অসহায় সহিষ্ণুতা পাঠের উল্টোপিঠেই আমাদের অনর্গল অপভাষা
Published by: Robbar Digital
Posted on: August 29, 2024 7:45 pm
Updated: August 29, 2024 9:08 pm
শুধুই কি কুলিবস্তি, ফুটপাথ, কলকারখানার শ্রমিকপট্টি, গ্যারাজ-গুমটি? তা তো নয়! নিচু থেকে উঁচুতলার শিক্ষার্থীমহলে তাহলে কী ক’রে এত বিস্তার আর জনপ্রিয়তা পায় এই অপ্রথাগত শব্দসমূহ? অতএব বুঝতে হবে, অপরিতৃপ্তি, বিক্ষোভ আর প্রদাহটা কেবল জঠরের জ্বালা থেকে নয়, আরও গভীর কোনও সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষত থেকেও উঠে আসছে। উঠে আসছে ক্ষমতার সঙ্গে দুর্বৃত্তের অবৈধ মিলনে জাত এক সর্ববিস্তারী পচাগলা ব্যবস্থার গর্ভ থেকে। উঠে আসছে রাজনৈতিক চেতনার সমূহ অবক্ষয়ের আত্মঘাতী অসুস্থতা থেকে।
সত্রাজিৎ গোস্বামী
কথা কখন অকথা-কুকথার দিকে মোড় নেয়, ভাষা কখন অকথনীয় অকথ্যভাষার দিকে পা ছোটায়, বলা খুব মুশকিল! ভাষার আত্মাশক্তিকে রূপান্তরিত করে এই যে বিস্ফোরণ, তা কেন ঘটে? কে ঘটায় সেই বিস্ফোরণ? নবারুণ ভট্টাচার্য ‘হারবার্ট’ উপন্যাসে লিখেছিলেন, ‘কখন, কীভাবে বিস্ফোরণ ঘটবে এবং তা কে ঘটাবে সে সম্বন্ধে জানতে রাষ্ট্রযন্ত্রের এখনও বাকি আছে।’ কথাটা ভাষাবিস্ফোরণের বিষয়েও একইভাবে সত্যি।
ভাষার একটা আদিকল্প আমরা প্রত্যেক ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ হাতে-গরম পেয়ে গিয়েছি। ভাষার আদিরূপ-সৃষ্টির সেই ইতিহাসে আমাদের আপাতত প্রয়োজন নেই। ভাষার সেই আদি রূপটা প্রকৃতি ও প্রাণীর ধ্বনিবৈশিষ্ট্যের ওপর কতখানি নির্ভর করেছিল, অথবা নিতান্ত খামখেয়ালিভাবেই সেগুলো বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে তৈরি হয়ে উঠেছিল কি না, সেই বিতর্কেও আমরা যাচ্ছি না। তবে আদিকল্প হিসেবে পাওয়া আমাদের শব্দভাণ্ডারের সামান্য পুঁজি হাতে নিয়ে সেই শব্দের অণু-পরমাণুর অন্তর্গত উপাদানের সংযোজন-বিয়োজনে ভাষার যে ধারাবাহিক শক্তিবিস্তার– তাকে কখনই খেয়ালখুশি বলা চলে না। বরং বলা যায়, আজকের ভাষাভাণ্ডারের যে স্ফীতি ও প্রাচুর্য, তার নেপথ্যে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক, স্নায়বিক, জৈবরাসায়নিক ইত্যাদি বহু বিজ্ঞানসম্মত কার্যকারণ আছে। একটা ‘শব্দ’র মধ্যে নিহিত থাকতে পারে নির্দিষ্ট বিষয় বা ভাবকে চিহ্নিত করার আশ্চর্য শক্তি। সেই ‘শব্দ’ যখন বাক্যের মধ্যে ‘পদ’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তখন সেই ‘পদ’ নির্দিষ্ট অর্থের বেড়া চুরমার করে দিয়ে সম্পূর্ণ অন্যমুখী বা ভিন্নমুখীও হয়ে উঠতে পারে। আর এই পথেই তীব্রতা পায় ভাষার গতি ও বিচিত্র বর্ণচ্ছটা।
প্রাচীন অলঙ্কারশাস্ত্রে তার অনেকগুলো সূত্রকে চিহ্নিত করার চেষ্টা বহু দেখা গিয়েছে। কিন্তু ‘গাধা’ শব্দটা যখন কোনও বিশেষ বাক্যে পদ হিসেবে ‘নির্বোধ’ অর্থে ব্যবহৃত হয়, তখন সেই অর্থান্তরের বিষয় ও কার্যকারণটাও ভাষাবিজ্ঞানের আওতায় আসা খুব খু-ব দরকার। এ তো নিতান্ত তৃণভোজীসুলভ একটা উদাহরণ। চূড়ান্ত নন-ভেজ উদাহরণ না দিয়েও মাঝামাঝি গোছের আর একটা উদাহরণ টানা যেতে পারে। যেমন, বাংলার ‘গাণ্ডু’ শব্দটা। কেবল যুবসমাজের মুখেই তো নয়, বয়স ও শ্রেণি নির্বিশেষে শব্দটা ব্যবহৃত হয় অকথনীয় (অকথ্য) ও অশ্লীল শব্দ হিসেবেই। অথচ পুরোনো বাংলায় কখনও শব্দটার মধ্যে অশ্লীলতার নামগন্ধও ছিল না। ‘চৈতন্য চরিতামৃত’-তেও ‘গাণ্ডু’ তুলোভরা বালিশ বা তাকিয়া অর্থেই ব্যবহৃত। কবে কেন কীভাবে শব্দটার অর্থ-অপকর্ষ ঘটে গেল, ভাষা-কৌতূহলীর কাছে সেটা একটা জিজ্ঞাসা!
