ধোঁয়ায় মেশানো বেশ কিছু স্নায়ুবিষ বুকের হাপরে লালন করার পর শেষমেষ সিগারেটটাকে মাটিতে পিষে ফেলতেই হয়। আবার তার স্বাদ নিতে আঙুলের টোকায় মর্জিমতো প্যাকেট ভর্তি সিগারেট বিনা পয়সায় ডাউনলোড করা যায় না। নাৎসিরা কত সহজে ‘দাস ক্যাপিটাল’ আগুনের দিকে ছুড়ে ফেলেছিল, কিন্তু গ্রন্থটির কয়েক লক্ষ ডিজিটাল অডিও ফাইলকে পুড়িয়ে ফেলা সম্ভব নয়। কারণ এমপিথ্রি ফাইল ফরম্যাটে বব ডিলানের গান, ইউটিউবে ঋত্বিক ঘটকের সিনেমা, ক্রিস্টোফার নোলানের ফেসবুক-ইন্সটা প্রোফাইল বা আজকের জমজমাট চ্যাটজিপিটি, কেতাবি শব্দে এগুলি হল ইনট্যাঞ্জিবল অ্যাসেট, যা হাতের মুঠোয় আটকে রাখা যায় না। সাধারণ মানুষের জীবনের ওঠাপড়ার সঙ্গে একের পর এক বিচিত্র এইসব ইনট্যাঞ্জিবল অ্যাসেট জড়িয়ে পড়ার সময়টাতেই কিন্তু বেশ বড় রকমের আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক রদবদল ঘটে গিয়েছিল।
ঐতিহাসিক অনিবার্যতায় তথ্যপ্রযুক্তি এক্সপোনেনশিয়াল গতিতে এগিয়েছে। ফলাফল হিসেবে কৃত্রিম বুদ্ধির অভূতপূর্ব পরিসরের মুখোমুখি আজ মানুষ। কিছুই যেন নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কৃত্রিম বুদ্ধি ভাল, না খারাপ, তা নিয়ে ধন্দ এখনও কাটেনি, তবে এতদিনে আমরা বুঝে নিয়েছি যে, প্রযুক্তির কাজই হল মানুষের কায়িক ও মানসিক শ্রম কমিয়ে আনা। সেই যুক্তিতে প্রযুক্তি এক সময় মানুষের জীবিকার জায়গায় জাঁকিয়ে বসবে, এমনটাই ছিল প্রত্যাশিত। কিন্তু একইসঙ্গে আমাদের এই সত্যটিও বুঝে নিতে হবে যে, বর্তমান সামাজিক ব্যবস্থাটি পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষের পূর্ণাঙ্গ বিকাশের সম্ভাবনার জায়গাটিকে মজবুত করে না, উল্টে প্রতিযোগিতায় মানুষকে একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন করে টাকাপয়সা অর্জন করাকেই সর্বোচ্চ লক্ষ্য হিসেবে প্রশ্রয় দেয়। এখানে অর্থনীতির চাবিকাঠি আড়াল করে রাখে গুগল, আমাজন, ফেসবুক ইত্যাদি হাতেগোনা কয়েকটি প্ল্যাটফর্ম-সংস্থা। এমন বাস্তবতায় স্বার্থ-অধ্যুষিত লেনদেন, তীব্র অবসাদ, নির্মাণ করা নৈরাজ্যেরই বিশ্বায়ন ঘটবে, এমনটাই তো স্বাভাবিক।
বিবর্তনের শ্রেষ্ঠ ফসল হিসেবে প্রকৃতিজাত বুদ্ধিতে টইটম্বুর মানুষ প্রজাতিটিকে প্রযুক্তির বিলাস-বিভ্রমে ডুবিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধির গিনিপিগ হিসেবে তিলে তিলে গড়ে তোলা হচ্ছে আন্তর্জাতিক পরিকল্পনায়। মানুষ আজকের দিনেও বিপজ্জনক ম্যানহোলের অন্ধকার থেকে অসহ্য দুর্গন্ধের আবর্জনা নিজের হাতে তুলে আনে, সেখানে সাদামাটা প্রযুক্তিরও কোন ব্যবহার নেই। অন্যরকম সামাজিক পরিমণ্ডল কাছে পেলে হয়তো সেই অযান্ত্রিক মানুষটিই কবিতা লিখে আমাদের চমকে দিতে পারত। কিন্তু তা হয়নি, বরং নিমেষে গল্প-কবিতা-নাটক লিখে মিডিয়া, সামাজিক মাধ্যমে শোরগোল ফেলেছে যান্ত্রিক চ্যাটজিপিটি। নিঃসন্দেহে এই পরিহাসে মুখে হাসি নিয়েই আমাদের শিউরে উঠতে হয়।
ইদানীং কৃত্রিম বুদ্ধির অন্যতম এক উদ্ভাবন ‘ডিপফেকস’ নজর কেড়েছে সেলুলয়েড দুনিয়ায়। জনপ্রিয় অভিনেতার অবিকল প্রতিলিপি তৈরি করে আগাগোড়া একটি ফ্যান্টাস্টিক সিনেমা নির্মাণ করা যাচ্ছে জটিল অ্যালগরিদমের কারুকাজে। অভিনেতার ডিজিটাল কপিটি প্রোগ্রাম করা অপটিমাল অতিরঞ্জনে অভিনয়ে, অভিব্যক্তিতে দিব্যি চলাফেরা করছে, সম্ভোগে মেতে উঠছে প্রেমিকার সঙ্গে, অতিলৌকিক কায়দায় ভিলেনকে সপাটে আছাড় মারছে। দেখার মতো বিষয় হল, প্রেমিকা ও ভিলেনও সেখানে ইনট্যাঞ্জিবল অ্যাসেট। ফলত মোটা টাকার কাজ হারানোর ভয়ে প্রতিবাদে একজোট হয়েছেন রক্ত মাংসের হিরো, হিরোইন, ভিলেনরা। আইনের সাহায্যেও সম্ভবত এর বিরুদ্ধে কিছুই করা যাবে না কারণ বেআইনি এই কাজ করার ছাড়পত্র অভিনেতারা হয়তো আগেভাগে না বুঝেই দিয়ে বসে আছেন। ঠিক যেভাবে কোনও একটি অ্যাপ ডাউনলোড করার সময় স্মার্টফোনের অডিও, ভিডিও ফাইল অ্যাক্সেস করার পারমিশন দিতে আমরা খুব একটা বেশি মাথা ঘামাই না।
ঘুম থেকে উঠেই ফেসবুকে চোখ রেখে আমরা যদি খেয়াল করি, কোন এক দেশের জিঙ্গোইজম-আসক্ত রাষ্ট্রপ্রধান মনের কথায় সৌহার্দ্য বিলি করছেন, কুৎসিত রকমের সম্পত্তির অধিকারী শিল্পপতি সমাজতন্ত্রের গান গাইছেন, তবে ধরে নিতেই হবে নেপথ্যে রয়েছে ডিপফেকস। বস্তুত, এই প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে কয়েকটি মাউস ক্লিকে দেশে দাঙ্গা বাধানো যায়, মানুষকে প্ররোচিত করা যায় অসহায় আদিবাসী নারীর নৃশংস ধর্ষণে। আবার এই প্রযুক্তিকে ব্যবহার করেই তলস্তয়ের পুনরুজ্জীবন ঘটানো যায়, রূপসী বাংলায় পথ হাঁটা যায় জীবনানন্দের সঙ্গে, আইনস্টাইনের কণ্ঠে শুনে নেওয়া যায় ব্রাদার্স কারমাজভের অন্তর্গত বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ অংশগুলো।
মোদ্দা কথা, কৃত্রিম বুদ্ধি এমন এক পর্যায়ে উদ্ভাবনকে নিয়ে যেতে পারে যা আত্মস্থ করার জন্য মানব সভ্যতা হয়তো এখনও প্রস্তুতই নয়। সিসিটিভি ক্যামেরায় নজরদারির মাধ্যমে মা হয়তো সন্তানের থেকে অনেক দূরে থেকে বড়জোর তার গতিবিধির ওপর চোখ রাখতে পারে। কিন্তু এমন দিন তো আসতেই পারে, সদ্য একুশে পা দেওয়া আগামী প্রজন্মের কোন এক যুবক বা যুবতী নিজের চোখে যা দেখবে তার সবটাই আরও উন্নত কৃত্রিম বুদ্ধিতে ঠাসা অ্যাপের মাধ্যমে মোবাইল স্ক্রিনে দেখতে পাবে তার বাবা-মা প্রত্যেক মুহূর্তে। চুপিচুপি সন্তানও জেনে নিতে পারে তার বাবা-মায়ের ভীষণ ব্যক্তিগত জগৎ, গোপন আকাঙ্ক্ষা। এই নিবিড় মনস্তাত্ত্বিক অভিঘাত খুব কাছের সম্পর্কগুলিকে কীভাবে দুমড়ে মুচড়ে দিতে পারে, তার কিছুটা আন্দাজ এখনই করা যেতে পারে।
কৃত্রিম বুদ্ধি জলবায়ু বিপর্যয়ের মোকাবিলা করবে নাকি বাস্তবতা থেকে ছিটকে ফেলে মানুষকে মেটাভার্সের কোয়ান্টাম ফ্যান্টাসি দুনিয়ায় ভুলিয়ে রাখবে, এই প্রশ্ন সংগত কারণেই প্রতিদিন আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। আমরা কী করতে পারি? আর কিছু না হোক, মানুষ হিসেবে বড়জোর একে অপরের কানে নিরন্তর বলে যেতে পারি, ‘প্রযুক্তির রাশ ছিনিয়ে তোমাকেই তা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে একদিন। মনে রেখো, প্রযুক্তির নয়, প্রকৃতির সন্তান তুমি। সবচেয়ে বুদ্ধিমান, হৃদয়বান, সীমাহীন শক্তিতে ভরপুর অনন্য এক প্রজাতি। তোমাকে ঠিক ছাঁচে ফেলা যায় না। তুমি অযান্ত্রিক, তুমি মানুষ।’ (অযান্ত্রিকের কড়চা)