আকাশ আমাদের মাথার ওপরে আচ্ছাদনের মতো। ছাদের নিচে যখন অভিনয় করছি, অর্থাৎ, বদ্ধ জায়গায়, তখন আকাশের অনুরূপ একটা আকাশ আমরা গড়ে নিচ্ছি। আর আকাশি রং তৈরি করে নিচ্ছি মনের মধ্যে। আলো, জাদু, মায়া দিয়ে তৈরি করছি সেই আকাশি রং। উপরের দিকে তাকিয়ে বলছি, ওই যে আকাশ, ওই যে আকাশি রং, ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে ইচ্ছে করছে। ওই রংটাই হয়তো আমাকে ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ জীবন থেকে মুক্তির পথ বাতলে দেবে। মঞ্চে যখন আকাশপানে চেয়ে কথা বলি তখন মঞ্চের পিছনে সজ্জিত যে কালো কাপড়, তার ওপরে একটা ছাদ, তার ওপরে যে মুক্ত আকাশ– তা দেখতে পাই, ওই আকাশি রং-কে অনুভব করতে পারি।
নাট্য-মঞ্চ অর্থাৎ প্রসেনিয়াম থিয়েটার, যার চারপাশটা ঢাকা, সেখানে বাইরের পৃথিবীটা, এই বায়ুমণ্ডলের ওপর সুবিস্তৃত ওই আকাশ, তা দেখা যায় না। দর্শককে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে হয় মঞ্চের দিকে। মঞ্চসজ্জায় সেখানেই তৈরি হয় আমাদের ভুবন, ওই আকাশি রঙা আকাশটা। শিল্পীর স্পর্শে সেখানে সৃজন ঘটে শুধু আকাশ নয়, পাহাড়-পর্বত, মরুভূমি– আমাদের পরিপার্শ্বের।
আমরা যে মঞ্চে অভিনয় করি, তা একটা পৃথক স্থান। একটু উঁচু বেদি। সেখানে নানা চরিত্রের সমাবেশ, আলো-আঁধারির খেলা চলে নিরন্তর, আমরা নিজেদের ভাঙা-গড়ার খেলায় মাতি। সেই থিয়েটারে আমরা, নাটকের কলাকুশলীরা যে আকাশকে দেখি, তা কিন্তু মাথার ওপরে থাকে না। তাকে আমরা আবিষ্কার করি মঞ্চের পিছনে, যাকে আমরা ‘সাইক্লোনমা’ বলে থাকি। সচরাচর সেখানে একটা নীল আলো পড়ে, সেই নীলের বিচ্ছুরণ এক এক জায়গায় এক একরকম। আমরা দেখতে পাই আকাশের ওই নিজস্ব রং– আকাশিকে।
সেই রং ফিকে হতে হতে নানা বর্ণ ধারণ করে, যেন শিল্পীর ক্যানভাস। যত এগিয়ে চলে তা গোধূলিবেলার দিকে, তত সে হয়ে ওঠে আরক্তিম। তবে আকাশ যতই তার রং বদলাক, তাকে আমরা চিনি একটা রঙে, সেই বর্ণ– আকাশি। থিয়েটারের সঙ্গে আকাশি রঙের একটা মধুর সংযোগ আছে, একটা হৃদয়ের যোগ রয়েছে, তাকে অস্বীকার করা যায় না। থিয়েটারকে বলা হয় তিলোত্তমা শিল্প, সংযুত শিল্প। সব শিল্পের সমাহার সেখানে ঘটেছে। আমরা জানি, সব রং মিশে সাদা হয়। মাথায় ওপর ওই যে আকাশ, যার রং আকাশি, সেসব কিছুকে ধারণ করে। ধারণ করে একটু দূর থেকে, একটু উঁচু থেকে, একটু আড়াল থেকে, একটু দূরত্ব রেখে। সবটাকেই সে দেখে, আত্মস্থ করে, নির্লিপ্ত থেকে রসাস্বাদন করে। থিয়েটারও সেই রকম একটি জায়গা। সেখানে আকাশের ওই রংটাও একই রকমভাবে পরিব্যপ্ত।
