১৯৬০-র শেষের দিকে ছোট ভাইয়ের সংসারে থাকতেন পুষ্পলতা রায়। এক অর্থে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন। একটা ছোট কালো রঙের ট্রাঙ্ক, নিচু মোড়ার ওপর রাখা– ছোটবেলায় অনেকটা পদীপিসির বর্মী-বাক্স মনে হত। বড়দিদুর লেখার কথা কেউ মনে রাখে না। গার্হস্থ্য দায়িত্বের মাঝে যখনই সুযোগ পেয়েছেন লেখালিখি ও সেলাই নিয়ে বসতেন। লাইন টানা ‘স্কলার’ এক্সারসাইজ খাতায় ইংরেজি থ্রিলার অনুবাদ করতেন। বিশেষ করে মনে আছে, একবার আগাথা ক্রিস্টির ডিটেকটিভ নভেল অনুবাদ করছিলেন, খুব সহজবোধ্য করে ঝরঝরে লেখা পড়ে পড়ে শোনাতেনও।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’র প্রারম্ভেই লিখেছেন, ‘স্মৃতির পটে জীবনের ছবি কে আঁকিয়া যায় জানি না। …বস্তুত তাহার কাজই ছবি আঁকা, ইতিহাস লেখা নয়।’ স্মৃতিকথার জের ধরেই বলতে পারি, নিজের জীবনটুকুর পরিধির মধ্যেই ফিরে দেখলে কত মানুষের মুখ ভেসে ওঠে– আত্মীয়-অনাত্মীয়, বন্ধু-পরিচিত। কত কথা মনে পড়ে, মনের কোণায় লুকিয়ে থাকা কত ঝাপসা ছবি, ফোটোগ্রাফ অ্যালবামের পাতা উল্টোলে জ্বলজ্বল করে ওঠে। যে মানুষকে দেখেছি, যে মানুষকে দেখিনি, যা গল্প শুনেছি, যে গল্প মুখ ফুটে কেউ বলেনি, কেমন সময়-অসময়ে মনের মধ্যে আনাগোনা করে।
পারিবারিক সূত্রে দেখা ও চেনা এক দিদিমার কথা খুব মনে পড়ছে– তিনি আমার দিদিমার বড়দি, আমার মায়ের বড় মাসিমা ও আমাদের প্রজন্মের কাছে বড়দিদু বা বড়ঠাম্মা। তাঁকে মনে থাকার মতো দেখেছি, ১৯৫৫ বা ’৬০-এর দশক থেকে তাঁর মৃত্যু অবধি ১৯৭৯-’৮০ পর্যন্ত।
আমাদের বড়দিদু, পুষ্পলতা, ডাক্তার লক্ষ্মীনারায়ণ চৌধুরী ও কুসুমকুমারীর প্রথম সন্তান, জন্ম ২৯ ডিসেম্বর, ১৮৯৪ সালে। এখনকার মধ্যপ্রদেশ, ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে ‘পশ্চিম’ বলে খ্যাত, সেখানে বনেদি বা উচ্চ মধ্যবিত্ত বাঙালিরা হাওয়াবদলের জন্য ভ্রমণে যেতেন– সেই দেশের সাগর ও পরে জব্বলপুরে প্রথিতযশা চিকিৎসক ছিলেন এই প্রবাসী বাঙালি ব্রাহ্ম ভদ্রলোক। পরিপাটি সংসারের মধ্যমণি ছিলেন তাঁর স্ত্রী কুসুমকুমারী, পাঁচ কন্যা ও দুই পুত্রসন্তান।
পিত্রালয়ে বেশ আনন্দে কেটেছে পুষ্পলতার ছেলেবেলা। ভাইবোনদের মধ্যে চিরদিন খুব ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল, আমরাও বুঝতাম তাঁদের সখ্যর উৎস সেই ছেলেবেলার দিনগুলি। শেষদিন অবধি ছোট ভাই (টোগো) ও তাঁর স্ত্রী শেফালী বড়দিদুর সব ভার নিয়ে তাঁদের বাড়িতে রেখে সেবা-যত্ন করেছেন। পুষ্পলতার যখন বিয়ে হয়, তখন ভাই অনেকটাই ছোট কিন্তু দিদির প্রতি দায়িত্ববোধ ও ভালোবাসা– দুটোই ছিল অটুট।
