ছাঁচের তৈরি না হয়েও শুধুমাত্র কাঁচা মাটি দিয়ে হাতে টিপে এমন শিল্পের সুষমা বড্ড বিরল। সংসার নামে যে যুদ্ধে প্রতিটি নারীকে প্রতিদিন লড়তে হয়। তারই মধ্যে থেকেও মুখের হাসিটা বজায় রাখা ইচ্ছাই প্রস্ফুটিত হয়েছে হিঙ্গুল পুতুলে। বেশিরভাগ হিঙ্গুল পুতুলের কোনও হাত নেই। সন্তান কোলে জননী বা ষষ্ঠী পুতুলে হাত রয়েছে। মাথায় জল নিয়ে যাওয়া হিঙ্গুল পুতুলে হাত রেখেছেন শিল্পী। কোলে নিজের বাচ্চাকে নিয়ে মাতৃসুলভ আত্মতৃপ্তি দেখা গিয়েছে হিঙ্গুল পুতুলে। অন্যদিকে মুখে শিকার নিয়ে যাওয়া শেয়ালের পিঠের ওপর বসে মেয়ে হিঙ্গুল পুতুল। এই পুতুলের মধ্যে মাতৃত্বের জয় ঘোষিত হয়েছে। পিতৃতন্ত্র সেখানে পরাস্ত।
প্রচ্ছদ শিল্পী: দীপঙ্কর ভৌমিক
বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের প্রসঙ্গ উঠলেই প্রতিটি বাঙালির মন সৃজনের আনন্দে ভরে ওঠে। মন্দিরগাত্রে অনিন্দ্যসুন্দর পোড়ামাটির কারুকার্য একটা জাতিকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে গর্বের অনুপ্রেরণা দিয়ে গিয়েছে। জোড়বাংলা, রাসমঞ্চ-সহ অন্যান্য ঐতিহাসিক নিদর্শনের মাঝে নিবিড়ভাবে বসত করে হিঙ্গুল পুতুল। সরল আঙ্গিকে ভরা এই পুতুলের মধ্যে থেকে গিয়েছে শৈশবের ভালোবাসা। দলমাদল কামানের গর্বের গর্জনের মধ্যেও হিঙ্গুল পুতুল তার নিজস্ব অস্তিত্ব আজও বজায় রেখেছে।
বিষ্ণুপুরের শাঁখারী বাজারের মনসাতলার ফৌজদার পরিবারের মহিলা সদস্যরা এখনও এই পুতুল বানিয়ে চলেন। পূর্ণিমা, শিখা, গঙ্গা ফৌজদারদের হাতে বছরের পর বছর ধরে প্রাণময়ী হয়ে ওঠে হিঙ্গুল। এই পরিবারের পুরুষ সদস্যরা মূলত দুর্গাপট, দশঅবতার তাস ও মাটির প্রতিমা নির্মাণে যখন ব্যস্ত থাকেন তখন অন্দরমহলে কাঁচা মাটি দিয়ে টিপে টিপে রোদে শুকিয়ে তার ওপর ‘হেম’ বা ‘হরিতাল’ নামক খনিজ রং দিয়ে হিঙ্গুল পুতুল তৈরি করেন ফৌজদার পরিবারের মহিলা শিল্পীরা।
সন্তানের মঙ্গল কামনায় ও সন্তান লাভের আশায় জিতাষ্টমী দিন মায়েরা যখন পুজোর জন্য কাঁচা মাটির তৈরি শিয়াল, শকুন ও সন্তান কোলে জননী বা ষষ্ঠী পুতুল কিনতে আসে তখন বাচ্চাদের জন্য মেয়েবেলার স্মৃতিতে মাখানো টেপা রঙিন হিঙ্গুল পুতুলও কিনে নিয়ে যায়। জিতাষ্টমী দিন বাড়ির বাইরে একটার পর একটা হিঙ্গুল পুতুল সাজিয়ে রাখে ফৌজদার পরিবার। সাধারণ মানুষ এসে সেগুলো সংগ্রহ করে। যদিও সেই সাধারণের মাঝে কচিকাঁচাদের সংখ্যাই বেশি। আগে শুধুমাত্র জিতাষ্টমী পুজো উপলক্ষে এই পুতুল তৈরি হলেও শৌখিন সংগ্রাহকদের দেওয়াল আলমারি পূর্ণ করার জন্য সারা বছরই তৈরি হয় হিঙ্গুল। বাংলার ভৌগলিক সীমানা ছড়িয়ে গোটা ভারতে যায় হিঙ্গুল পুতুল।
উল্লেখ্য, জীমূতবাহন নামক লৌকিক দেবতার আরাধনা দিনকে জিতাষ্টমী বলা হয়। মনে করা হয়, ‘জীমূত’ থেকে ‘জিতা’ কথাটি এসেছে।
মেদিনীপুরের পোড়ামাটির জো পুতুলের নাক অতিমাত্রায় টিকালো। মুখমণ্ডল কাঠিন্য ও অভিব্যক্তিহীন। কর্কশ চোখের দৃষ্টি জো পুতুলে বিদ্যমান। হাওড়া জেলার পোড়ামাটির টেপা পুতুলের ওপর কোনও রঙের আস্তরণ নেই। আলাদা করে মাটির ঢেলা দিয়ে চোখ আঁকা হলেও চাহনিতে নমনীয় মনোভাবের অভাব।
……………………………………………………..
