জেমস প্রিন্সেপ ছিলেন বহুমুখী প্রতিভাধর এক মানুষ। স্থাপত্যবিদ্যা, আবহাওয়াবিদ্যা, চিত্রাঙ্কন, ধাতুবিদ্যা, মুদ্রাতত্ত্বের পাশাপাশি ভাষা ও হরফবিদ্যাতেও তাঁর বিপুল জ্ঞান ছিল। কলকাতা টাঁকশালে উইলসনের ছেড়ে যাওয়া পদে বসেছিলেন জেমস প্রিন্সেপ, পাশাপাশি কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির সম্পাদকও হলেন তিনি। এই পদে থাকাকালীন তিনি তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজটা করেছিলেন, যা বদলে দিয়েছিল ভারতের ইতিহাস চর্চার অভিমুখটাকেই। বিষয়টা একটু খুলেই বলা যাক।
কর্মসূত্রে ভারতে এসে নিজেদের কর্মদক্ষতায়, উইলিয়াম জোন্স, জেমস হিকি, ডেভিড হেয়ারের মতো যে কয়েকজন বিদেশি ভারতবাসীর আপন হয়ে উঠেছিলেন, জেমস প্রিন্সেপ ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। স্বল্পায়ু প্রিন্সেপ ভারতে ছিলেন, কমবেশি ২০ বছরের মতো। ওই অল্প সময়কালেই তিনি এমন কিছু কাজ করেছিলেন, যা ভারতের ইতিহাসের অভিমুখটাকেই পালটে দিয়েছিল।
জেমস প্রিন্সেপের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক তাঁর বাবার সূত্রে। জেমসের বাবা জন প্রিন্সেপ ভারতে এসে নীলচাষ করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে ইংল্যান্ডে ফিরে যান। তাঁর সাত ছেলেই চাকরি করতে আসেন ভারতে, সেই সূত্রে জেমসও।
আজ থেকে ২২৫ বছর আগে, ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২০ অগস্ট, ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন জেমস প্রিন্সেপ। প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু হয় ক্লিফটনের এক স্কুলে, কিন্তু চোখের সমস্যা দেখা দেওয়ায় সে শিক্ষা সমাপ্ত করতে পারেননি তিনি। প্রথাগত শিক্ষা বেশি না হলেও মেধাবী জেমস নানা বিষয়ে কৌতূহলী ছিলেন এবং খুব সহজেই তিনি বিভিন্ন বিদ্যা আয়ত্ত করতে পারতেন। ১৮১৯ সালে তিনি ভারতে আসেন এবং তাঁর প্রথম চাকরি হয় কলকাতার টাঁকশালে, সহকারী ধাতু পরীক্ষক হিসেবে। চাকরি পাওয়ার পরের বছরেই জেমসকে বদলি করে দেওয়া হল বেনারসের টাঁকশালে। সেখানকার অব্যবস্থা দেখে তিনি নিজেই উদ্যোগী হলেন প্রয়োজনীয় সংস্কারে। তবে শুধু টাঁকশালই নয়, গোটা বেনারস শহরটাকেই তিনি পরিচ্ছন্ন শহর হিসেবে গড়ে তুললেন। কর্মনাশা নদীর ওপরে সেতু নির্মাণ ছাড়াও তাঁর উদ্যোগে তৈরি হল নন্দেশ্বর কোঠি, সেন্ট মেরিজ গির্জার মতো স্থাপত্য। সংস্কার করলেন পঞ্চগঙ্গা ঘাটের কাছে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকা ঔরঙ্গজেব মসজিদ।
বেনারস বা বারাণসী ভারতের অন্যতম প্রাচীন শহর হওয়ার কারণে সেখানকার রাস্তাঘাট অপরিসর তো বটেই, পাশাপাশি শহরের নিকাশি ব্যবস্থাও ছিল খুব প্রাচীন। প্রিন্সেপ সেখানকার বাড়িঘর অক্ষুণ্ণ রেখে মাটির তলায় ইঁটের খিলান বসিয়ে সুড়ঙ্গ তৈরি করে গোটা শহরের নিকাশি ব্যবস্থাকে সে যুগের নিরিখে আধুনিক করে তুললেন। প্রিন্সেপ তাঁর ১০ বছরের বেনারস-যাপনে সেখানকার মানুষদের এতই আপন হয়ে উঠেছিলেন যে, বেনারসবাসী তাঁকে একখণ্ড জমি উপহার দিয়েছিল, যদিও তা তিনি তাদেরই ফিরিয়ে দেন। প্রিন্সেপ খুব ভালো ছবি আঁকতে পারতেন। কলকাতা থেকে বেনারসে যাতায়াতের পথে এবং সেখানে থাকাকালীন তিনি ওই শহরের অনেক ছবি এঁকেছিলেন। সেই সব ছবি লন্ডন থেকে লিথোগ্রাফ করে ছাপা হয় ‘বেনারস ইলাসট্রেটেড’ নামে।