স্ত্রীশিক্ষা নিয়ে উনিশ শতকের শেষার্ধে যে প্রগতিশীল চিন্তা ছিল সেই অনুযায়ী চৌধুরী বংশের মেয়েরা শিক্ষা লাভ করে। তাই বিয়ের আগেই পুষ্পলতা ম্যাট্রিক পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। তা ছাড়া রান্না, সেলাই-বোনা ও অন্যান্য হাতের কাজে নিপুণ ছিলেন। এইগুলির কিছু কিছু আমরাও পরবর্তী সময় দেখেছি, সেই কথায় পরে আসব।
১৯১৫ সালে কলকাতার নাম করা ব্রাহ্ম রায়চৌধুরী পরিবারে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর মাধ্যমপুত্র সুবিনয় (মণি) এর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। ততদিনে উপেন্দ্রকিশোর ও বিধুমুখী ১০০ নম্বর গড়পার রোডের বাড়িতে থাকতে শুরু করেছেন, তাঁদের ২২ নম্বর সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়ি ছেড়ে। এই বাড়িতেই বড়দিদু বধূরূপে প্রবেশ করেন এবং সুবিনয় ও পুষ্পলতা– নব দম্পতি, এইখানেই থাকতেন।
যদিও এটি সুবিনয়ের বিয়ের ও উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যুর কিছু বছর পরেকার স্মৃতি, সত্যজিৎ রায় বাড়ির একটি ম্যাপিং করেছেন:
তিনতলার দক্ষিণের ঘরে থাকতেন আমার মেজোকাকা বা কাকামণি– সুবিনয় রায়।… তিনতলাতেই আরেকটা ঘরে থাকতেন আমার ছোটকাকা সুবিমল রায়।
১০০ নম্বর গড়পার রোডের বাড়ি ইতিহাস তৈরি করেছে উনিশ শতকের নবজাগরণের সময়। তিনতলা বাড়ি তখন জমজমাট। উপেন্দ্রকিশোরের প্রিন্টিং প্রেস এই বাড়িতেই উঠে এসেছিল– বাইরে বাড়ির মাথায় লেখা ছিল ‘M/s U. Ray & Sons, Printers and Block Makers’। এখান থেকে ছোটদের মাসিক পত্রিকা ‘সন্দেশ’ ছাপা হয়েছে ১৯২৫ পর্যন্ত। এই বাড়ি শুধু কর্মকাণ্ডের নয়, নানা হাসি-তামাশার, লেখালিখির এবং বিচিত্র বিষয় গভীর চিন্তা, ব্রাহ্ম সমাজ সংস্কারে বিশ্বাসী ও স্বদেশি ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু। যাতায়াত ছিল ব্রাহ্ম সমাজের দিক্পালদেরও। বৈজ্ঞানিক ও গণিতজ্ঞ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ বা ‘প্রবাসী’ ও ‘মডার্ন রিভিউ’ পত্রিকার রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের, গীতিকার ও সংগীতজ্ঞ অতুলপ্রসাদ সেন, এমনকী, নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের।
‘মানডে ক্লাব’ বা ‘মন্ডা সম্মিলন’ গড়পারের বাড়িতেই অনুষ্ঠিত হত। সোমবার করে মিলিত হতেন এই অসাধারণ সারগ্রাহী বন্ধুদের দল। কত গম্ভীর ও গভীর আলোচনা হত কিন্তু তারই আনাচকানাচে কত কৌতুক, কত ব্যঙ্গ, কত হাসি কত ঠাট্টা লুকিয়ে থাকত। নারী বিবর্জিত এই সম্মিলন, কিন্তু বাড়ির কর্ত্রীরা নিশ্চয়ই আড়ালে থেকেও কিছু হাসির রেশ, কিছু আনন্দের