পৃথিবীর ষষ্ঠ বৃহৎ গণবিলুপ্তি শুরু হয়ে গিয়েছে। আমরা টের পাচ্ছি না বটে, কিন্তু আমাদেরই চোখের সামনে হারিয়ে যাচ্ছে হাজার-হাজার প্রজাতি। আর এইবার, এই গণবিলুপ্তির কারণ প্রকৃতি নিজে নয়। এবার এসব ঘটছে আমাদের জন্য, মানুষের জন্য। লিখছেন জয়দীপ ঘোষ।
১৮০৪ সাল। পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথমবার মানুষের সংখ্যা হয়ে দাঁড়াল ১ বিলিয়ন। ১০০ কোটি। মানুষ নামের প্রজাতিটি তার তিন লক্ষ বছরের ইতিহাস ঠেলে অবশেষে এসে দাঁড়াল বিলিয়নের কোঠায়। কিন্তু আমরা জানি, এর পরের কাহিনি আরও চমকপ্রদ। একশো কোটি থেকে দুশো কোটিতে পৌঁছতে আমাদের লাগল মাত্র ১২৩ বছর। ১৯২৭ সালে এই ‘কৃতিত্ব’ অর্জন করে ফেললুম আমরা। আর তার পরে, এখনও একশো বছর কাটেনি, আমরা পৌঁছে গিয়েছি আটশো কোটিতে! জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই হারকে চোখ-রগড়েও বিশ্বাস করা শক্ত হয়ে ওঠে এক এক সময়ে।
বিগত শতাব্দীতে দু’-দুটো বিশ্বযুদ্ধ পার করেছি আমরা। সামলেছি একাধিক অতিমারীর ঝাপটা। ১৯৪৩-এ ভারতবর্ষ এবং ১৯৫৯-র চিন দেশে মহামন্বন্তরে প্রাণ গিয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষের। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই অভূতপুর্ব গতি এতটুকু বাধা পায়নি কোথাও!
কেন এমনটা হতে পারল? অনেক তার কারণ। কিন্তু প্রধান কারণ নিশ্চয়ই একদিকে অ্যান্টিবায়োটিকের আবিষ্কার (১৯২৮)-সহ চিকিৎসাবিজ্ঞানের অকল্পনীয় অগ্রগতি। অন্যদিকে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ্বে রাসায়নিক সার আবিষ্কার এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তার বহুল ব্যবহারের ফলে খাদ্য-উৎপাদনে অভাবনীয় বৃদ্ধি। ১৯৫০ সালে, স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে, ভারতবাসীর গড় আয়ু ছিল ৩৫। ২০২৩-এ তা হয়ে দাঁড়িয়েছে ৭০!
রবীন্দ্রনাথ তাঁর এক বিখ্যাত কবিতায় লিখেছিলেন, ‘মানুষ চূর্ণিল যবে নিজ মর্ত্যসীমা/ তখন দিবে না দেখা দেবতার অমর মহিমা?’ মানুষ তার সাধনা দিয়ে, প্রজ্ঞা দিয়ে মর্ত্যসীমা চূর্ণ করার দিকে এগিয়ে চলেছে নিরন্তর। এই সাধনা সহজের সাধনা নয় বলেই, মানুষ হিসেবে এতে গর্বিত হওয়ারও বিলক্ষণ অধিকার জন্মেছে আমাদের।
শুধু, এই গর্বের মধ্যে, যেন খানিকটা আশঙ্কাও জেগে থাকে। জেগে থাকে উদ্বেগ। দেবতার মহিমার পাশাপাশি দানবের রুদ্ররোষও আমরা নিজ সাধনা দিয়ে জাগিয়ে তুলছি কি না, সেই কথাটা আমাদের বিবেচনাবোধ থেকে যেন একেবারে হারিয়ে না যায়।
