গঙ্গার ঘটি-ইলিশ বনাম পদ্মার বাঙাল-ইলিশ! এই ইলিশ যুদ্ধে ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়লেন সমাজের সোনার মাথাওয়ালা মানুষজন। এই দেখুন না, কমলকুমার মজুমদার মাথা ঝাঁকিয়ে বলে দিলেন, ‘গঙ্গার ইলিশ দুশো বছর ধরে (ইস্ট ইন্ডিয়া) কোম্পানির তেল খেয়েছে। এই ইলিশের সঙ্গে অন্য ইলিশের (পদ্মার) পাল্লা দেবে কী করে?’ বাঙালরা একটু বাঁকা চোখে তাকিয়ে বললেন, তেল দেওয়া ঘটিদের একটা পুরনো অভ্যাস সেই কোম্পানি আমল থেকেই হয়ে এসেছে। নিজেদের প্রশংসার গন্ধ মুখে মুখে ছড়িয়ে দেওয়াটা মজ্জাতে মিশে গেছে– তাই ইলিশের গন্ধ নিয়েও ঘটিরা অহংকারী। ইলিশ নিয়ে বাঙালরা ঘটিদের উদ্দেশে একটিমাত্র বাক্য ব্যবহার করেন– ‘তোমরা তেল দেও, আমরা তেল খাই!’
প্রচ্ছদের ছবি অপ্রতিম পাল
চিংড়ি মাছের কথা উঠলেই, অবশ্যই একবার ইলিশ মাছের কথা উঠবেই উঠবে। শুরু হবে বাঁধভাঙা আলোচনা, শুরু হবে অঘোষিত যুদ্ধ। ঘটি-বাঙাল লড়াই। আমি ভাবতাম, পূর্ববঙ্গের মানুষের কথার টানের জন্য তাদের ‘বাঙাল’ বলা হত। এটা আমার মতো সকলের কাছেই পরিষ্কার। কিন্তু কলকাতা অঞ্চলের মানুষরা কেন ‘ঘটি’? এর মধ্যেও কি কোনও ব্যঙ্গ লুকিয়ে আছে? কী এর ইতিহাস?
বাঙাল-ঘটি একসঙ্গে থাকা এবং এই উপহাসের শুরু কবে থেকে? উনিশ শতকে শিক্ষা-চাকরি, পুঁজি ছাড়া ব্যবসার নিত্যনতুন দরজা খুলতে শুরু করলে পূর্ববঙ্গ থেকে মানুষ কলকাতায় আসা শুরু করে। বিনা পুঁজির ব্যবসায় বাঙালের আগমন প্রসঙ্গে রসরাজ অমৃতলাল বসু তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন:
“দুঃখের জ্বালায় দেশের বাস্তু কুঁড়ে থেকে ছিটকে বেরিয়ে ভাগ্যলক্ষ্মীর অনুসন্ধানে কেউ কলকাতায় এলে নিঃসম্বলে জীবিকা অর্জনের প্রথম সুন্দর সোপান ছিল এই কুয়ার ঘটি তেলার কাজ। কোমরে একখানি আটহাতি ধুতি, কাঁধে একখানি আড়াই হাত গামছা, এই হল ক্যাপিটাল। ভোর না হতেই পাড়ায় পাড়ায় রাস্তায় রাস্তায় গলিতে গলিতে বেলা ১০-১১টা পর্যন্ত ‘কুয়োর ঘটি তোলা’ ডেকে বেড়াত।”
রসরাজ ছোটবেলায় শোনা ডাক ভুলতে পারেননি কোনওদিন। এই ডাক যেন তিনি কান পাতলেই শুনতে পান– ‘কু-উ-উ-উ-ও ওর-ঘ-টি-তো-ও-ও-লা-আ-আ-আ-আ’। ভোর হয়েছে বুঝতে পারতেন এই ঘটি তোলাদের আওয়াজে। তিনি তখন দাদাকে বলতেন, ‘ও দাদা, ঘটি তোলা বেরিয়েছে, তবে এখনও ফরসা হল না কেন?’