খোরাক কুড়িয়ে নিতেন পাথেয় হিসাবে। আমরা যখন বড়দিদুকে পেয়েছি তখন তাঁর জীবন আমূল পরিবর্তিত– এক অর্থে ‘ট্রাজিক’ বলা যায়। কিন্তু কোনও দিন তাঁর মুখে কোনও আক্ষেপ বা দোষারোপ শুনিনি, বরং হাসি-খুশি গল্পদিদু বলেই পরিচয় পেয়েছি। সুপ্রভা ও পুষ্পলতা শরবত ও রকমারি খাবার যত্নসহকারে তৈরি করতেন। তা ছাড়াও বন্ধুপরিজন কোনও বিশেষ দিনে রায়বাড়ি থেকে পদ্যে নিমন্ত্রণ পেতেন চায়ের আহ্বান:
আসছে কাল শনিবার
অপরাহ্নের সাড়েচার
আসিয়ে মোদের বাড়ি
শুভ পদধূলি ঝরি
কৃতার্থ করিলে সবে
টুলু পুষু খুশি হবে।
বড়দিদুর রান্নার খুব শখ ছিল। আমরাও তার কিছু উপভোগ করেছি। তাঁর হাতে তৈরি মাংসের কিমার শিঙাড়া আর ডিমের ডেভিলের স্বাদ ভোলার নয়!
উপেন্দ্রকিশোরের ১৯১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে মৃত্যু আকস্মিক এক ধাক্কা, কিন্তু বড়পুত্র সুকুমার সংসার ও ব্যবসার হাল ধরলেন। ১৯১৬ সালে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর প্রথম বংশধর– সুবিনয় ও পুষ্পলতার ছেলে সরল কুমারের (ধনো) জন্ম। লক্ষ্মীনারায়ণ চৌধুরীর প্রথম নাতি তাই দুই পরিবারেই সরলের আগমন আনন্দের ঢেউ তুলে দিল। প্রমদারঞ্জন কন্যা লীলার স্মৃতিতে তাঁর মণিদার “একটি মাত্র ছেলে ছিল তাঁর; তাকে আমরা ডাকতাম ‘ধনো’ বলে। ভারি সুন্দর দেখতে ছিল সে; বড় ভালো ব্যবহার। তার মা তাকে চোখে চোখে রাখতেন বলে আমরা হাসাহাসি করতাম। আমার চাইতে ৭-৮ বছরের ছোটো ছিল সে। তখন মনে হত শিশু।”
সত্যজিৎ ( মানিক) সরলের চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট। সত্যজিৎ লিখেছেন:
কাকামণির ছেলে সরল ছিল আমার একমাত্র আপন খুড়তুতো দাদা। তবে দাদা আর কাকিমা অনেক সময়ই থাকতেন কাকার শ্বশুরবাড়ি জব্বলপুরে। দাদার পড়াশুনা হয়েছিল সেখানেই, দাদার ভালো নাম ছিল সরল। ইস্কুলে সাহেবের ছেলেরা দাদাকে ডাকত সিরিল (Cyril) বলে।
একটু আশ্চর্য লাগে যে রায় পরিবারের ইতিহাস বলতে বা লিখতে গিয়ে পরবর্তী কালে, সরল এর অস্তিত্ব কেমন হারিয়ে গিয়েছে– তার বড় হওয়া, তার স্কুল যাওয়া, তার বিলেতযাত্রা, তার দেশে ফেরা, সবই কেমন ধোঁয়াশা।
১৯২৩ সালে দাদা সুকুমারের অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর পরে মেজভাই সুবিনয় প্রেসের কার্যভার উত্তরাধিকার সূত্রে তুলে নিলেন। কিন্তু কিছু বছর আগে থেকেই নানা সমস্যায় জর্জরিত ছিল ব্যবসা। পত্রিকার সূচনা থেকেই তিনি প্রায় নিয়মিত গল্প ছাড়া ও বিজ্ঞান বিষয়ক তথ্য সংগ্রহ করে ছোটদের উপযোগী করে ‘সন্দেশ’-এ ছাপতে দিতেন। এমনকী, পুষ্পলতাও মাঝে মধ্যে ‘সন্দেশ’ এ লেখা দিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে বলা দরকার যে, রায়বাড়ির দুই পুত্রবধূ তখনকার দিনের নারী প্রগতির প্রতীক ছিলেন কিন্তু নেপথ্যে থেকে গিয়েছেন চিরদিন।
ঘটনাক্রমে ১৯২৭ সালে গড়পারের বাড়ি নিলামে বিক্রি হল– যৌথ পরিবার ছত্রখান হয়ে গেল! প্রথমদিকে, পুষ্পলতা ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি জব্বলপুরে থাকতে গেলেন এবং সুবিনয় ভবানীপুরে বকুলবাগানে স্থানান্তরিত হলেন। তিনি কিছুদিন পরে কলকাতার জিওলজিকাল সার্ভে-তে একটা চাকরি নিয়েছিলেন। সুবিনয় তারই ফাঁকে আপ্রাণ চেষ্টা করে গেলেন উপেন্দ্রকিশোরের ড্রিম প্রজেক্ট ছোটদের পত্রিকা ‘সন্দেশ’ পুনরুজ্জীবিত করতে। ১৯৩১ সালে অক্টোবর মাসে নবপর্যায় ‘সন্দেশ’-এর আবির্ভাব হল– সুধাবিন্দু বিশ্বাস ও সুবিনয় রায়ের সম্পাদনায়।
১৯৩৬-৩৭-এ যখন ‘সন্দেশ’-এর অস্তিত্ব টানাপোড়েনের মধ্যে, সেই সময় সুবিনয়-পুত্র সরল বিলেতযাত্রা করেন, তাঁর পিতার অগ্রজ সুকুমারের মতো ফোটোগ্রাফি ও প্রিন্টিং টেকনোলজি আয়ত্ত করতে। ফিনিক্স পাখির মতো রায় পরিবারের বিবর্তনের ভাগীদার হতে চেয়েছিলেন তিনিও। আসলে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন নিজের উত্তরাধিকার সম্বন্ধে।
সরল যখন বিলেতে পঠন-পাঠন করছেন সেই সময়ের কয়েকটি ছবি আছে আর একটি গ্রুপ ছবি, যার উল্টোদিকে পোস্টকার্ডের মতো ধনো সম্ভবত তাঁর মা-কে ছবিটি সম্পর্কে কিছু কথা লিখেছেন:
‘এই ছবিটা যখন পার্কে বরফ পড়েছিল তখন তোলা। ছবিতে দেখতে পাবে আমাদের পা বরফে একেবারে ডুবে গেছে। আমার পাশে John Gutiar বলে একটি French ছেলে, তারপর Jivanandham ( Lahore Govt. press থেকে), তার পর Ghose (Allahabad Govt. press) আর Ghose-এর পাসে Chatterjee (Mohan Bagan-এ খেলতো) ছবিটা Mr. Guha তুলেছেন। ছবি তুলবার সময় বরফ পড়ছিল বোলে শাদা শাদা লাইন দেখা যাচ্ছে আমাদের মুখের আর coat-এর সামনে। গাছেও কিছু কিছু বরফ দেখতে পাবে।’
সুস্থ স্বাভাবিক এই চিঠি থেকে সুন্দর একটি সম্পর্ক ফুটে ওঠে। মা রয়েছেন কলকাতায়, ছেলে সুদূর বিদেশ থেকে বরফ পড়ার অভিজ্ঞতা, তার বন্ধুদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। তারই মধ্য পত্রলিখনেও লেখকের ফটোগ্রাফ দেখার-পড়ার চোখ নির্ণয় করা যাচ্ছে ও বিশ্বজনীন আবহাওয়ায় ঘোরা-ফেরার আমেজ পাওয়া যায়।
এ হেন একটি যুবকের হঠাৎ কী হল, তা সঠিক জানা যায়নি। দাদামশাই লক্ষ্মীনারায়ণ চৌধুরী বিলেত পাড়ি দিলেন এবং ১৯৩৯-এর কোনও এক সময় নাতিকে ঘরে ফিরিয়ে আনলেন, সম্ভবত কলকাতায়। যেটুকু শুনেছি, কোনও ধরনের নার্ভস ব্রেকডাউন হয়েছিল। আচমকা এই মানসিক অসাম্য ভাবিয়ে তুলেছিল পিতা-মাতা ও আত্মীয়াদের। পুষ্পলতা ভেঙে পড়েছিলেন, তবে স্বামী ছিলেন পাশে। ১৯৪৫-এ সুবিনয়ের মৃত্যুর পর একলা সারাজীবন তাঁকে পুত্রের এই মর্মান্তিক পরিণতির দুঃখভার বইতে হয়েছে।
নানা জায়গায় ভাড়াবাড়িতে থেকেছেন বিভিন্ন পারিবারিক পরিস্থিতির মধ্যে। আর্থিক চিন্তায় কিছু কিছু সময়ে পুষ্পলতাকে বাড়ির বাইরেও কাজের সন্ধান করতে হয়েছে। অল ইন্ডিয়া রেডিও বা আকাশবাণী থেকে রান্নার অনুষ্ঠানে বা আসরে রান্নার অনুষ্ঠান করেছেন। কিছুদিন হাসপাতালের রুগীদের ডায়েট তদারকির কাজেও নিযুক্ত থেকেছেন। চারের দশকে মহিলাদের বাড়ির বাইরে স্কুল-কলেজে পড়ানোর চাকরি বাদে কাজের সুযোগই বা কোথায় ছিল!
এই পরিস্থিতির মধ্যে ছেলেকে নিয়েই থাকতেন বড়দিদু। ক্রমশ আরও সমস্যা দেখা দিল। প্রায়ই ধনো কলকাতার রাস্তায় বেরিয়ে যেতেন একলা, খুঁজে নিয়ে আসতে হত। এমন সময় অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী বললেন যে, ছেলেকে বাড়িতে রেখে দেখাশোনা করা সম্ভবপর হবে না। মায়ের পক্ষে কী ভয়ংকর এই বিচার!
এখানে বলা সমীচীন হবে যে, বিশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে মানসিকরোগবিদ্যা বিজ্ঞান হিসাবে প্রাধান্য তেমন পায়নি, যে কারণে হয়তো চিকিৎসার জন্য মানসিক হাসপাতাল গড়ে ওঠেনি। যা ছিল সেইগুলিকে সাধারণ ভাষায় পাগলাগারদ বা আশ্রয় বলা চলে। সাধারণের মধ্যে পাগল মানেই উন্মাদ এবং তাকে লোকচক্ষুর অন্তরালে লুকিয়ে রাখা দরকার, এমন মানসিকতা কাজ করত। বাঙালি ডাক্তার গিরীন্দ্রশেখর বসু ১৯২২ সালে কলকাতায় ‘Indian Psychoanalytical Society’-র গোড়াপত্তন করলেন এবং মেন্টাল হেলথ নিয়ে গবেষণা করতে থাকেন। তখনকার দিনে রাঁচি অনেক দূরের রাস্তা, কিন্তু ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় সরলের ভর্তি ও থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন ভারতীয় মানসিক রুগিদের জন্য কাঁকেতে। রাঁচি রেলস্টেশন থেকে ১০ মাইল দূরে হাসপাতাল, যা ১৯২৫-এ স্থাপিত হয়।
বড়দিদু ১৯৬০-এর দশকে করায়া রোডে একটা ঘর নিয়ে থাকতেন। আমার দাদু ও দিদিমা ঠিক উল্টোদিকের ফ্লাটে ভাড়া থাকতেন, তাই অনেক যাওয়া-আসা ছিল। সেখানে ছুটির দিন সকালে দেখেছি, দেওর নানকু (সুবিমল) প্রায়ই আসতেন বউঠানকে দেখতে। পরনে খাটো করে মালকোঁচা দিয়ে ধুতি, গায়ে সাদা মলমলের ফতুয়া, মাথায় উসকোখুসকো সাদা-কালো চুল, ঠিক যেন আবোল তাবোল থেকে উঠে আসা একটি চরিত্র! মজার মজার গল্প শোনাতেন, হাস্যকর অঙ্গভঙ্গির সঙ্গে! খুব মজার লাগত। কুলাদারঞ্জনের মেয়ে মাধুরী (বুলু ) মাঝে মাঝে আসতেন, তাই তাঁকে অল্প মনে পড়ে।
……………………………………….
আরও পড়ুন শ্রীদর্শিনী চক্রবর্তী-র লেখা: শালবনে প্রতিধ্বনিত গানই দিনু ঠাকুরকে বিস্মৃত হতে দেবে না, বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ
……………………………………….
আমাদের বড়দিদু, পুষ্পলতা, ছেলে ধনোকে নিয়ে তাঁর ছেলেবেলার কিছু গল্প বলতেন, তবে অনেক দিন অবধি তিনি কোথায় থাকেন, জানা ছিল না। এখন বুঝি তাঁর জীবনের এই অধ্যায় কত দুঃখজনক। একবার মনে আছে বড়দিদু ৫এ, দিলখুশা স্ট্রিটের মেজেনাইনের একটা ঘর নিয়ে থাকতেন। নিচে উঠান ও বারান্দা ঘেরান বাড়ির একটা দিকে আমার দিদিমা-দাদামশাই ভাড়া থাকেন। আমরা ছুটিতে এসেছি তখন বড়দিদু খুব উৎসাহ নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার তোড়জোড় করছেন। খাবার বানাচ্ছেন, কেনাকাটা করছেন, নিজের ট্রাঙ্ক গোছাচ্ছেন। পরে শুনেছিলাম, বছরে দু’-একবার তিনি ছেলেকে দেখতে কাঁকে যান প্রায় এক মাসের জন্য। প্রত্যেকবারই গিয়ে থাকেন হাসপাতালের চত্বরে কোনও নার্স বা কর্মচারীর বাড়িতে। ইন্টারনেট, হোয়াটস্যাপ, মোবাইল ফোনের যুগের অনেক আগে, যখন ল্যান্ড ফোনের প্রযুক্তিও অনেক পিছিয়ে রয়েছে, তাই অবাক লাগে যে তখন কী করে কয়েক মাস আগের থেকে চিঠি আদান-প্রদান করে সব আয়োজন করে বড়দিদু একলা এই আবেগপূর্ণ যাত্রায় পাড়ি দিতেন বিহারের এই শহরটিতে। কত না মনের জোর, কত আনন্দের দিনের স্মৃতি তাঁকে উৎফুল্ল করত। ফিরে আবার সেই একলা পথ চলা, দুঃখ চেপে রাখা, ভালোবাসার ধনকে চিরতরে হারিয়ে ফেলা।
এখান থেকেই অনেক প্রশ্ন জাগে মনে, মানসিক ব্যাধির শুধু চিকিৎসা নয়, তার সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও। আজও মানসিক স্বাস্থ্য পৃথিবী জুড়েই অস্বস্তির বিষয়। মানসিক অসুস্থতাকে কেন্দ্র করে কী যেন একটা ভীতি, লজ্জা বা কলঙ্ক মিশে রয়েছে। এইসব মানুষদের তাই লুকিয়ে রাখা, আটকে রাখা বা হারিয়ে ফেলার একটা প্রবণতা দেখা যায়। কিন্তু উদারচেতা রায় পরিবারের এক উজ্জ্বল সদস্য হয়েও সরলের মতো মানুষটি কেন সময়ের অতল গহ্বরে মিলিয়ে গেলেন? কেনই বা সারাজীবন এভাবে মানসিক হাসপাতালে থাকতে হল? তাঁর মায়ের মনোকষ্ট তলিয়ে দেখা গেল না কেন? অনেক প্রশ্ন এবং তার হয়তো একটিই উত্তর– সমাজ।
………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………….
