যুদ্ধকামী রাষ্ট্রের কাছে শিশুরাই সহজতম টার্গেট। রক্তাক্ত, আতঙ্কিত এবং কান্নারত শিশুদের মুখ যুদ্ধের সাফল্যের বার্তা দেয়। ভয়াবহতার মাপকাঠিতেই তো যুদ্ধের সাফল্যের বিচার হয়! বিশ্বজোড়া জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত শিশুদের ওপরেই বেশি পড়ছে। ‘এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য’ করে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি আমরা রাখতে পারিনি। ওদের জন্যে আমরা রেখে যাচ্ছি এক বিকৃত সমাজ আর সীমাহীন স্বার্থপরতার দৃষ্টান্ত৷ ঝোলা ভর্তি খেলনা নয়, অভুক্ত-অপুষ্ট শিশু পাক বছরভর খাদ্যের নিশ্চয়তা। নিগ্রহ নয়, পাচার নয়, দেশ কালের সীমানা ভেঙে সব শিশুর জন্যে নিরাপত্তার আশ্বাস এনে দিক স্যান্টা।
স্যান্টা ক্লজ যেন বড়দিনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাস্যাডর! ক্রিসমাস যতটা প্রভু যিশুর, ততটাই স্যান্টার। কিন্তু কে এই স্যান্টা ক্লস! কেমন করেই বা স্যান্টা-বুড়ো ক্রিসমাসের আগমনী দূত হয়ে উঠল? ইতিহাস, বা বলা ভালো, মিথ বলছে, চতুর্থ শতকের সেন্ট নিকোলাস-ই নাকি আজকের স্যান্টা ক্লস! তার আদি নিবাস এশিয়া মাইনরে, বর্তমান টার্কির মায়রা প্রদেশে।
নিকোলাস ছোটবেলায় বাবা-মাকে হারান। কিন্তু তার জন্যে বাবা-মা প্রভূত সম্পত্তি রেখে যান। বালক নিকোলাস খুব দয়ালু স্বভাবের ছিল। এক কন্যাদায়গ্রস্ত গরিব প্রতিবেশীকে সাহায্য করার জন্যে সে লুকিয়ে তার মেয়ের মোজার মধ্যে স্বর্ণমুদ্রা রেখে এসেছিল। এমনটা নাকি বেশ কয়েকবার করেছিল ছোট্ট নিক। পরবর্তীকালে এই নিক-ই মায়রার বিশপ হন। সেন্ট নিকোলাস শিশুদের খুব ভালোবাসতেন আর তাদের খুশি করতে উপহার দিতেন। আজকের স্যান্টাও তাই শিশুদের জন্যে লুকিয়ে উপহার রেখে যায়; আর মোজাকেই বেছে নেয় উপহার রাখার জন্যে। অন্তত জ্ঞানগম্যি হওয়ার আগে অবধি এই বিশ্বাসটাই বড়দিনের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ!
ডাচ ভাষায় সেন্ট নিকোলাসের ডাকনাম ‘সিন্টারক্লাস’। মধ্যযুগ পর্যন্ত ইউরোপ জুড়ে সেন্ট নিকোলাসের মৃত্যুদিন ৬ ডিসেম্বরকে ‘সেন্ট নিকোলাস ডে’ হিসেবে পালন করা হত। ষোড়শ শতকের চার্চ ব্যবস্থার সংস্কারের পর অবশ্য তাতে খানিক ভাটা পড়ে। শুধুমাত্র হল্যান্ডে ডাচরাই সেই উদযাপনের ধারা বজায় রেখেছিল। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে আমেরিকার পূর্ব-উপকূলের নিউ অ্যামস্টারডাম বা বর্তমানের নিউ ইয়র্ক সিটিতে ডাচরা বসতি গড়তে শুরু করে। তাদের সঙ্গে আসে তাদের ‘সিন্টারক্লাস’-এর ট্র্যাডিশনও। এই ডাচ ট্র্যাডিশন আমেরিকায় বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। ডাচ ‘সিন্টারক্লাস’ থেকে জন্ম হয় আমেরিকান ‘স্যান্টা ক্লজ’-এর।
১৮০৪ সালে ‘আমেরিকান হিস্টোরিক্যাল সোসাইটি’র উদ্যোগে অ্যালেক্সান্ডার অ্যান্ডারসন প্রথম সেন্ট নিকোলাস বা স্যান্টা ক্লজ এর ছবি আঁকেন। তার কিছুদিন আগেই ওয়াশিংটন আরভিং, তাঁর ব্যঙ্গ সাহিত্য “নিকারবোকার’স হিস্ট্রি অফ নিউইয়র্ক”-এ স্যান্টাকে এক ‘জলি গড’ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। এরপর ১৮২২-এ ক্লেমেন্ট মুর তাঁর কবিতা ‘দ্য নাইট বিফোর ক্রিসমাস’-এও স্যান্টাকে স্লেজগাড়ি চড়া, হাসিখুশি, উপহার-বিলোনো এক চরিত্র হিসেবে হাজির করেন। স্যান্টার চেহারা বারবার পাল্টেছে শিল্পীদের হাতে।
১৮৬২-তে আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পর কার্টুনিস্ট টমাস ন্যাস্ট “হার্পার’স উইকলি”-র জন্য আঁকলেন স্যান্টা ক্লজের ছবি। যে ন্যাস্ট ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকান পার্টির প্রতীক হিসেবে গাধা আর হাতির ছবি এঁকেছিলেন, তিনি-ই আঁকলেন বেঁটেখাটো, দাড়িওয়ালা এবং গোলগাল চেহারার স্যান্টাকে, ইউনিয়ন পার্টির সমর্থক হিসেবে।
পরের ৩০ বছর ন্যাস্ট নানা পরিবর্তন এনেছেন স্যান্টার চেহারায়। তামাটে রঙ বদলে স্যান্টার কোটের রঙ হয়েছে লাল। এক সময় ন্যাস্ট তাঁর কল্পনার স্যান্টাকে পাঠিয়ে দিলেন উত্তর মেরুতে, যেখানে নাকি একটা খেলনা তৈরির কারখানা আছে। আর আছে দুষ্টু আর লক্ষ্মী ছেলেদের নাম লেখা এক লম্বা খাতা। স্যান্টার ছবিতে ক্রমে ক্রমে যোগ হয়েছে মেরু প্রদেশের বরফ, পাইন গাছ, বল্গা হরিণ এবং এরকম আরও অনেক কিছু।
স্যান্টার বাণিজ্যিক আত্মপ্রকাশ ১৯৩১-এ কোকাকোলা কোম্পানির বিজ্ঞাপনে। কোম্পানি হ্যাডন সান্ডব্লম নামের এক শিল্পীকে স্যান্টার ছবি আঁকার দায়িত্ব দেয়। কোম্পানি চেয়েছিল বিজ্ঞাপনের স্যান্টা হবে কিছুটা বাস্তব, কিছুটা প্রতীকী। সান্ডব্লম তখন ক্লেমেন্ট মুর-এর কবিতার স্যান্টাকে তাঁর নিজের কল্পনার রঙে সাজিয়ে এক মোটুসোটু, হুল্লোড়ে, ফুর্তিবাজ মানুষের রূপ দিলেন। পরবর্তী প্রায় ৩৫ বছর কোকাকোলার বিজ্ঞাপনে নানা মুডে হাজির হয়েছে স্যান্টা। সান্ডব্লমের আঁকা স্যান্টা-ই আজকের দুনিয়াজোড়া ক্রিসমাসের আইকন!
স্যান্টা ক্লজ কিন্তু শুধুই এক কাল্পনিক চরিত্র নন। তিনি দিব্যি খান-দান, হেঁটে চলে ঘুরে বেড়ান, গল্প করেন, রাজনৈতিক মত প্রকাশ করেন, ইলেকশনে প্রার্থী হন। অবাক হচ্ছেন? এবার তবে কল্পনার স্যান্টাকে ছেড়ে বাস্তবের স্যান্টাদের সঙ্গে পরিচয় করা যাক।
………………………………………..
বরফের চাদরে মোড়া গ্রামে স্লেজ এবং বল্গাহরিণের দেখাও মেলে সহজেই। নর্দার্ন লাইটস্ বা অরোরা দেখতে পেলে তো কথাই নেই! লাল আলখাল্লা আর সাদা দাড়িতে সজ্জিত স্যান্টা ক্লজ দর্শনার্থীদের সঙ্গে গল্প করেন, হ্যান্ডশেক করেন, সবার সঙ্গে ছবি তোলেন। কিন্তু তাঁর সঙ্গে ছবি তুলে নিজের সংগ্রহে রাখতে গেলে আপনাকে ৪০ ইউরো খসাতে হবে! স্যান্টার বাড়ির পাশেই আছে স্যান্টা ক্লজ পোস্ট অফিস। সেখানে ডাক টিকিট লাগিয়ে আপনিও পোস্ট করে দিতে পারেন কোনও চিঠি। এই পোস্ট অফিসে বছরে প্রায় আধ মিলিয়ন চিঠি আসে স্যান্টার নামে। আর বড়দিনের সময় প্রতিদিন গড়ে ৩০ হাজার!