প্রায় ১০ বছর বেনারসে কাটিয়ে আবার কলকাতার টাঁকশালে যোগ দিলেন জেমস। তাঁর উপরওয়ালা হোরেস হেম্যান উইলসন ছিলেন খুবই পণ্ডিত ব্যক্তি। টাঁকশালের প্রধান হওয়ার পাশাপাশি তিনি কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির সম্পাদকও ছিলেন। হ্যালহেডের ব্যাকরণখ্যাত চার্লস উইলকিন্স এবং হেনরি টমাস কোলব্রুকের উৎসাহে উইলসন শুধু সংস্কৃত শিখতে আরম্ভই করলেন না, ওই ভাষায় তিনি এতটাই দক্ষতা অর্জন করলেন যে, লন্ডনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁকে সংস্কৃতের অধ্যাপকের পদ দেওয়া হল। ফলে কলকাতা টাঁকশালে উইলসনের ছেড়ে যাওয়া পদে বসলেন জেমস প্রিন্সেপ, পাশাপাশি কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির সম্পাদকও হলেন তিনি। এই পদে থাকাকালীন তিনি তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজটা করেছিলেন, যা বদলে দিয়েছিল ভারতের ইতিহাস চর্চার অভিমুখটাকেই। বিষয়টা একটু খুলেই বলা যাক।
অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে প্রাচ্যবিদ্যা ও প্রাচ্যভাষার পণ্ডিত উইলিয়ম জোন্সের ডাকে সাড়া দিয়ে ৩০ জন প্রাচ্য বিদ্যানুরাগী ইউরোপীয় ১৭৮৪-র ১৫ জানুয়ারি এক আলোচনা সভায় মিলিত হন। সেখান থেকেই জন্ম হয় এশিয়াটিক সোসাইটির। সোসাইটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক হন বাংলার তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস এবং জোন্স নিজে হন সভাপতি। উদ্দেশ্য, উপনিবেশ ভারতবর্ষের ইতিহাস খোঁজা এবং তা নিয়ে চর্চা করা। জন্মলগ্ন থেকেই স্থির করা হয় যে, এই প্রতিষ্ঠান শুধু ভারতীয় উপমহাদেশই নয়, সমগ্র এশিয়া মহাদেশের ভৌগোলিক সীমার মধ্যে ঘটে যাওয়া সব রকম প্রাকৃতিক ও মানবিক বিষয়ের বিজ্ঞানসম্মত অনুসন্ধান ও অনুশীলন করবে। কিন্তু সমস্যা বাঁধল, ইসলাম যুগের আগের তথ্যাবলি নিয়ে।
হিন্দু পণ্ডিতেরা ইতিহাস বলতে যা নিয়ে এলেন, সেগুলো পুরাণ, ধর্মাশ্রয়ী বহু গল্পের সমাহার, বস্তুনিষ্ঠ তথা বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাস বলতে যা বোঝায়, তা ঠিক নয়। সেখানে অশোক নামে মগধের এক রাজার কথা থাকলেও তৎকালীন আর পাঁচটা সামন্ত-রাজার থেকে বেশি গুরুত্ব তাঁর ছিল না আর গৌতম বুদ্ধ এবং তাঁর প্রবর্তিত ধর্মমত সম্পর্কে তেমন কোনও উচ্চবাচ্যও নেই।
পুরাণ ও অন্যান্য হিন্দু শাস্ত্র থেকে জানা গেল, গৌতম বুদ্ধ হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর নবম অবতার, কিন্তু তাঁর কাজ ছিল, জগৎবাসীকে নাস্তিকতা শেখানো, যার ফলে সমাজ অধর্মে পতিত হয় এবং তার পর দশম অবতার কল্কি এসে অধর্ম নাশ করে ধর্ম প্রতিষ্ঠা করবেন ইত্যাদি, ইত্যাদি। অথচ, একাদশ-দ্বাদশ শতকের ইতালীয় পর্যটক মার্কোপোলোর বিবরণ অনুসারে জোন্স জানতেন, বুদ্ধ নামে এক ধর্মপ্রচারকের প্রবর্তিত কোনও এক ধর্ম এই উপমহাদেশে প্রচলিত ছিল। শুনতে আশ্চর্য লাগলেও, অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে ভারতে বৌদ্ধ ধর্মালম্বী থাকলেও তাদের কথা বিশেষ ভাবে প্রচলিত ছিল না, ফলে জোন্স তাদের খোঁজও পাননি।