দর্শক যখন মঞ্চে নাটক দেখতে আসে, কিংবা মঞ্চের বাইরে দাঁড়িয়ে পথনাটক অর্থাৎ নন-প্রসেনিয়াম থিয়েটার দেখে, সেখানেও যে রং-কে আমরা প্রতিষ্ঠিত করতে চাই, তাকে যাচাই করে দূর থেকে, একটু দূরত্ব বজায় রেখে। অর্থাৎ, দেখার সঙ্গে সঙ্গেই দর্শক নাটকের চরিত্র হয়ে ওঠে না, বরং নিজেদের মতো করে সেই সত্যকে বিচার করে, যাচাই করে। সেই ভাবনার স্রোতের মধ্য দিয়ে তারা ছুঁতে চায় দিগন্ত আকাশের ওই চেনা রং-কে। অনেক সময় আমরা নিজেদের সামনে আগল তুলে রাখি, একটা আড়াল রাখার চেষ্টা করি। প্রেমেন্দ্র মিত্রের একটি কবিতার লাইন মনে পড়ছে এই প্রসঙ্গে– ‘দরজা জানলা যতই আঁটো, আকাশ তোমায় ডাকবেই।’ এই যে আকাশ ডাকবেই– তার মানে আকাশি রংটা হাতছানি দিয়ে ডাক দেবে। তাকে অস্বীকার করার উপায় নেই।
নাট্যমঞ্চে বহু রং ব্যবহার হয়, কিন্তু আকাশি রংটার মধ্যে যে ব্যাপ্তি আছে, যে উদাসীনতা আছে, যে আহ্বান আছে, তা থিয়েটারের সঙ্গে সাযুজ্যশীল। আকাশি রং, সে তো মৌলিক নয়। শুনেছি, আলোর বিকিরণ হেতু আকাশের রং নাকি আকাশি, পৃথিবীর তিন ভাগ জল, সেই সমুদ্রের নীল রংও কি প্রতিফলিত হয় না আকাশের গায়ে? নাকি আকাশের রং থেকে সুমদ্র তার নীল রং আহরণ করে? বিজ্ঞানীরাই এর চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে পারবেন। যদিও আকাশি রং এই পরিবেশের সর্বত্র, এই আবহমণ্ডলে তার পরশ ছড়িয়ে আছে। আকাশি ওই রংটার মতো থিয়েটারও সবার থেকে একটু দূরত্ব রেখে একটা সত্যের আকাশ আমাদের সামনে খুলে দেয়। যা আকাশির মতো স্বচ্ছ, পবিত্র। আমাদের মনকে তা রাঙিয়ে তোলে।
মঞ্চের বাইরে যখন অভিনয় করেছি, তখন দেখেছি, আকাশের ওই নীলচে আকাশি রংটায় হয়তো চড়া রোদে একটু সাদা প্রলেপ পড়েছে, কিন্তু তবু সেই আকাশি আভাস মিলিয়ে যায়নি। দর্শক সেই আলোয় অভিনেতা-অভিনেত্রী, কলাকুশলীদের দেখছে, আমরা দর্শকদের দেখছি। সকলের গায়ে রংয়ের আলো পড়ে এমন একটা মায়াবী পরিবেশ তৈরি করছে, যে মায়াটা এই রংটা না হলে তৈরি হত না। এই আকাশি রং-এর মধ্যে যেমন ধূসরতা আছে, তেমনই আছে ঔজ্জ্বল্য, একটা দূরত্ব যেমন আছে, তেমনই একটা নৈকট্য। এই আপাতবিরোধ, অথচ কী চমৎকার তার সহাবস্থান। খোলা আকাশের নিচে অভিনয়ের সময় অনুভব করেছি, যতই মেঘ আড়াল করুক না কেন, তার ওপরে যে আকাশি রঙের এক সত্য আছে, তা অমোঘ, চিরন্তন। তাকে অস্বীকার করা যায় না।