………………………………………..
ফিনল্যান্ডের উত্তর সীমান্তে ল্যাপল্যান্ড। তার-ই মধ্যে ছোট্ট শহর রোভানিয়েমি। যার মধ্যে ‘স্যান্টা ক্লজ ভিলেজ’। সেখানেই বাস করেন স্যান্টা ক্লজ। কয়েক পুরুষ ধরে বাস। স্যান্টার বাড়ির সামনে দিয়ে চলে গেছে সুমেরু রেখা। ভূগোল বইতে পড়া ছেষট্টি ডিগ্রি চৌত্রিশ মিনিট উত্তর অক্ষাংশ। অর্থাৎ, কি না উত্তর মেরু প্রদেশের শুরু। সেই কাল্পনিক রেখাকে মাটিতে রঙ দিয়ে প্রকটভাবে চিহ্নিত করে দিয়ে রোভানিয়েমি স্যান্টাকে ঘিরে ফ্যান্টাসির মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সুমেরু বৃত্ত টপকে পৌঁছতে হয় স্যান্টার বাড়ি। ফিনল্যান্ডে বেড়াতে আসা পর্যটকরা রোভানিয়েমির স্যান্টা ক্লজের সঙ্গে সাক্ষাৎ না করে সচরাচর যান না!
বরফের চাদরে মোড়া গ্রামে স্লেজ এবং বল্গাহরিণের দেখাও মেলে সহজেই। নর্দার্ন লাইটস্ বা অরোরা দেখতে পেলে তো কথাই নেই! লাল আলখাল্লা আর সাদা দাড়িতে সজ্জিত স্যান্টা ক্লজ দর্শনার্থীদের সঙ্গে গল্প করেন, হ্যান্ডশেক করেন, সবার সঙ্গে ছবি তোলেন। কিন্তু তাঁর সঙ্গে ছবি তুলে নিজের সংগ্রহে রাখতে গেলে আপনাকে ৪০ ইউরো খসাতে হবে! স্যান্টার বাড়ির পাশেই আছে স্যান্টা ক্লজ পোস্ট অফিস। সেখানে ডাক টিকিট লাগিয়ে আপনিও পোস্ট করে দিতে পারেন কোনও চিঠি। এই পোস্ট অফিসে বছরে প্রায় আধ মিলিয়ন চিঠি আসে স্যান্টার নামে। আর বড়দিনের সময় প্রতিদিন গড়ে ৩০ হাজার! ল্যাপল্যান্ডের স্যান্টা যে ফিনল্যান্ডের পর্যটন ব্যবসাকে বেশ চাঙ্গা করেন, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
তবে শুধু ফিনিশ স্যান্টা নয়, উত্তর গোলার্ধে আরও স্যান্টা আছেন। গ্রিনল্যান্ডে আছেন। আছেন রাশিয়ান স্যান্টা, স্প্যানিশ স্যান্টা, জার্মান স্যান্টা। তাঁরা সবাই কল্পনার আদলে গড়া বাস্তবের ‘জলি গড’।
আলাস্কার স্যান্টা অবশ্য একটু অন্যরকম। ৭৫ বছর বয়সী এই স্যান্টা ক্লজ আলাস্কার মেয়র। পাবলিক টেলিভিশন থেকে চেম্বার অফ কমার্স এবং মাঝে বিচিত্র সব কাজের অভিজ্ঞতা-ঋদ্ধ, নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির মাস্টার্স, টমাস প্যাট্রিক ও’কোনার ২০০৫ সালে নাম পালটে ‘স্যান্টা ক্লজ’ হন। তারপর নেভেদার বাড়ি ছেড়ে আলাস্কায় থিতু হন। সমাজ সচেতন, প্রতিবাদী এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব স্যান্টা আলাস্কার কংগ্রেশনাল ইলেকশনের প্রার্থীও হয়েছিলেন। জনপ্রিয়তার নিরিখে প্রতিদ্বন্দ্বী সারা পলিনকে বেশ চাপের মুখে ফেললেও শেষরক্ষা হয়নি যদিও। আমেরিকার অভিভাষণ নীতির বিরুদ্ধে তাঁর মতামত বলিষ্ঠ। স্যান্টার দাবি এবং লড়াই, ‘মেডিকেয়ার ফর অল’ এবং শিশুদের অধিকার সুরক্ষিত করার পক্ষে। নানা দপ্তরের নানা ফাইলের গেঁরো থেকে শিশুদের মুক্তি দিতে তাঁর আর এক লড়াই ছিল সমস্ত সরকারি দপ্তরের মধ্যে সমন্বয় এনে ‘এক শিশু এক ফাইল’ নীতি চালু করা। তাতে সফল হয়েছেন স্যান্টা।