হিসেব না মিললেও, নিজের জ্ঞান এবং এ দেশের পণ্ডিতদের দেওয়া পুরাণাশ্রিত আখ্যান মিলিয়ে ১৭৮৯-এর ‘এশিয়াটিক রিসার্চেস’ পত্রিকায় জোন্স এক প্রবন্ধ লিখলেন বুদ্ধ এবং বৌদ্ধ ধর্ম বিষয়ে। প্রবন্ধ প্রকাশ হবার পর দেশ-বিদেশ থেকে প্রতিক্রিয়া আসতে আরম্ভ করল। ইতিপূর্বে ভারতের বাইরে চিন, জাপানের মতো বিভিন্ন দেশে বৌদ্ধ ধর্মের চর্চা ছিল এবং অনেকেই নিজের মতো করে সেই সব শাস্ত্র নিয়ে চর্চা করেছেন। তাঁরা সোসাইটি এবং জোন্সের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন, সহযোগিতা করলেন তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে। সব মিলিয়ে জানা গেল, ভারতবর্ষ থেকে হারিয়ে গেলেও বৌদ্ধ ধর্মের সূচনা এবং বিস্তার ভারতেই এবং সেটা মগধ নামের এক অঞ্চলের মধ্যেই।
আরও খোঁজাখুঁজি করে আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণকে কেন্দ্র করে গ্রিকদের লেখা কিছু কাহিনি-উপকাহিনি-বিবরণের থেকে কিছু সূত্র পাওয়া গেল। জানা গেল, গ্রিক সম্রাট আলেকজান্ডার ভারত আক্রমণ করেন ৩২৭ পূর্ব-সাধারণাব্দে। কিন্তু সম্পূর্ণ ভারতজয় তাঁর হয়নি। নানা কারণে তিনি দেশে ফিরে যেতে বাধ্য হন, পথে ব্যাবিলনে ৩২৩ পূর্ব-সাধারণাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়। সেনাপতি সেলুকাস প্রায় বছর পর, ৩০৫ পূর্ব-সাধারণাব্দ নাগাদ গ্রিকদের জয় করা রাজ্য পুনরুদ্ধারের আশায় আবার ভারতে ফিরে আসেন। কিন্তু সে যাত্রায় তিনি বিশেষ সুবিধে করতে পারেননি।
‘সান্ড্রোকোপ্টস’ নামে মগধের এক প্রবল পরাক্রমশালী সম্রাটের সঙ্গে সন্ধি করতে বাধ্য হন, নিজের কন্যার বিবাহও দেন ওই রাজপরিবারে। ওই ‘সান্ড্রোকোপ্টস’-এর রাজসভায় সেলুকাসের পাঠানো দূত মেগাস্থেনিসের লেখা বিবরণ ‘ইন্ডিকা’ থেকে জানা গেল, সান্ড্রোকোপ্টস-এর রাজধানী ‘পালিম্বোথ্রা’ ছিল গঙ্গা এবং ‘এরানোবোয়াস’ নদীর সঙ্গমস্থলে। গঙ্গার অস্তিত্ব জানা থাকলেও পুরাণ ঘেঁটে কোথাও ‘এরানোবোয়াস’ নদী বা ‘পালিম্বোথ্রা’ নামে স্থানের কথা পাওয়া গেল না বটে কিন্তু মগধের রাজধানী পাটলীপুত্রের কথা পাওয়া যাচ্ছে অনেক জায়গাতেই!
ইতিমধ্যে কোম্পানির উদ্যোগে আধুনিক মানচিত্র তৈরির কাজ আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। এক সময়ে সেই কাজের ভারপ্রাপ্ত বাংলার প্রথম সার্ভেয়ার জেনারেল তথা মানচিত্রকার মেজর জেমস রেনেল বিভিন্ন তথ্য ঘেঁটে দেখলেন, আধুনিক পাটনার কাছে গঙ্গা আর সোন নদীর সঙ্গম। কিন্তু এক সময় সোন নদীর পুরনো খাত গঙ্গার সঙ্গে মিলিত হওয়ার আগে দু’ভাগে ভাগ হয়ে গিয়ে মাঝে একটা লম্বাটে ডিমের মতো দ্বীপ সৃষ্টি করেছিল। তিনি জোন্সকে জানালেন, ওই দ্বীপের মতো জায়গাটাই পাটলিপুত্র বা ‘ইন্ডিকা’ বর্ণিত ‘পালিম্বোথ্রা’ একই হতে পারে। কিন্তু হতে পারে বললে তো হবে না, প্রমাণ চাই!