আমরা জানি, প্রাণীজগতের ইতিহাস একাধিকবার গণবিলুপ্তি বা মাস-এক্সটিংশনের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। বিজ্ঞানীরা ইতিহাসে পাঁচটি বড় মাপের গণবিলুপ্তির প্রক্রিয়াকে চিহ্নিত করেছেন, যার শেষটি ঘটেছে ৬৫ মিলিয়ন (১ মিলিয়ন = ১০ লক্ষ) বছর আগে। প্রায় প্রত্যেকবারই পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে সে যুগে অস্তিত্ববান অন্তত ৭০% প্রাণীকুল। আর প্রত্যেকবারই, এই গণবিলুপ্তির কারণ ছিল প্রাকৃতিক। উল্কাপাত, আগ্নেয়গিরির হঠাৎ উদ্গীরণ, চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া। কিন্তু এই প্রথমবার, এই যে যুগে আমরা বাস করছি এখন, এবার আমাদের চোখের সামনে ঘটছে এমন একটা কিছু, যা অচিন্তনীয়। যা মর্মান্তিক।
বিজ্ঞানীরা নাম দিচ্ছেন হলোসিন এক্সটিংশন। পাঁচের পরে ছয়। পৃথিবীর ষষ্ঠ বৃহৎ গণবিলুপ্তি শুরু হয়ে গিয়েছে। আমরা টের পাচ্ছি না বটে, কিন্তু আমাদেরই চোখের সামনে হারিয়ে যাচ্ছে হাজার-হাজার প্রজাতি। আর এইবার, এই গণবিলুপ্তির কারণ প্রকৃতি নিজে নয়। এবার এসব ঘটছে আমাদের জন্য, মানুষের জন্য। আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের ‘সভ্যতা’, আমাদের ‘উন্নতি’ নিশ্চিত ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে অগণিত প্রাণকে। আমরা জলকে করে তুলেছি বিষাক্ত, আকাশ ঢেকে দিয়েছি ধোঁয়ায়। মাটিতে মিশিয়েছি রাসায়নিক। মাইলের পর মাইল জঙ্গল কেটে সাফ করে বানিয়েছি গগনচুম্বী ইমারত। এই সেদিন পর্যন্ত মানুষের আমোদের অংশ ছিল পশুশিকার। চামড়া ছাড়িয়ে, মাথা কেটে বৈঠকখানায় সেগুলোকে ঝুলিয়ে রাখা ছিল বড়লোকের দেখনদারির অংশ। ইউরোপ-আমেরিকার বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে ছররা দিয়ে পাখি-মারা ছিল এক জনপ্রিয় খেলা। ১৯০০ সালের অলিম্পিক্স-এ উড়ন্ত পাখির উপরেই তাক করে বন্দুক চালিয়েছিলেন প্রতিযোগীরা। একবারে সর্বোচ্চ বাইশটি পায়রাকে নিখুঁত লক্ষ্যে গুলি করে সেবার বিজয়ী হয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার এক প্রতিযোগী ডোনাল্ড ম্যাকিনটস!
সভ্যতার বুকে জমেছে অনেক পাপ! এই ধরিত্রীর কাছে, প্রকৃতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার সময় এখনও ফুরিয়ে যায়নি আমাদের! কিন্তু তার আন্তরিক ইচ্ছে আদৌ আমাদের আছে কি না, সে এক মস্ত প্রশ্ন। এক নির্ভরযোগ্য তালিকায় দেখছিলাম শুধু বিশ শতকেই পাখির প্রায় ৮৩টি প্রজাতি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। যারা গেল চিরতরে, তারা তো ‘আমরা’ ছিলাম না। তাই আমাদের কোথাও কিছু যায় আসেনি। কিন্তু দানবের রুদ্ররোষ কোনও দিন মানুষের দিকে ধেয়ে আসবে না, এত অহংকার কি আমাদের সাজে? সকলেই জেনে গিয়েছেন নিশ্চয়ই এর মধ্যেই যে, এই বছরের (২০২৩) জুলাই মাস ছিল মানুষের রেকর্ডেড ইতিহাসে উষ্ণতম। কেউ কেউ অনুমান করেছে, গত ১ লক্ষ বছরে এত উষ্ণ জুলাই মাস না কি আর আসেনি!
প্রকৃতি কি তবে প্রতিশোধ নিতে শুরু করল? অনেক দেরি করে ফেললাম কি আমরা?