বড়দিদু সম্ভবত ১৯৬০-র শেষের দিকে তাঁর ছোট ভাইয়ের সংসারে থাকতেন। এক অর্থে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন। একটা ছোট কালো রঙের ট্রাঙ্ক, নিচু মোড়ার ওপর রাখা– ছোটবেলায় অনেকটা পদীপিসির বর্মী-বাক্স মনে হত। বড়দিদুর লেখার কথা কেউ মনে রাখে না। গার্হস্থ্য দায়িত্বের মাঝে যখনই সুযোগ পেয়েছেন লেখালিখি ও সেলাই নিয়ে বসতেন। লাইন টানা ‘স্কলার’ এক্সারসাইজ খাতায় ইংরেজি থ্রিলার অনুবাদ করতেন। বিশেষ করে মনে আছে, একবার আগাথা ক্রিস্টির ডিটেকটিভ নভেল অনুবাদ করছিলেন, খুব সহজবোধ্য করে ঝরঝরে লেখা পড়ে পড়ে শোনাতেনও। মাঝেমধ্যে ট্রাঙ্ক থেকে অ্যালবাম বা ছবি দেখিয়েছেন ও আনন্দের দিনের স্মৃতিচারণা করেছেন বা কোনও ঘটনা গল্পাকারে বলেছেন। কিছু সঞ্চিত পত্রাবলি, কিছু ফোটোগ্রাফ এক আধটা বিশেষ জিনিস– এই ছিল তাঁর জীবনে চলার খোরাক।
দুর্ভাগ্যের বিষয়, সরলকুমার রায়ের অস্তিত্বই লোপ পেতে চলেছে; সুবিনয় রায়চৌধুরীকে শিশু সাহিত্যিক হিসাবে ও ‘সন্দেশ’-এর সম্পাদক বলে পর্দার আড়ালে রাখা মুশকিল; পুষ্পলতাকে নেপথ্যে রেখে এড়িয়ে যাওয়া সহজ ও স্বাভাবিক। পারিবারিক ইতিহাসে এঁরা রয়ে গেলেন ফুট-নোটে আকারে, মূল তথ্য সংযোগে অবদান যৎসামান্য। ইতিহাস লিখতে গিয়ে স্তব্ধতাগুলি কোথায় এবং কেন, এই প্রশ্ন উঠে আসে বারেবারে।
ছবি: লেখিকার ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে
তথ্যপঞ্জী:
Bandyopadhyay, Gautam Kumar et al. “ History of Psychiatry in Bengal”, Indian Journal of Psychiatry 2018; 60:192-7. http://www.indianpsychiatry.org Accessed on 4.1.2024.
চক্রবর্তী পুণ্যলতা, ছেলেবেলার দিনগুলি , নিউস্ক্রিপ্ট , কলকাতা, ১৯৫৮।
মজুমদার লীলা, পাকদন্ডী , আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা , ১৯৮৬।
Mukherjee, Tumpa. Suprabha Ray: The Unvanquished, Avenel Press, Kolkata 2020.
রায় সুবিনয় , গল্প সংগ্রহ , সম্পাদনা অভিষেক চ্যাটার্জী , বিন্দু বিসর্গ পাবলিশার্স, কলকাতা, ২০২০।
রায়চৌধুরী সুবিনয় , রচনা সংগ্রহ সম্পাদনা পার্থজীৎ গঙ্গোপাধ্যায় , দে ‘জ পাবলিশিং , কলকাতা, ২০১৩ পুনর্মুদ্রণ ২০১৬।
রায় সত্যজিৎ , যখন আমি ছোট ছিলাম, আনন্দ পাবলিশার্স , কলকাতা ( ১৯৮২)
Sengoopta, Chandak. The Rays Before Satyajit : Creativity and Modernity in Colonial India , OUP, 2016.
en.wikipedia.org U. Ray and Sons , entry on liquidation accessed on 7.1.2024.
https://www.ub.uni-heidelberg.de/Englisch/fachinfo/suedasien/zeitschriften/bengali/sandesa.html