প্রমাণ পাওয়া গেল আবার সেই প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থ থেকে। একটা সংস্কৃত সূত্র থেকেই দেখা গেল, গ্রিকরা নিজেদের উচ্চারণ অনুসারে যাকে ‘এরানোবোয়াস’ লিখেছিল, নদীর আদত নাম ছিল ‘হিরণ্যবাহ’, যা থেকে পরে সোন হয়েছে। এবং সদ্য আবিষ্কৃত সংস্কৃত পুথি সোমদেবের কথাসরিৎসাগর আর বিশাখদত্তের মুদ্রারাক্ষস থেকে চাণক্য নামে এক ব্রাহ্মণের কূটবুদ্ধির সাহায্যে চন্দ্রগুপ্ত কী ভাবে নন্দবংশ ধ্বংস করে মগধের সিংহাসন দখল করেছিল তারই বিবরণ পাওয়া গেল।
সব মিলিয়ে জানা গেল, মেগাস্থেনিসের সম্রাট ‘সান্ড্রোকোপ্টস’ই সংস্কৃত পুথির শশীগুপ্ত বা চন্দ্রগুপ্ত, যাঁর রাজধানী ছিল ‘এরানোবোয়াস’ বা ‘হিরণ্যবাহ’ বা ‘সোন’ নদী ও গঙ্গার সঙ্গমস্থল ‘পালিম্বোথ্রা’য় বা ‘পাটলিপুত্র’য় যা আজকের পাটনা বা তার কাছাকাছি অঞ্চল।
এশিয়াটিক সোসাইটির দশম বর্ষপূর্তি সভায়, ১৭৯৩-এর ২৮ ফেব্রুয়ারি উইলিয়াম জোন্স পালিম্বোথ্রা > পাটলিপুত্র > পাটনা আর অন্য দিকে সান্ড্রোকোপ্টস > সিসিকোটাস > চন্দ্রগুপ্ত– এই দু’টি আবিষ্কারের কথাই ঘোষণা করলেন। বিবরণ ছাপা হল ‘এশিয়াটিক রিসার্চেস’-এ। কিন্তু দুভার্গ্যজনক ভাবে, এর মাত্র দু’বছরের মধ্যে জোন্স মারা গেলেন এবং সেই সঙ্গে এই গবেষণাও প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হল।
ইংরেজরা এ দেশে আসার অনেক আগে থেকেই, ইসলাম যুগে অনেক মসজিদ, তোরণ ইত্যাদি তৈরি করতে কিছু আলাদা রকমের নকশা করা বড় বড় পাথর ব্যবহার করা হয়েছিল। সেগুলোর গায়ে ফুল-পাতা, জীবজন্তুর নকশার পাশাপাশি কিছু দুবোর্ধ্য হরফে কিছু লেখা। কিন্তু কেউই তখন জানেন না, সেগুলো কীসের পাথর! অনেক ক্ষেত্রেই স্থানীয় মানুষজন দেবতা হিসেবে সেগুলোর পুজোও করে।
জোন্সের মৃত্যুর পর ওই বিশেষ প্রকল্পের কাজ স্থিমিত হলেও খোঁড়াখুড়ির কাজ চলছিল। ভারতের প্রথম সার্ভেয়ার জেনারেল কলিন ম্যাকেঞ্জি, ফ্রান্সিস বুকানন দক্ষিণ ও পূর্ব ভারত থেকে প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করলেন, তা থেকে বুদ্ধ, অশোকের সম্পর্ক বোঝা গেলেও স্পষ্ট হচ্ছিল না কিছুতেই। এমতাবস্থায়, ১৮৩২ সালে, হোরেস হেম্যান উইলসনের জায়গায় এশিয়াটিক সোসাইটি কলকাতার দায়িত্ব পেলেন জেমস প্রিন্সেপ। ওই মানুষটির উদ্যম এবং চেষ্টাতেই কাটল জট।