এই আকাশ আমাদের মাথার ওপরে আচ্ছাদনের মতো। ছাদের নিচে যখন অভিনয় করছি, অর্থাৎ, বদ্ধ জায়গায়, তখন আকাশের অনুরূপ একটা আকাশ আমরা গড়ে নিচ্ছি। আর আকাশি রং তৈরি করে নিচ্ছি মনের মধ্যে। আলো, জাদু, মায়া দিয়ে তৈরি করছি সেই আকাশি রং। উপরের দিকে তাকিয়ে বলছি, ওই যে আকাশ, ওই যে আকাশি রং, ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে ইচ্ছে করছে। ওই রংটাই হয়তো আমাকে ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ জীবন থেকে মুক্তির পথ বাতলে দেবে। মঞ্চে যখন আকাশপানে চেয়ে কথা বলি তখন মঞ্চের পিছনে সজ্জিত যে কালো কাপড়, তার ওপরে একটা ছাদ, তার ওপরে যে মুক্ত আকাশ– তা দেখতে পাই, ওই আকাশি রং-কে অনুভব করতে পারি। দর্শকও দেখতে পান একইসঙ্গে। কবির মতো তাই আমাদের মনও বলে, দরজা জানলা যতই আঁটো, কাপড়ের আড়ালে ওই যে আকাশজুড়ে থাকা আকাশি রং, তা থিয়েটারের মতো, মঞ্চের মতো, পথনাটিকার মতো হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
আকাশি রং না থাকলে সমুদ্র কার সঙ্গে কথা বলে রঙিন হবে? গাছপালা কার সঙ্গে কথা বলে পবিত্র হবে? রাখালের বাঁশির সুরে কীভাবে মিশবে জীবন? আসলে আকাশি রং মঞ্চ ও মঞ্চের বাইরে সেই মোহময় চন্দ্রাতপ, চৌধুরীদের শামিয়ানা, যা নানা বর্ণের সমন্বয়ে আসর জমিয়ে তোলে, যার নিচে আমরা নিজেদের খুঁজে পাই, যার সঙ্গে জুড়ে আছে আকাশ। অর্ধেক নয়, পূর্ণ চেতনায়।
আকাশি রঙা সেই আকাশ আমাদের অবকাশ দেয় না কোনও নিরাপত্তাহীনতার। অবকাশ দেয় না দুঃখের। অবকাশ দেয় না একাকিত্বের। আর কেউ না থাকলেও হেমিংওয়ের সেই ‘ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য সি’-র মতো আকাশ এবং একটি মানুষ পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়ায়, আহরণ করে আকাশ থেকে বর্ষিত আকাশি রং-কে।
… পড়ুন বে নী আ স হ ক লা-র অন্যান্য লেখা …
লাল নিয়ে লিখছেন হিরণ মিত্র: সাদা-কালো ক্যানভাসে একদিন লালের ফোঁটা পড়ল, আমার ছবি বদলে গেল তারপর
কমলা নিয়ে লিখছেন সুশোভন অধিকারী: সময় যখন সন্ধ্যা, তখন এক লহমায় চিনে নিতে পারি অনুচ্চারিত রংটি কী?
সবুজ নিয়ে লিখছেন মাধবেন্দু হেঁস: সবুজ মানে গাছপালা, বনজঙ্গল শুধু নয়, বরং তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা জীবন, জীবিকা, স্মৃতি, প্রেম
বেগুনি নিয়ে লিখছেন হিয়া মুখোপাধ্যায়: বেগুনি রংটা বাস্তবে কোনও অস্তিত্ব নেই, গোটাটাই একটা কাল্পনিক নির্মাণ