রসরাজ বলছেন, ‘এই কুয়োর ঘটি তোলাটি তখন কলিকাতার প্রত্যেক গৃহস্থের একজন পরিচিত ও প্রার্থিত অতিথি ছিল।… তখন সকল বাড়িতেই এক, দুই বা ততোধিক কূপ (কুয়ো) ছিল। কূপ (কূয়োর) জলেই গৃহস্থালীর সকল কার্য্য-ই নির্ব্বাহিত হইতো।’
এবার কীভাবে কুয়ো থেকে ঘটি তুলত শুনুন:
‘দড়ি ছিঁড়ে জল তোলা ঘটি, মেয়েদের আঁচলে বাঁধা রিং-এ বাঁধা চাবিগোছা, ছেলেদের পিতলের খেলনা, এইরকম একটা না একটা জিনিস, আজ, আমার বাড়ী, কাল তোমার বাড়ী, পরশু, ওঁর বাড়ীর প্রায়ই না প্রায় পাতকুয়ার ভিতর পড়ে যেত, আর বাড়ীর লোকরা কুয়োর ঘটি তোলার ডাক শুনবার জন্য কান খাড়া ক’রে থাকতেন। ঘটি তোলা বাড়ি ঢুকেই পরণের কাপড়খানি রেখে কাঁধের গামছাখানি কোমরে জড়িয়ে বাঁ-হাতের চেটোখানি কোষ করে বাড়িয়ে দিয়ে দাঁড়াত, মেয়েরা হাতে একপলা তেল ঢেলে দিতেন, ঘটিতোলা ডানহাতের আঙুলে করে দুই নাকে আর কানের ভিতর দিয়ে বাঁ হাতের চেটোটা ব্রহ্মতেলোয় বুলিয়ে নিয়ে পাড় বেয়ে বেয়ে পাতকুয়োর নিচে গিয়ে মারত এক ডুব, আর আমরা ছেলেরা কুয়ার পাড়ের চারিধারে নিঃসাড়ে দাঁড়িয়ে থাকতুম, মিনিট খানেক না যেতে যেতে সেই ঘটিতোলা ঘটি বা চাবির গোছা হাতে করে ভুস করে ভেসে উঠত, আমরা হাঁফ ছেড়ে আহ্লাদে আটখানা! মজুরি ছিল ঘটি পিছু এক পয়সা, চাবির গোছা দু’পয়সা। বর্ষায় জল কানায় কানায় হলে বা পাতকুয়ার ভিতর বেশি পাক জমে থাকলে তিন পয়সা, চার পয়সা বা আরও কিছু বেশি দিতে হত; বিশেষ দরকারি চাবি, শোনার আংটি, চরণ চুট্কি– এইরকম সব দামি জিনিস উদ্ধার করতে পারলে বারো আনা থেকে এক টাকা পর্যন্ত বক্সিসের বন্দোবস্ত হোত।’
এবার দেখব ঘটিদের চোখে বাঙালরা উনিশ শতকে কেমন ছিল।
স্বামীজির মেজোভাই মহেন্দ্রনাথ দত্ত জানিয়েছেন– “আমরা ছেলেবেলায় দেখেছি ‘বাঙাল’ বলে বড় একটা ঘৃণার কথা ছিল। বাঙাল দেখলে আমরা ঠাট্টা করতাম ও উৎপাত করতাম। অধিকাংশ লোকের কাজ ছিল কুয়ো থেকে ঘটি তোলা। গরমকালে দুপুরে আম বেচতো এবং রাত্রে কুলপি বরফ বা ঘুগনিদানা বেচতো। তারা বড় আড়কো (তর্কের) লোক ছিল এবং আমরা অনেকে গাল দিয়ে ছড়া করে পিছনে পিছনে যেতাম।” তখন শুধু বাঙাল নয়, ওড়িয়াদের নিয়েও ব্যঙ্গ করা হত।
একবার দেখে নেওয়া যাক, কবে থেকে ওড়িশাবাসীর কলকাতায় আগমন ঘটেছে।
১৭৬৫ সালে শোভাবাজারের মহারাজা নবকৃষ্ণ দেব বাহাদুরের উদ্যোগে ওড়িশা থেকে পালকি বেহারা, জলতোলা, ছাতা ধরা ইত্যাদি কাজের জন্য লোক নিয়ে আসা হয়। ধীরে ধীরে বিভিন্ন কাজে ওড়িশাবাসী লেগে গেলেন। এঁদের প্রসঙ্গে রসরাজ অমৃতলাল জানিয়েছেন– ‘তখন উড়িষ্যাবাসীদের কলকেতায় প্রধান কাজ ছিল গুটি চার-পাঁচ;– (পালকি বেহারা), বাঁকে করে জল তোলা, কাঠ চেলানো, স্নানের ঘাটে ছেলেমেয়েদের (কপালে চন্দনের) ছাপা পরান, সাহেবদের খিদমদগারী।’
