যার কেউ নেই, তার এআই আছে। আর কিছু না হোক, মাথা চুলকে দু’চাট্টি চুলের সঙ্গে আইডিয়া যদি উপড়ে আসে। এখন গুগলে সার্চ মারলে উত্তমকুমারের সঙ্গে কৃত্রিমকুমার মিলছে খানকতক। দিনে দিনে সে হয়তো সংখ্যায় বাড়বে। বাঙালি যে অবতার অর্ডার করছে, উত্তমও সেই বেশে তৎক্ষণাৎ হাজির হচ্ছেন, যৌনতা ছাড়া এর চে’ বড় হাতেগরম ফুর্তি বাঙালির আর আছে?
এদ্দিনে বাঙালি উত্তমকুমারকে বাগে পেয়েছে। এবারে সে কল্পনার ডোরাকাটা স্কেল দেখিয়ে মহানায়ককে ওঠ-বস করাবে। যা বলবে, স্যাট করে, উত্তমও তাই হবেন। গো এজ ইউ লাইক, শুধু অন্যের আঙুল তিড়বিড়ানোয়। অবশ্যি, পঞ্চভূতে বিলীন হওয়ার পর। এ খেলায় তিনি বনাম তিনি। এ স্পোর্টসই তো সারাজীবন খেলে গিয়েছেন। ‘অমানুষ’ না ‘আনন্দ আশ্রম’, ‘নায়ক’ না ‘চিড়িয়াখানা’, ‘চাওয়া পাওয়া’ না ‘সপ্তপদী’– কোনটায় যে আপনি বেস্ট! ছায়া-ছবির সঙ্গে যুদ্ধ করে গাত্রে আপনার যা ব্যথা হয়েছিল, মাইরি! এখন তো ছায়াটুকুই, কায়া কেটে পড়েছে। বাঙালি ভূতগ্রস্ত বটে, বুকের খাঁচাও কি কম বড়! উত্তম-পিরিতিও প্রবল। ফলে বাঙালি যে অবতার অর্ডার করছে, উত্তমও সেই বেশে তৎক্ষণাৎ হাজির হচ্ছেন, যৌনতা ছাড়া এর চে’ বড় হাতেগরম ফুর্তি বাঙালির আর আছে?
মনে রাখবেন, যার কেউ নেই, তার এআই আছে। আর কিছু না হোক, মাথা চুলকে দু’চাট্টি চুলের সঙ্গে আইডিয়া যদি উপড়ে আসে। প্রেমিক বা প্রেমিকা ল্যাং মেরেছে, জলখাবারে লুচি-সাদা আলুর তরকারির বদলে দই-ওটস জুটেছে, ৫০০ টাকার নোট ভাঙিয়ে ২০ টাকার ফুচকা খাওয়া যায় না– এই বিষম সত্যখানাও জানা হয়ে গেছে, এমনকী, জানা হয়ে গেছে অন্ত্যমিল মানেই কবিতা নয়, পুরুষমাত্রই নারীলোভী নয়, মঙ্গলবারই শুধু জঙ্গল সাফ করার দিন নয়, নেটওয়ার্ক পুওর থাকলে নিজেকে ভিডিও কলে বিশ্রী দেখায়, সব পেরেকের ভাল ক্যালেন্ডার জোটে না, খবরের কাগজ পড়ে মনখারাপ করার মানেই হয় না– অতএব সেই বাঙালির কাছে এই কৃত্রিম উত্তমত্তা আমোদ দেবে না? সকালে সে বুকে ছ্যাঁদা মহিষাসুর সাজিয়ে দেখছে, বিকেলে সিক্স প্যাক ব্রনহীন প্রেমিক, রাতে আলো-আঁধারি ভরা গুঁফো দস্যু মোহন। দু’দিন পরে লণ্ঠন হাতে রানার, বর্শা হাতে নীরজ, চিপ-টিপ লাগিয়ে বিক্রম ল্যান্ডার, প্যান্টের ওপর জাঙিয়া পরা সুপারম্যান, ব্যাট হাতে গড় ১০০ ছুঁই ছুঁই ডন ব্র্যাডম্যান, ডাগর চোখে খুঁতওয়ালা ঝুলনের পুতুল, হিংসুটে-ভিতু-ভয়াল কৃষ্ণর মামা, যুগসন্ধিকালের কবি ও সাংবাদিক ঈশ্বরগুপ্ত, কর্মদক্ষ কলকাতা পুলিশ, অকর্মণ্য কোনও বড়বাবু, কুস্তিগির গোবর গোহ, এমনকী, কলকেতার আকাশে উড়ে বেড়ানো হুতোম পেঁচার ভূমিকা পেতেও মহানায়কের আর বেশি দেরি নেই বোধহয়।
‘একবার বলো উত্তমকুমার’– এই প্রবাদপ্রতিম ডায়লগখানার প্রত্যুত্তর যে ‘আমি তক্ষুনি হাজির করব’, এআই দেখিয়ে দিল। ফোঁড়াটা আসলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা না, বাঙালির অকারণ আমোদ। বাঙালির মতিস্থির নেই, সে প্রযুক্তি পেলেই একটু খুঁটে দেখতে চায়। ‘বিজ্ঞানের অভিশাপ না আশীর্বাদ’, রচনাখানা দারুণ লেখে, কারণ সে বেজায় কনফিউজড, পক্ষে-বিপক্ষে ১০টা করে পয়েন্ট নামিয়ে দ্যাখে, হেই যা, পরীক্ষা শেষ হতে আর ১৫ মিনিট বাকি! ফলে হায়েস্ট না পেলেও এ ব্যাপারে তার আক্কেলজ্ঞান মারাত্মক। কিন্তু এই বেতো ফুর্তির চোটে যে আইকনের হলমার্কটাই ক্ষয়ে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে বাঙালি ‘ইয়ে মানে সরি’-ও বলছে না। একেই বাঙালির ইতিহাস নেই, তায় জিয়ন্ত ইতিহাস নিয়ে ঘোঁট পাকাচ্ছে, কী বেয়াক্কেলে আক্ষুটে জাতি রে বাবা! যে উত্তম সারাজীবনেও ‘মাচো’ হলেন না, দরকার হল না চকচকে তথাকথিত ‘নিখুঁত’ হওয়ার, বাঙালি গ্রহণ করল সেই অপরূপ খুঁতসই নায়ককে। নিজের করে নিল, ঘরে, অন্তরে, মনের চিলেকোঠায় ভালবাসায় বিনি মাগনায় থাকতে দিল, দিনের পর দিন রিভাইস দিল সংলাপ আর সিনেমা, তাকানো ও হাসি, গান আর স্তব্ধতা– ভাবল, পরীক্ষায় তো পারিনি, কিন্তু প্রেমে মেরে দেব– এইসব কথা, এইসব গান, এইসব তাকানো। আসলে তো আমি খারাপ নই, উত্তম-ছাত্র।
আজ প্রযুক্তি এসে এতকালের সেই উত্তম-মূর্তিখানা গাঁইতি-শাবল দিয়ে ভেঙে দেবে? হ্যাঁ হ্যাঁ, এর পিছনেও গরুর ল্যাজের মতো অবধারিত আবেগ আছে। উত্তমের প্রতিই স্নেহ, ভালবাসা, ডাডাইজম, ডিকনস্ট্রাকশন, লাকা, সার্ত্রে, ফুকো– সব মিশে আছে। বুঝলুম, কিন্তু কোনটা আবেগ, আর কোনটা বেগড়বাঁই, সেটা বিচার করার ক্ষমতা হারালে চলবে? উত্তমের নব কৃত্রিম আইডেন্টিটি কী? গলায় কালো চেন, অ্যাডাম্স অ্যাপেল টনটনাচ্ছে, চোখের মণি নীল, চোয়ালের মাংস ছাঁটা, বুক ফোলা আর পেটঢোকা ইস্ত্রি করা চেহারা! যে চেহারাখানার জন্য তিনি ‘উত্তম’, যে চেহারা তাঁর ক্যাজুয়ালি স্বলালিত, যে পুং-লাবণ্যে বাঙালি পুরুষ-নারী-ট্রান্সজেন্ডার মুচ্ছো যায় যায়, তার এমন ভোলবদলের কী দরকার? যে-চেহারায় তিনি এত্ত সেলিব্রেটেড, তাকে একেবারে বিপরীত গোত্রে উত্তীর্ণ করা কেন? এআই স্বাগত, কিন্তু উত্তমের চিরায়ত আমেজ ও ইমেজটিকে সাবড়ে দিয়ে নয়।
অবশেষে যা বলার, বাঙালিই উদাস ও কালিদাস। এইবেলাই গুগলে সার্চ মারলে উত্তমকুমারের সঙ্গে কৃত্রিমকুমার মিলছে খানকতক। দিনে দিনে সে হয়তো সংখ্যায় বাড়বে। কী আর করা, এই খুচরো বিড়িবিড়ানিতে এ রোগের উপশম মিলবে না, জানি। বিজ্ঞানের অভিশাপ না আশীর্বাদের কনফিউশন ক্রমে বেড়ে চলুক। উত্তমকুমারকে এই কৃত্রিম বাজারে, আসুন, আমরা নিদেনপক্ষে জন্মদিনের আসল শুভেচ্ছা জানাই।