অতি সম্প্রতি কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্য বিভাগ আয়োজিত একটি কর্মশালায় বাংলা ভাষার এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁদের একটা ধারাবাহিক আগ্রহ, সন্ধানের ইচ্ছা করেছেন। আমাদের ভাষাব্যবহারের শিষ্ট ও সাহিত্যিক-আভিধানিক বাঁধা-পথের বাইরে গিয়ে আপাত-অকথ্য, অশ্লীল, সংকেতপ্রবণ, অনেকাংশে গোপনচারী অথচ লোকমুখে বহু উচ্চারিত এই শব্দসমূহকে গ্রন্থবদ্ধ ও বিশ্লেষণের এই সংকল্প-ঘোষণাকে একজন ভাষা-কৌতূহলী হিসেবে স্বাগত জানাচ্ছি।
কিন্তু এই ধরনের শব্দের বিশেষ অর্থবহনের বিশেষ শক্তিকে বুঝে নেওয়ার গুরুত্ব এই প্রথম যে সূচিত হল, তা নয়। উনিশ শতকের শুরুতে উইলিয়াম কেরি যখন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সিবিলিয়ান ছাত্রদের জন্য তাঁর ‘কথোপকথন’ প্রকাশ করেছিলেন, সম্ভবত তখনই তার সূচনা হয়ে গিয়েছিল। এ ব্যাপারে বিদ্যাসাগরের আগ্রহের কথাও সর্বজনবিদিত। আলাল থেকে হুতোম, কুমারেশ ঘোষ থেকে ভক্তিপ্রসাদ মল্লিক, পবিত্র সরকার থেকে এই অধম নিবন্ধকার হয়ে অভ্র বসু পর্যন্ত এ ব্যাপারে কিছু ভূমিকা পালন করেছেন। তবে, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এরকম প্রচেষ্টা এর আগে দেখা যায়নি বলেই এই উদ্যোগের অপরিসীম গুরুত্ব স্বীকার্য।
এইসব অতিলঘু, বিচিত্র কৌতুকপ্রবণ, সাংকেতবাহী, আমিষগন্ধী, অশ্লীল, যৌনবিকারের লক্ষণযুক্ত শব্দভাণ্ডারের দিকে লক্ষ করলে সেগুলোর উৎপত্তির নেপথ্যে যে আপাত কারণগুলো সামনে এসে দাঁড়ায়, তার মধ্যে প্রধানতম এক অপরিতৃপ্ত, বুভুক্ষু, বিক্ষুব্ধ, বিদ্রোহী সমাজমন। সেই সমাজমনই শব্দধ্বনিতে বিকৃতি বা শব্দার্থের বিপর্যয় ঘটিয়ে ভাষাশরীরে এক ধরনের অন্তর্ঘাত সৃষ্টি ক’রে তার সেই ক্ষোভ উগরে দেয়। অর্থাৎ এই বিশেষ সমাজভাষা এক বিক্ষুব্ধ সমাজমনস্তাত্ত্বিক বিস্ফোরণ। (দ্রষ্টব্য ‘বাংলা অকথ্যভাষা ও শব্দকোষ’; সত্রাজিৎ গোস্বামী।)
প্রসঙ্গত মনে পড়ে গেল, কথাকার শ্রীচিত্ত ঘোষালের ‘আপেক্ষিকতা’ গল্পের একটা সংলাপ– ‘লোকে যত কম খেতে পায়, যত তার অভাব বাড়ে, তত সে বেশি খিস্তি করে…’ (‘ফাঁসুড়ে ও অন্যান্য গল্প’; সুচেতনা, ২০০৬)। কিন্তু দারিদ্র আর ক্ষুধাই তো নয়, ক্ষুধার ভেতর কোনও জৈবরাসায়নিক ও মনস্তাত্ত্বিক কারণে যেন যৌনক্ষুধার এক উদগ্র বিকৃত তাড়না জন্ম নেয়, এটাও সমাজ-সমীক্ষকদের দৃষ্টি এড়ায়নি।