এই স্যান্টা ক্লজই আলাস্কায় “এরিন’স ল” পাশ করানোর মূল উদ্যোক্তা। এই আইন অনুসারে, স্কুলের শিক্ষকরা বাধ্যতামূলকভাবে শিশুদের দৈহিক সুরক্ষা সম্বন্ধে সচেতন হতে এবং যৌন নিগ্রহ প্রতিহত করতে শেখাবেন। এরিন মেরিনের সাড়া জাগানো আত্মকথা ‘স্টোলেন ইনোসেন্স’ থেকেই এই আইন এর সূত্রপাত। আজ এই আইন বিশ্বের বহু দেশ-ই চালু করছে। প্রসঙ্গত, আমাদের দেশে কেরালাতেই প্রথম স্কুলের পাঠক্রমে শিশুর যৌন সুরক্ষার বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আলাস্কার এই স্যান্টা বাচ্ছাদের খেলনা দেন না। তিনি কাজ করে যান তাদের সুস্থ বিকাশ এবং নিরাপত্তার জন্যে; তাদের বেড়ে ওঠাকে আরও আনন্দময় করতে। এই স্বঘোষিত স্যান্টা ক্লজ বলেন ‘সন্ত্রাসবাদী ক্রিয়াকলাপ মূলত সরকার এবং কর্পোরেট সিদ্ধান্তের কারণে ঘটে, ধর্মীয় কারণে নয়।’ কথাগুলো ভাবায় বৈকি!
একুশ শতকের শিশুরা বোধ হয় আগের থেকে অনেক বেশি বিপন্ন। যুদ্ধকামী রাষ্ট্রের কাছে শিশুরাই সহজতম টার্গেট। রক্তাক্ত, আতঙ্কিত এবং কান্নারত শিশুদের মুখ যুদ্ধের সাফল্যের বার্তা দেয়। ভয়াবহতার মাপকাঠিতেই তো যুদ্ধের সাফল্যের বিচার হয়! বিশ্বজোড়া জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত শিশুদের ওপরেই বেশি পড়ছে। ‘এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য’ করে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি আমরা রাখতে পারিনি। ওদের জন্যে আমরা রেখে যাচ্ছি এক বিকৃত সমাজ আর সীমাহীন স্বার্থপরতার দৃষ্টান্ত৷ ঝোলা ভর্তি খেলনা নয়, অভুক্ত-অপুষ্ট শিশু পাক বছরভর খাদ্যের নিশ্চয়তা।
তাই নিগ্রহ নয়, পাচার নয়, দেশ কালের সীমানা ভেঙে সব শিশুর জন্যে নিরাপত্তার আশ্বাস এনে দিক স্যান্টা। স্যান্টার ছোঁয়ায় এ বিশ্বের শিশুরা পাক এক ভয়-হীন সমাজ, এক মানবিক এবং আনন্দময় পৃথিবী। রাতের অন্ধকারে এসে ঘুমন্ত শিশুদের চোখে স্যান্টা এঁকে দিক এক নতুন সকালের স্বপ্ন। এক বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তোলার স্বপ্ন! আর সেই স্বপ্নকে সত্যি করার সাহসও। সেই হোক বড়দিনের সেরা উপহার।
………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………
হজমের গোলমাল সারাতে বাঙালি পশ্চিমে ‘চেঞ্জে’ যেতে শুরু করল, কিন্তু নিজেদের দৌড় সীমাবদ্ধ রাখল নিজের রাজ্যের সীমারেখার ১০০ মাইলের মধ্যে। চেঞ্জারদের ভিড় দেখে মধুপুর, শিমূলতলা, ঘাটশিলার স্থানীয় মানুষ দুটো বাড়তি পয়সা রোজগার করার তাগিদে বাংলা শিখে নিল, তাতে বাঙালির হল পোয়াবারো!