বাঙাল-ওড়িয়া দুই দেশের মানুষই কলকাতায় এসে অতি সাধারণ মানের কাজগুলি করত। হাটখোলায় তখন মহাজনদের বড় বড় আড়ত ছিল। ‘উক্ত মহাজনদের মধ্যে অধিকাংশই পূর্ব্বদেশী বাঙাল’ ছিল। দু’দেশের ভাষাও একেবারে অন্যরকম ছিল, তাই ঘটিরা বলত–
‘বাঙাল মনুষ্য নয়
উড়ে এক জন্তু।
লম্ফ দিয়ে গাছে ওঠে
ল্যাজ নাই কিন্তু।।’
কঠোর পরিশ্রমে নিঃস্ব বাঙালরা ধীরে ধীরে মাথা তুলে দাঁড়াল। যে মানুষগুলি ঘটি তোলার কাজ করত, নিজের চোখেই রসরাজ দেখেছেন তাদের উন্নতি। তিনি এদের প্রশংসা করলেন। একসময় কুলজ্ঞ ব্রাহ্মণদের কাজ ছিল সবার বংশপঞ্জিকা তৈরি করে রাখা। সেই পঞ্জিকার পাতা উলটালেই বোঝা যেত কে শূন্য থেকে বাবু হয়েছেন, আর কারা বাবু থেকে শূন্য হয়েছেন। তারা আজ আর নেই, তাই ‘ঘটিতোলা গুরুচরণের বংশধরদের মধ্যে অনেক রায়চৌধুরী, রায়বাহাদুরের ঘটিতোলা পূর্বপুরুষ বার হয়ে পড়ত’। আর ‘তখন উড়িষ্যাবাসীদের কলকেতায় কাজ ছিল গুটি চার-পাঁচ… আর আজ কলকাতা শহর জুড়ে বসে গেছে উড়ে। এরাই এখন ঘরে ঘরে অন্নপূর্ণা, কলকাতার কারখানায় বিশ্বকর্মা।’
কলকাতার মানুষের পরিচয় ‘ঘটি’ নামে! প্রশ্ন হল, কেন এমন পরিচয়? উত্তর তো এই ঘটিতোলা মানুষগুলোর সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে! জলের দেশের মানুষ বাঙালরা, নিজেদের দেশে খালে-বিলে মাছ ধরে বেড়ায়। বাঙালদের জীবনের সঙ্গে জল এমনভাবে মিশে আছে যে, বাচ্চাদের ঘুম পাড়াতেও ছড়ায় বলত–
‘খোকা যাবে মাছ ধরতে ক্ষীর নদীর বিল।
মাছ নয় গুগলি পিছে উড়ছে দুটো চিল॥’
এই জলের মানুষগুলি যখন কলকাতায় এসে ঘটিতোলা গুরুচরণের মতো পাড়ায় ঘুরে ঘুরে কুয়োর তলা থেকে ঘটি তুলে দিচ্ছে, আর কলকাতার ‘গৃহস্থালীর সকল কার্য্যই নির্বাহিত হইতো’– তখন বিস্মিত হয়ে ভাবত, এই ঘটি ঘটি মাপা জলের সংসার! জল বিষয়ে এরা বড় কৃপণ! তাই ব্যঙ্গাত্ম-পরিচয় হল ‘ঘটি’ নামে।
বাঙাল-ঘটির সম্পর্ক অলিখিতভাবে আড়াআড়ি ভাগ হয়ে গিয়েছিল। উনিশ শতক থেকেই একটা পরিবর্তন শুরু হল। দেশভাগের সময় বাংলাদেশ থেকে ছিন্নমূল মানুষগুলির স্রোত আছড়ে পড়ল কলকাতার উত্তরে ও দক্ষিণে। তৈরি হল কলোনির পর কলোনি। কলোনির বাইরে গিয়ে যাঁরা পয়সা দিয়ে ঘটিপাড়ায় বাড়ি কিনে এলেন, কমন একটা ঠেস দেওয়া পরিচয় হল ‘ন বাড়ি’ নামে। না, শুধু বাড়ি নয়, ওই বাড়ির ‘বাঙাল-বউ’, ‘বাঙালদের ছেলে বা মেয়ে’! এ এক অস্বস্তিকর পরিবেশ। কেউ তখন স্বপ্নেও বাঙাল-ঘটি ছেলে-মেয়েদের বিয়ের কথা ভাবতেও পারত না। ধীরে ধীরে বাঙালদের পায়ের নিচের মাটি শক্ত হল। কলকাতা একটা নতুন যুগে প্রবেশ করল নিঃশব্দে।
সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে এপার-ওপার দ্বন্দ্ব ঘুচল। বাঙাল-ঘটি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে শুরু করল। যুগসন্ধিক্ষণে নাটক লেখা এবং দুর্দান্তভাবে সফল নাটক ঘটি-বাঙালরা দেখতে এল– ‘বর্ধমানের বর-বরিশালের কনে’। শুধু অমিল হয়ে রইল চিংড়িমাছ ঘটিদের এবং ইলিশমাছ বাঙালদের।
যেদিন মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল খেলা হবে, সেদিন কোনও কোনও সংসারের মধ্যেই শুরু হয়ে যাবে বাঙাল-ঘটি লড়াই। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ফুটবল খেলার দিন গ্যালারি দখল নেয় চিংড়ি ও ইলিশের কাটআউট। চিংড়িমাছ বহুকাল ধরে ঘটিদের দখলে। বাঙালদের চোখে চিংড়ি গরিবদের মাছ! ঘটিরা কাঁটা বেছে মাছ খেতে পারে না বলে– ইলিশ-সহ সব মাছ থেকে দূরে থাকে। তাই ঘটিরা চিংড়িসর্বস্ব। ‘গুপ্তকবি’ ঈশ্বর গুপ্ত উনিশ শতকের মধ্যভাগে জানিয়েছেন:
‘দীনের তারণকারী চিংড়ির ঘুষো।
সমধুর বাতহর পয়সায় দুশো॥’
এখানে উল্লেখযোগ্য ‘দীনের তারণকারী’ আর এক ‘পয়সার দুশো’– ছোট চিংড়ি পেলে ঘটিরা খুশি এই অপবাদ কোনওদিনই ঘুচল না। না-না, সবাই তো আর গরিব নয়। বড়লোক ঘটিরা যে বড় চিংড়ি পছন্দ করেন, সেই চিংড়ি মাছ সম্পর্কে গুপ্তকবি লিখেছেন:
‘বিশেষতঃ শীতকালে অমৃতের খনি।
আমিষের সভাপতি মীন শিরোমণি॥’
এবার গর্বিত চিংড়ি মাছ নিয়ে, ঘটিদের ভাবখানা যেন:
‘চিংড়ি, কি আর বলিব আমি।
জীবনে মরণে জনমে জনমে
মুখে স্বাদ হইও তুমি॥’
বাঙালরা যখন এই বঙ্গে এসে কচু-ঘেঁচু-ঘাসপাতা সব খেয়ে দিয়েছে– তা দেখে ঘটিরা ব্যঙ্গ করেছে। বাঙালরা চিংড়ি পছন্দ করল না বা ঘটিদের জন্য ছেড়ে দিয়েছে– কিন্তু ‘কচু’ বাঙালদের অহংকার! তাই কবি ঈশ্বর গুপ্ত লিখেছন:
‘অপরূপ বস্তু এক মৃত্তিকার নিচে।
গাছ দেখে মনে হয় সমুদয় মিছে॥’
কবি ঠিক বলেছেন, মাটির নিচে কি ‘অপরূপ বস্তু’ রয়েছে, তা যেমন বোঝা যায় না, তেমনই ওপরের কচুর ডগা দেখেও মনে হয়েছে ‘মিছে’! কিন্তু চিংড়ি, মানকচু, নারকেল কুঁচোঘণ্ট– অথবা চিংড়ি কচু-ছোলা দিয়ে ঘণ্ট– খাদ্যরসিকদের মন ভোলানো পদ! বাঙাল-ঘটির মিলনে এই রান্নার পদের মানরক্ষা হয়, একথা অবশ্য বলেছেন কবি ঈশ্বর গুপ্ত:
‘কাহার সমাজে তার অতিশয় মান.
গুণ দেখে রসিকেতে নাম দিল মান॥’
কী! ঘটি-বাঙাল দুইপক্ষই কী ভাবছেন? ঠিকই ভাবছেন, ঘটিদের চিংড়ি সমাজে বাঙালদের ‘মান’ কচু সত্যি সত্যি ‘মান’ রেখেছেন! তাই গুপ্তকবি মুক্ত কণ্ঠে বলেছেন:
‘চিংড়ি মাছের সহিত মান যুক্ত ঝোলে.
একবার খেয়েছে যে সে কি কখনো ভোলে॥’
চিংড়ি-কচু, ঘটি-বাঙাল দুইপক্ষের প্রেম না হলে তো, প্রেমের পদ তৈরি হত না-তো? তাই উপরের গুপ্ত কবির লাইন দুটোকে কিছু পালটে বলতে ইচ্ছে করছে:
‘চিংড়ি-মান মিলে গিয়ে প্রেম যুক্ত হলে।
সেই ঝাল যে খেয়েছে সে কি তা ভোলে॥’
এই মিলন কিন্তু গোড়াতে ইলিশ-প্রেমে দেখা গেল না। ‘ইলিশ মাছ’ বাঙালদের মাছ– একথা ঘটিরা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করে থাকে। এক্ষেত্রে বাঙালদের স্পষ্ট বক্তব্য, ইলিশের সামনে ঘটিরা বিড়াল-তপস্বী! কেন এমন মন্তব্য? ঘটিপাড়া বলতে বোঝায় উত্তর কলকাতা। উত্তর কলকাতার শুরু বাঁকবাজার থেকে। গঙ্গার মূল ধারা একসময় এখান থেকে বাঁক নিয়ে পূর্বধারায় লবণহ্রদে এবং পশ্চিম ধারা সোজা প্রভাবিত হয়েছে। এই সঙ্গমস্থানে ইলিশের দেখা মিলত বাগবাজারের ঘাটে, তবে তা বিকেলে। ঘাটে ইলিশ-নৌকো ভিড়লে, কেউ যদি জিজ্ঞেস করত ‘ইলিশ আছে নাকি’! জেলে মাঝি তার কথার উত্তর দিত না– এটা ওদের সংস্কার। ওদের বলতে হবে ‘আছে নাকি’। ইলিশ নৌকো থেকেও কেনা যেত, আবার তাদের কাছ থেকে মেছো-ফেরিওয়ালা মাছ কিনে পাড়ায় পাড়ায় ইলিশ, তপসে ইত্যাদি হেঁকে মাছ বিক্রি করত। সেকালকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর ‘বালক’ কবিতার দু’টি লাইন:
‘ফেরিওয়ালা হেঁকে যেত গলির ওপর থেকে।
তপসি মাছের ঝুড়ি নিত গামছা দিয়ে ঢেকে॥’
নদীর ঘাটে যে ইলিশ বিক্রি হত তার সন্ধানও পাওয়া যায় কবিগুরুর রচনায়:
‘ইলিশমাছ আর পাকা কাঁঠাল জমল পাড়ের হাটে।
কেনা-বেচার ভিড় লাগল নৌকা বাঁধা ঘাটে॥’
বাগবাজারের ঘাটে বিকেলে ইলিশ কিনেছেন– ‘আছে নাকি’ বলে, আবার কেউ কিনেছেন মাথায় ঝুড়িতে গামছা ঢাকা ইলিশ। কিনলেন কারা? ‘ওই উত্তরের ঘটি বাড়ির মানুষ!’ মাছ ভাজার সময় রান্নাঘরের জানলা বন্ধ রাখতেন, কিন্তু গন্ধ-বাতাসকে তো বন্ধ রাখা সম্ভব নয়! রসরাজ অমৃতলাল বসু লিখলেন:
‘পাড়াতে কড়াতে কেহ (ইলিশ) মাছ ভাজে রাতে।
রন্ধনে আনন্দ বাড়ে গন্ধে মন মাতে॥’
ঘটি বাড়িতে রসিয়ে খাওয়া হল–
‘লাউপাতা সাথে ভাতে সর্ষেবাটা মাখা।
সেই ঝোলে মজা তার যার আছে চাখা॥’
কিংবা,
‘গরম গরম ভাজা খিচুরির সঙ্গে।
বর্ষাকালে হার্ষ গালে তোলে লোকে বঙ্গে॥’
রন্ধনে আনন্দ বাড়লেও ইলিশ-গন্ধে প্রতিবেশীর ‘মন মাতে’। ইলিশ-প্রেম দেখে ইলিশপ্রেমী বাঙালদের প্রশ্ন: বেড়াল যেমন মাছের সামনে তপস্বী হয়ে বসে থাকতে পারে না, তেমনই ইলিশের সামনেও বসে থাকতে পারেনি বা পারবে না, ধিক্ ইলিশ-প্রেমী বাঙালদের! একবার যখন ইলিশের স্বাদ জিভে লেগে গেছে সুতরাং তাকে তো আর ছাড়া যাবে না।
রবি ঠাকুরের ছড়ায় নদীর ঘাটে নৌকায় ইলিশের সঙ্গে কাঁঠাল বিক্রির এক পরম্পরার ছবি দেখতে পেয়েছি। অর্থাৎ বিষয়টি পরিষ্কার ইলিশ-প্রেম কাঁঠালের আঠার মতো– লাগলে পরে ছাড়ে না। সুতরাং, বাহানা চাই! ঘটিরা এবার দাবি করল, ‘আমরা তো গঙ্গার ইলিশ খাই, পদ্মার ইলিশ তো খাই না। গঙ্গার ইলিশ ঘটিদের ইলিশ।’
ব্যস! ইলিশ নিয়ে নতুন করে শুরু হয়ে গেল এক যুদ্ধ! গঙ্গার ঘটি-ইলিশ বনাম পদ্মার বাঙাল-ইলিশ! এই ইলিশ যুদ্ধে ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়লেন সমাজের সোনার মাথাওয়ালা মানুষজন। এই দেখুন না, কমলকুমার মজুমদার মাথা ঝাঁকিয়ে বলে দিলেন, ‘গঙ্গার ইলিশ দুশো বছর ধরে (ইস্ট ইন্ডিয়া) কোম্পানির তেল খেয়েছে। এই ইলিশের সঙ্গে অন্য ইলিশের (পদ্মার) পাল্লা দেবে কী করে?’
বাঙালরা একটু বাঁকা চোখে তাকিয়ে বললেন, তেল দেওয়া ঘটিদের একটা পুরনো অভ্যাস সেই কোম্পানি আমল থেকেই হয়ে এসেছে। নিজেদের প্রশংসার গন্ধ মুখে মুখে ছড়িয়ে দেওয়াটা মজ্জাতে মিশে গেছে– তাই ইলিশের গন্ধ নিয়েও ঘটিরা অহংকারী। ইলিশ নিয়ে বাঙালরা ঘটিদের উদ্দেশে একটিমাত্র বাক্য ব্যবহার করেন– ‘তোমরা তেল দেও, আমরা তেল খাই!’