প্রিন্সেপ ছিলেন বহুমুখী প্রতিভাধর এক মানুষ। স্থাপত্যবিদ্যা, আবহাওয়াবিদ্যা, চিত্রাঙ্কন, ধাতুবিদ্যা, মুদ্রাতত্ত্বের পাশাপাশি ভাষা ও হরফবিদ্যাতেও তাঁর বিপুল জ্ঞান ছিল। উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন জায়গা এবং বিহার-ওড়িশা অঞ্চল থেকে পাওয়া স্তম্ভগুলোর গায়ের হরফ বিশ্লেষণ করে প্রিন্সেপ একটা সাধারণ মিল খুঁজে পেলেন। তিনি অনুমান করলেন, ওগুলো সম্ভবত কোনও বার্তা, কিন্তু হরফ তো অচেনা! প্রাচীন মুদ্রা বিশেষজ্ঞ প্রিন্সেপের কাছে সে অচেনা হরফও ধরা দিল। চেনা গেল ব্রাহ্মী লিপির হরফ। হরফ চেনার পর লিপি সাজিয়ে পাঠোদ্ধার হল এক বার্তা– ভারতের ইতিহাসে যা সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক আবিষ্কার। ‘দেবানাম্পিয় পিয়দসি লাজ হেবাম্ অহা…’ অর্থাৎ, দেবগণের প্রিয় প্রিয়দর্শী রাজা এমত বলিলেন…
১৮৩৭ সাধারণাব্দের ৭ জুন কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটির মাসিক সভায় জেমস প্রিন্সেপ ভারতজোড়া সাম্রাজ্যের অধিকারী ‘দেবগণের প্রিয় প্রিয়দর্শী’ রাজাকে খুঁজে পাওয়ার কথা জানালেন। অবশ্য তখনও অবধি নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছিল না রাজা আসলে কে! প্রায় সমকালেই শ্রীলঙ্কা, শ্যাম প্রভৃতি দেশ থেকে পাওয়া বেশ কিছু পুথি অনুবাদ করে দেখা গেল, অশোক নামের যে সম্রাট বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের জন্য সারা জীবন ব্যয় করেছেন তিনি প্রিয়দর্শী।
ওই আবিষ্কারকে ভারতের ইতিহাসে যুগান্তকারী বললেও কম বলা হয়। গুপ্ত রাজবংশের শাসনকাল থেকে নব্য-হিন্দুত্ববাদের প্রবল চাপে বৌদ্ধরা ক্রমে পূর্ব ভারতের দিকে সরে যেতে থাকে। বঙ্গদেশে হিন্দু রাজা শশাঙ্কের মৃত্যুর ১০০ বছর পর থেকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল রাজবংশের সূচনা হয়। তারা প্রায় সাড়ে ৪০০ বছর রাজত্ব করে কিন্তু তার পর কট্টর হিন্দু সেন বংশীয় রাজাদের প্রতাপে পাল রাজবংশের পতন হয় এবং বৌদ্ধরাও ক্রমে চট্টগ্রামের দিকে পালিয়ে যেতে থাকে আত্মরক্ষার তাগিদে। বৌদ্ধদের অনুপস্থিতির সুযোগে তৎকালীন নব্য-হিন্দুত্ববাদের ধারক ও বাহকেরা গোটা ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে গৌতম বুদ্ধ এবং সম্রাট অশোক-সহ বৌদ্ধযুগের প্রায় সমস্ত চিহ্ন মুছে দিয়ে বুদ্ধকে এক সাধারণ ধর্মগুরু আর অশোককে এক সামান্য সামন্তরাজা সাজিয়ে পুরাণভিত্তিক ইতিহাস নির্মাণ করে রেখেছিল।
এশিয়াটিক সোসাইটির মাধ্যমে উইলিয়াম জোন্স সেই মিথ্যে ইতিহাস মুছে যে ‘ভারত-ইতিহাসের খোঁজ’ আরম্ভ করেছিলেন, তাকে সম্পূর্ণ করলেন জেমস প্রিন্সেপ। অবশ্য তার পর আর বেশি দিন বাঁচেননি তিনি। প্রবল কাজের চাপে অসুস্থ হয়ে ইংল্যান্ডে ফিরে যান, সেখানেই ১৮৪০ সালের ২২ এপ্রিল, মাত্র ৪১ বছর বয়সে প্রয়াত হন তিনি।
তথ্যঋণ Journal of The Asiatic Society, Vol. LXVI, No. 2, 2024
ব্যক্তিঋণ ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী