সংস্কৃত শব্দ যেগুলি বাংলা ভাষায় চেহারা বদল না-করে সোজাসুজি চলে এসেছে সেই শব্দগুলির ক্ষেত্রে বানানের যে নিয়ম সে নিয়ম অন্যান্য শব্দের ক্ষেত্রে আমরা খাটাই না। ধ্রুপদ আর ধ্রুপদি চেহারা না বদলানো সংস্কৃত শব্দ নয়। তাই এ-বানান দীর্ঘ-ই না লিখে আমরা হ্রস্ব-ই লিখতে বলছি। সংস্কৃত শব্দ আমরা কিন্তু সংস্কৃতের মতো করে উচ্চারণ করি না। বাঙালিদের উচ্চারণ অন্যরকম। তবু সংস্কৃত শব্দের উচ্চারণ আমাদের মতো করলেও চেহারা বদল না করা সংস্কৃত থেকে বাংলা ভাষায় আসা শব্দগুলির ক্ষেত্রে বানানের ণত্ব-ষত্ব রক্ষা করি। উচ্চারণ দীর্ঘ না করলেও বানানে দীর্ঘ-ই, দীর্ঘ-উ বজায় রাখি।
গ্রাফিক্স: দীপঙ্কর ভৌমিক
বছর ফুরল। নিত্যানন্দবাবু এ-সময় অন্য অনেকের মতো হিসেব কষেন। ‘কী পেলাম’ আর ‘কী পেলাম না’– তার হিসেব। অন্য বছর যা একা একা করেন, এবার স্থির করলেন তা রকে বসে করবেন। কথায় বলে দশে মিলি করি কাজ, হারি-জিতি নাহি লাজ। তাঁদের রকের আড্ডায় দশজন নেই, তবে ছ’-জন তো আছে। পঞ্চরকি আর তিনি। রকবাজদের রকি বলে ডাকার দস্তুর এ-পাড়ায় বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। অনেকেই তাঁদের রকাড্ডায় (রক+আড্ডা=রকাড্ডা) আসতে ও বসতে চাইছে এবং রকি হয়ে উঠতে চাইছে। তাঁর সহযোগী পঞ্চরকি অন্যদের এন্ট্রি দিতে নারাজ। তাদের বিশ্বাস, পঞ্চরকি বা রকিপঞ্চক পঞ্চপাণ্ডব জাতীয় কিছু একটা। এখানে অন্যরা নট অ্যালাউড। নিত্যানন্দবাবু, তাদের মাইডিয়ার নেতো, নিতু, নেত পাঁচজনের দলে ষষ্ঠ রকি নয়, সে হল সখাকৃষ্ণ। যেমন পঞ্চপাণ্ডবের কৃষ্ণসখা, তেমনি তাদের নিতুসখা। সন্দেহ নেই, এই কৃষ্ণসখা ইত্যাদি-টিত্যাদিতে নিত্যানন্দবাবু একটু বিপন্নই বোধ করেন, তবু মেনে নেন।
নিত্যানন্দবাবুকে রকি নম্বর ওয়ান বলল, ‘এ বছর তো আমরা কিছুই পেলাম না নিতুসখা। কেবল তোমাকে আমাদের রক-মাঝারে পেলাম, যেতে দেব না, যেতে দিলে নিতুসখাকে আর তো পাব না।’
নিত্যানন্দবাবু তাঁর নাক রকির নিকটে এনে মুখের ঘ্রাণ গ্রহণ করলেন। সন্দেহজনক কিছু পেলেন না। ধরে নিলেন রকি ওয়ান সুস্থ-মস্তিষ্কেই তাঁর সঙ্গে কথা বলছে।
রকি টু বললে, ‘নিতু সখা তুমি কী গন্ধ চেনো? নাক এগিয়ে কী ফল পাবে? ধেনো-বাংলা-স্কচ তিনের আলাদা আলাদা গন্ধ তুমি জানো!’
নিত্যানন্দবাবু ধরা-পড়ে একটু লজ্জাই পেয়ে গেলেন। এরই মধ্যে রকি থ্রি এগিয়ে এসে বলল, ‘আমরা এ-বচ্ছরে বাংলা ভাষার আগে ধ্রুপদী তকমা পেলাম।’
মদ্যপথ থেকে কথা ভাষাপথে অগ্রসর হচ্ছে দেখে নিত্যানন্দবাবু স্বস্তি পেলেন। মদ নিয়ে তাঁর জ্ঞান খুবই তাত্ত্বিক ও সে-জন্যই অবাস্তবিক। ভাষা নিয়ে কথা ওঠায় তাঁর কিছু বলার অবকাশ তৈরি হল।
রকি পাঁচ বলল, ‘আচ্ছা নীতুডিয়ার। ধ্রুপদী বানান কী? হ্রস্ব-ই না দীর্ঘ-ই?’
…………………………………….
নিত্যানন্দবাবুকে পাত্তা না দিয়ে পাঁচরকি হঠাৎ নাচতে শুরু করল। প্যান্ডেলের নাচ নয়, বিশুদ্ধ রবীন্দ্রনৃত্যের মতো কিছু একটা। তারপর একযোগে বলে উঠল আমরা সবাই রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের মতো ভদ্র হব। আমরা দীর্ঘ-ই দিয়ে ধ্রুপদী লিখে দেওয়ালে দেওয়ালে বছর শেষে বাংলা ভাষার জয়গান লিখে রাখব। নিত্যানন্দবাবুর পাওয়া আর না-পাওয়ার হিসেব গুলিয়ে গেল।
…………………………………….
বছরের শেষ দিনে রকিগণ জ্ঞানলোলুপ হয়ে উঠবে, নিত্যানন্দবাবু একেবারেই ভাবেননি। তিনি হিসেব কষতে এসেছিলেন। পাওয়া না-পাওয়া বুঝতে এসেছিলেন। কথা যে একেবারে ধেনো ও বাংলা মার্গ থেকে ভাষা-বাংলা মার্গে গমন করবে ভাবতেও পারেননি। তাই খুব আহ্লাদ হল। একটু টুইস্ট নাচতে ইচ্ছে করল, তবে মনে মনে। সৌমিত্র অভিনীত ‘তিন ভুবনের পারে’ তাঁর খুবই প্রিয় সিনেমা। কিন্তু তিনি তো নিত্যানন্দ– সৌমিত্র নন, কাজেই মনে মনে টুইস্ট নেচে তিনি বললেন, ‘আমার এক মাস্টারমশাই বুঝিয়েছেন এবং ঠিকই বুঝিয়েছেন ধ্রুপদি লেখা উচিত। অর্থাৎ হ্রস্ব-ই। ধ্রুবপদ থেকে এসেছিল ধুরপদ। সেই ধুরপদ থেকে হল ধ্রুপদ। ধ্রুবপদ তৎসম মানে সংস্কৃত সমাসবদ্ধ পদ। ধুরপদ তা নয়, ধ্রুপদ-ও অসংস্কৃত। কাজেই দীর্ঘ-ই লিখে তাকে সম্মান জানানো অনুচিত।’
রকি চার বলল, ‘নিতু, মাইরি কিছুই বুঝলাম না। জল মেশাও জল মেশাও। নিট সইবে না।’
রকি পাঁচ বলল, ‘আজ বছরের শেষ দিনে নিতুকে নিট খাওয়াব তাও নিতুর পয়সায়।’ সকলে হে-হে, খিক-খিক করে উঠল।
নিত্যানন্দবাবু বুঝলেন তাঁকে সোজা করে বিষয়টা বোঝাতে হবে। বললেন, ‘হে রকিবৃন্দ। মন দিয়ে শোনো। সংস্কৃত শব্দ যেগুলি বাংলা ভাষায় চেহারা বদল না-করে সোজাসুজি চলে এসেছে সেই শব্দগুলির ক্ষেত্রে বানানের যে নিয়ম সে নিয়ম অন্যান্য শব্দের ক্ষেত্রে আমরা খাটাই না। ধ্রুপদ আর ধ্রুপদি চেহারা না বদলানো সংস্কৃত শব্দ নয়। তাই এ-বানান দীর্ঘ-ই না লিখে আমরা হ্রস্ব-ই লিখতে বলছি। সংস্কৃত শব্দ আমরা কিন্তু সংস্কৃতের মতো করে উচ্চারণ করি না। বাঙালিদের উচ্চারণ অন্যরকম। তবু সংস্কৃত শব্দের উচ্চারণ আমাদের মতো করলেও চেহারা বদল না করা সংস্কৃত থেকে বাংলা ভাষায় আসা শব্দগুলির ক্ষেত্রে বানানের ণত্ব-ষত্ব রক্ষা করি। উচ্চারণ দীর্ঘ না করলেও বানানে দীর্ঘ-ই, দীর্ঘ-উ বজায় রাখি। তাই সেখানে নিয়ম এক রকম। আর যেখানে শব্দগুলি সংস্কৃতের চেহারা বদল না-করা শব্দ নয়, চেহারার বদল হয়েছে কিংবা সংস্কৃত ছাড়া অন্য ভাষা থেকে এসেছে সেখানে বানানের নিয়ম আরেক রকম। হ্রস্ব-ই কিম্বা হ্রস্ব-উ লিখে থাকি।’
রকি ওয়ান বলল, ‘বুঝেছি। সাহেবি ক্লাবে বাঙালি বাচ্চা ঢুকলেও ড্রেস কোড মানতে হবে। সংস্কৃত থেকে চেহারা বদল না করে আসা শব্দ বাংলা মদের ঠেকে ঘুরলেও টাই-কোট ছাড়বে না, অর্থাৎ, বানানটি বজায় রাখবে। ধ্রপদি সংস্কৃত মাল নয়, তাই হ্রস্ব।’
নিত্যানন্দবাবু হাততালি দিয়ে উঠলেন।
রকি টু জিজ্ঞাসা করল, ‘নিতু মা ডার্লিং সবই তো বুঝেছি, কিন্তু একটা প্রশ্ন আছে। ধুরপদ তুমি বললে ধ্রুবপদ থেকে এসেছে। ধ্রুব বেশ যুক্তাক্ষর বহুল ভার-ভার শব্দ। সে তুলনায় যুক্তাক্ষর ভাঙা ধুরপদ হালকা। আবার সে কেন ধ্রুপদ হল? যুক্তাক্ষর ভেঙে আবার কেন যুক্তাক্ষর নিল?”
রকি ফাইভ বলল, ‘আরে দেখিসনি শ্মশানের ঠেকে বাংলা খেয়ে মাথায় উঠলে কোনও কোনও মাতাল বলে বাবা আমি ভদ্দরলোক। আমার কোট আছে টাই আছে। চাইলেই পরে এসে ভাঁড়ে মাল খেতে পারি। খাচ্ছি না। এও তেমন।’
রকি টু: ‘বুঝলাম না। খোলসা খোলসা।’
রকি ফাইভ: ‘তোর বুদ্ধি কমে যাচ্ছে। আরে ভদ্রলোককে গাল দিতে যেমন ইচ্ছে করে তেমনি মাঝে মাঝে ভদ্রলোক সাজতেও ইচ্ছে করে। যারা ধ্রুবপদ বলতে না পেরে ধুরপদ ধুরপদ বলত তারা একদিন ভদ্রলোকের মতো উচ্চারণ করতে গিয়ে ধ্রুপদ শব্দটি তৈরি করে ফেলল।’
…………………………………………………………
আরও পড়ুন বিশ্বজিৎ রায়-এর লেখা: ধ্রুপদী ভাষা নিয়ে ধোঁয়াশা কাটানো একটা রকের আধুনিক আড্ডা
…………………………………………………………
রকি ওয়ান: ‘তার মানে ধ্রুপদ আর ধ্রুপদী সংস্কৃত ভদ্রলোক সাজতে চাইবার ইচ্ছে থেকে তৈরি শব্দ।’
রকি ফাইভ: ‘ঠিক সেই ইচ্ছেকে সম্মান জানাতে আমি ধ্রুপদী লিখব। দীর্ঘ-ই।’
সেকথা শুনে সকলের কী আহ্লাদ। তারা বলল আজ থেকে তারা রকি মাত্র নয়, মাঝে মাঝে ধ্রুপদী সংস্কৃত ভদ্রলোক।
নিত্যানন্দবাবুকে পাত্তা না দিয়ে পাঁচরকি হঠাৎ নাচতে শুরু করল। প্যান্ডেলের নাচ নয়, বিশুদ্ধ রবীন্দ্রনৃত্যের মতো কিছু একটা। তারপর একযোগে বলে উঠল আমরা সবাই রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের মতো ভদ্র হব। আমরা দীর্ঘ-ই দিয়ে ধ্রুপদী লিখে দেওয়ালে দেওয়ালে বছর শেষে বাংলা ভাষার জয়গান লিখে রাখব।
নিত্যানন্দবাবুর পাওয়া আর না-পাওয়ার হিসেব গুলিয়ে গেল। তিনি তৎক্ষণাৎ বেসুরে গেয়ে উঠলেন,
‘জীবনে কি পাব না
ভুলেছি সে ভাবনা
সামনে যা দেখি, জানি না সেকি
আসল কি নকল সোনা
জীবনে কি পাব না
ভুলেছি সে ভাবনা
সামনে যা দেখি, জানি না সেকি
আসল কি নকল সোনা।’
পাঁচ-রকি নিত্যানন্দবাবুকে নিয়ে বছর শেষে ‘ধ্রুপদী’ বাংলা ঠেকে বাংলা স্কচ খেতে গেল। নিত্যানন্দবাবু বললেন, বানানের কেবল নিয়ম নেই, বানানের সামাজিকতাও আছে – থাকা উচিত।
……………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………..