হ্যাঁ, বাঙালদের পদ্মার ইলিশ তেল-যুক্ত। এরা কথায় কথায় বলেন, “পদ্মার ইলিশ রান্না করলে ‘কড়াই’ থাইক্যা হাতা দিয়া তেল ফেলায় দিতে অইত!” ঘটিদের কাছে এই কথাগুলো একটু বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে। না, বাড়াবাড়ি নয়, সমুদ্রের জলের যে ধারা পদ্মামুখী সেখানকার ইলিশের তেল প্রসঙ্গে ইলিশ-পণ্ডিত দিগেন বর্মণ তাঁর ‘ইলিশ পুরাণ’ গ্রন্থে (পৃ. ৬৪) কী লিখেছেন শুনুন:
‘গঙ্গার ইলিশে তেল হয় কিন্তু পদ্মার ইলিশের মতো অত নয়। আমি নিজে বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকারিদের সঙ্গে অনেকবার অনেকদিন কাটিয়েছি। তখন দেখেছি সমুদ্রের টাটকা ইলিশের কিন্তু অনেক তেল হত, কড়াই থেকে রান্নার সময় সেই তেল ফেলে দিতে হত পেট ঠিক রাখার জন্য।’
এই তৈলাক্ত ইলিশ খাওয়ার পরও হাত থেকে তেল সরানো যায় না। শ্রদ্ধেয় বুদ্ধদেব গুহ সুন্দর বলেছেন, ‘ঢাকা থেকে বন্ধুর পাঠানো ইলিশ খেয়ে কলম ঠিকমতো ধরতেই পারছি না। ইমপোর্টেড পদ্মার ইলিশের তেলে কলম পিছলে যাচ্ছে।’
তাহলে দাঁড়ানো কী? যম দত্ত ওরফে যতীন্দ্র মোহন দত্ত জানিয়েছেন, ঝগড়া করে লাভ নেই, শুধু মনে রাখতে হবে– ‘পুব দেশের ইলিশ মাছে তেল, আর কলকাতার ইলিশে সুগন্ধ বেশি।’
বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এ ইলিশকে মোটামুটি দেবতার আসনে বসিয়েছেন। তিনি লিখেছেন,
‘যেখানে ইলিশ মৎস্য সতৈলে অভিষেকের পর (ইলিশ মাছ তেলে ভাজার পর) ঝোল গঙ্গায় স্নান করিয়া মৃণ্ময় (মাটি), কাংস্যময় (কাঁসার) কাঁচময় (কাঁচের) বা রজতময় (রুপোর) সিংহাসনে (বাটিতে) উপবেশন (থাকেন) করেন, সেইজন্য আমরা (যারা খেতে বসেছি) মন প্রাণ প্রণত হইয়া (নমস্কারের মতো বাটির দিকে মাথা নিচু করে) পড়িয়া থাকি। (স্বাদ-গন্ধের) ভক্তিরসে অভিভূত হইয়া সেই তীর্থস্থান (খাওয়ার জায়গা) আর ছাড়িতে চাই না।’
শ্রদ্ধেয় পরিমল গোস্বামী বিশ্বাস করেছেন– ‘বায়ু বিশ্বকে বহন করে আছে, তার উপরে আছে কচ্ছপ, তার উপর আছে শেষ নাগ, তার উপর পৃথিবী। তার উপর কৈলাস শৃঙ্গ, তার উপর শিব, তার উপরে গঙ্গা, তার উপরে ইলিশ।’
সবার ওপরে যখন ‘ইলিশ’– তাকে ঘটি-বাঙাল ভাগ করবে কীভাবে! তাই গঙ্গার-ইলিশের সুগন্ধ দিয়ে পদ্মার ইলিশের তৈলাক্ত স্বাদ সঙ্গী করে দু’জনকে একস্বরে বলতে হবে– ‘ইলিশের স্বাদ-গন্ধের ভাগ হবে না।’
জেমস প্রিন্সেপ ছিলেন বহুমুখী প্রতিভাধর এক মানুষ। স্থাপত্যবিদ্যা, আবহাওয়াবিদ্যা, চিত্রাঙ্কন, ধাতুবিদ্যা, মুদ্রাতত্ত্বের পাশাপাশি ভাষা ও হরফবিদ্যাতেও তাঁর বিপুল জ্ঞান ছিল। কলকাতার প্রিন্সেপ ঘাট তাঁর নামানুসারেই। আজ জেমস প্রিন্সেপের ২২৫তম জন্মদিন।