আরও পড়ুন শুভঙ্কর দাস-এর লেখা: কোলে গণেশ, তাই বঙ্গীয় লোকজ শিল্পের শিব গলায় সাপ রাখেননি
……………………………………………………..
উত্তরবঙ্গের সুভাষগঞ্জের পুতুলের মুখে নাক বেশি গুরুত্ব পেলেও সার্বিক মুখমণ্ডলে কোনও পেশির মোচড় নেই। আর এখানেই হিঙ্গুল অন্যান্য টেপা শ্রেণির পুতুলের থেকে আলাদা। চোখের দৃষ্টিতে সারল্য মাখা মাধুর্যতা। মুখমণ্ডল ছেয়ে রয়েছে অনাবিল হাসিতে। মাথার চুলের ওপরে মুকুট। দেখামাত্রই শিশুমনকে আনন্দ দিয়ে যায়। পরনের কাপড়ে ইউরোপীয় শৈলীর ছোঁয়া। রঙের সূক্ষ্ম আলপনায় গোটা শরীর মুড়ে গিয়েছে। ছাঁচের তৈরি না হয়েও শুধুমাত্র কাঁচা মাটি দিয়ে হাতে টিপে এমন শিল্পের সুষমা বড্ড বিরল। সংসার নামে যে যুদ্ধে প্রতিটি নারীকে প্রতিদিন লড়তে হয়। তারই মধ্যে থেকেও মুখের হাসিটা বজায় রাখা ইচ্ছাই প্রস্ফুটিত হয়েছে হিঙ্গুল পুতুলে। বেশিরভাগ হিঙ্গুল পুতুলের কোনও হাত নেই। সন্তান কোলে জননী বা ষষ্ঠী পুতুলে হাত রয়েছে। মাথায় জল নিয়ে যাওয়া হিঙ্গুল পুতুলে হাত রেখেছেন শিল্পী। কোলে নিজের বাচ্চাকে নিয়ে মাতৃসুলভ আত্মতৃপ্তি দেখা গিয়েছে হিঙ্গুল পুতুলে। অন্যদিকে মুখে শিকার নিয়ে যাওয়া শেয়ালের পিঠের ওপর বসে মেয়ে হিঙ্গুল পুতুল। এই পুতুলের মধ্যে মাতৃত্বের জয় ঘোষিত হয়েছে। পিতৃতন্ত্র সেখানে পরাস্ত।
নারী জীবনের পাশাপাশি পুরুষ নারীর বৈবাহিক সম্পর্কের কথাও বর-বউ পুতুলের মাধ্যমে উঠে এসেছে। বর পুতুলের মাথায় মাটির তৈরি টোপর ও মেয়ে পুতুলের মাথায় মাটির দিয়ে তৈরি মুকুট দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সঙ্গে উভয়ের গলার মধ্যে মাটি দিয়ে মালা। আর সেই মালার ওপর কারুকার্য করা। বউ হিঙ্গুল পুতুলের মুখে চন্দন আঁকা ফোঁটা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কয়েকটি মেয়ে হিঙ্গুলের কপালে তিলক দেওয়া রয়েছে। পইতে পরা যোগমুদ্রায় থাকা ব্রাহ্মণের দেখা মেলে হিঙ্গুল পুতুলে। সারা শরীর উন্মুক্ত। গলায় মালা। কপালে তিলক। হাতের কবজিতে বালা। কিন্তু মুখে শাস্ত্রের গাম্ভীর্য নেই। রয়েছে সেই আদি অকৃত্রিম অনাবিল হাসি। হিঙ্গুল পুতুল শৈলীর মধ্যে দিয়ে জগন্নাথ, সুভদ্রা, বলভদ্র, গণেশ, শিবলিঙ্গ গড়ে তোলা হয়েছে। গণেশ নির্মাণে বিভিন্ন শৈলীর দেখা মেলে। যেমন সারা শরীর উন্মুক্ত গণেশের। মাথায় মুকুট। শরীর থেকে লাল রঙের উজ্জ্বল দ্যুতি বেরিয়ে আসছে। আবার অন্য একটি গণেশের শরীর বস্ত্র দিয়ে সজ্জিত।
বাঁকুড়া জেলা বরাবর নারী জীবনের সংগ্রামকে পুতুল নির্মাণে তুলে ধরেছে। যেমন পাঁচমুড়ার রেলপুতুল। ঠিক তেমনভাবেই হিঙ্গুলের মধ্যে মেয়েবেলার ভাললাগা মৃন্ময়ী থেকে আনন্দময়ী হয়ে শরতের নির্মল আকাশের মতো বিচরণ করছে।
…………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………..