রি করেছে, পয়সা বানিয়েছে। সাধারণ চোখে দেখে বলতেও পারব না আসল না নকল।
সব কিছুর ফেক পাওয়া যায়। পারফিউম, ঘড়ি, ওষুধ– সব কিছুর। হয়তো দুই ট্রিলিয়ন ডলারের নকল জিনিস মানুষকে আসল বলে বিক্রি করা হয় প্রতি বছর। সংগীতও ক্যাপিটালিস্ট সমাজের একটা প্রোডাক্ট। তাই সেই প্রোডাক্টেরও ‘ফেক’ হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। এক সময় মানুষ তেড়ে পাইরেসি করে গান শুনেছে। এখন এআই-এর সাহায্যে বানানো ফেক। একধাপ এগিয়ে। তখনও মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি বেঁচে ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে। নতুন একটা চ্যালেঞ্জ। এআই গীতা দত্ত নাকি আসল গীতা দত্ত? বুঝব কী করে? বেরবে উপায় নিশ্চয়ই। একজন নাগরিকের এআই গীতা দত্ত শোনা যত না অপরাধের, তার চেয়ে ঢের বেশি অপরাধের, সমাজে ফেক নিউজ ছড়ানো। একটা মিডিয়া চ্যানেলকেও মানুষ আজকাল বিশ্বাস করতে পারে না। একটা খবর দেখলে প্রথমেই যাচাই করতে ইচ্ছে হয়, এটা সত্যি না মিথ্যা। এই ব্যাধি আরও ভয়ংকর। আরও গভীর। আমরা তো উত্তর কোরিয়া হতে চাই না, তাই না?
এআই আমাদের চ্যালেঞ্জ জানাক। আমি চ্যালেঞ্জ চাই। ২০ বছর আগে যা গান বানাতাম, এখন তার চেয়ে উন্নততর গান তৈরি করতে চাই। এআই হোক আমার বন্ধু। এআই হোক আমার প্রতিদ্বন্দ্বী। আমি যা ভাবছি, এআই তার বিপরীত ভাবুক। বিরোধীদেরও প্রয়োজন আমাদের। না হলে তো বেঁচে থাকার মজাটাই নেই!
(মতামত নিজস্ব)