কিন্তু শুধুই কি দারিদ্র? শুধুই কি কুলিবস্তি, ফুটপাথ, কলকারখানার শ্রমিকপট্টি, গ্যারাজ-গুমটি? তা তো নয়! নিচু থেকে উঁচুতলার শিক্ষার্থীমহলে তাহলে কী ক’রে এত বিস্তার আর জনপ্রিয়তা পায় এই অপ্রথাগত শব্দসমূহ? অতএব বুঝতে হবে, অপরিতৃপ্তি, বিক্ষোভ আর প্রদাহটা কেবল জঠরের জ্বালা থেকে নয়, আরও গভীর কোনও সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষত থেকেও উঠে আসছে। উঠে আসছে ক্ষমতার সঙ্গে দুর্বৃত্তের অবৈধ মিলনে জাত এক সর্ববিস্তারী পচাগলা ব্যবস্থার গর্ভ থেকে। উঠে আসছে রাজনৈতিক চেতনার সমূহ অবক্ষয়ের আত্মঘাতী অসুস্থতা থেকে।
ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শক্তি মুক্তিকামী জনশক্তিকে দুর্বল করতে ঠিক যে পন্থা অবলম্বন করেছিল ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক বুদ্ধিকে প্ররোচিত ক’রে। আজকের স্বাধীন ভারতের কেন্দ্র ও রাজ্যের রাষ্ট্রযন্ত্রও একইভাবে দলমত নির্বিশেষে মানুষের প্রতিবাদী স্বরকে বিভাজিত করতে চাইছে দলীয় সাম্প্রদায়িকতার অস্ত্রে। অতিসাম্প্রতিক মর্মান্তিক একটি হত্যা এবং দীর্ঘবাহিত অপরাধ ও অপরাধীদের আড়াল করতে প্রশাসনিক অতিতৎপরতার ফলে সাধারণ জনতার স্বতস্ফূর্ত প্রতিবাদ ধর্ম-শ্রেণি-লিঙ্গ-দলপরিচয় সরিয়ে রেখে যেভাবে উচ্চকণ্ঠ হয়েছে, তাকে প্রতিহত করতে আবার সক্রিয় দলীয় সাম্প্রদায়িকতা– একথা প্রমাণ করছে ঘটনাপরম্পরাই। তবু মানুষকে রাষ্ট্রব্যবস্থার সুরক্ষাবর্ম সংবিধান, ন্যায়সংহিতা, ক্ষমতাসীন নিয়ন্ত্রিত সশস্ত্র আরক্ষাবাহিনী, রাষ্ট্রীয় নির্দেশিকার মধ্যে যে অসহায় সহিষ্ণুতার পাঠ নিতে বাধ্য হতে হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। সেই সমাজমনে পুঞ্জিত ক্ষোভের বিস্ফোরণ হতেই থাকবে, এই বিশেষ সমাজভাষার ভাণ্ডার ক্রমাগত বাড়তেই থাকবে, সন্দেহ নেই।
তবে ব্যক্তিগত স্তরে গবেষণার সীমাবদ্ধতা প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা অতিক্রম করতে পারবে বলেই বিশ্বাস করতে চাই। সেজন্য বাংলা বিভাগের সঙ্গে মনোবিজ্ঞানী, স্নায়ুবিজ্ঞানী, জৈবরসায়ণ বিশেষজ্ঞ, সমাজবিজ্ঞানীদের যুক্ত করতে পারলে গবেষণা অনেক বেশি ফলপ্রসূ হয়ে উঠতে পারবে।
শুধু বিদেশে থাকার জন্য উচ্চশিক্ষা লাভ করেও ছোটখাটো কাজ করে কাটিয়ে দিয়েছেন বহু ভারতীয়
তত্ত্ববিদ, মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার কাজ নিয়েছে মস্কো রেডিয়োতে, কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে ‘মির’ বা ’প্রগতি’তে অনুবাদক হয়েছে, কেউ বা সাংবাদিকতায় পি.এইচ. ডি. ডিগ্রি অর্জন করে সংবাদপত্রের দফতর খুলে তার অন্তরালে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করে দিয়েছে।
মণীন্দ্র গুপ্তকে যাঁরা পড়বেন, যাঁরা মণীন্দ্র গুপ্তর আশ্রয় নেবেন, বা মণীন্দ্র গুপ্তর নাম প্রথম শুনছেন যাঁরা, এই বই হতে পারে পুজোর আগে সেই প্রস্তুতিটি।