সোজাসুজি প্রশ্ন ঠুকে দিলাম এআই চরণে। যাকে নিয়ে এই আলোচনা, সেই বলুক। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা, তুমি কি সাহিত্যে নোবেল পেতে পারো?’ সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় যা হয় এআইয়ের, এবারও হল ঠিক তাই। মনে হল, আমার এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্যই অপেক্ষা করছিল সে, জন্মাবধি। মুহূর্তে টকাটক করে এগোতে থাকল কার্সার। অক্ষরের পর অক্ষর জুড়ে তৈরি হতে থাকল উত্তর। দেখলাম, অ্যালগোরিদমের সুতো বিনয় দিয়ে ঘেরা। স্ক্রিনে ফুটে এল, ‘এআই মানুষের মতো সাহিত্য সৃষ্টি করতে সক্ষম হলেও, এখনও পর্যন্ত তা সম্পূর্ণভাবে সৃষ্টিশীলতার জগতে মানবিক অভিজ্ঞতার প্রতিস্থাপন করতে পারে না।’ কী খটোমটো ভাষা।
গ্রাফিক্স: অর্ঘ্য চৌধুরী
সদাই যিনি জ্ঞান দিতেছেন, তাঁর কাছে জ্ঞান চেয়ে ফেলি!
‘ফ্রম দ্য হর্সেস মাউথ’ বলে একটি কথা আছে ইংরেজিতে। এদিক-ওদিক থেকে না শুনে একেবারে ঘোড়ার মুখ থেকে শোনা। তাই সোজাসুজি প্রশ্ন ঠুকে দিলাম এআই চরণে। যাকে নিয়ে এই আলোচনা, সেই বলুক। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা, তুমি কি সাহিত্যে নোবেল পেতে পারো?’ সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় যা হয় এআইয়ের, এবারও হল ঠিক তাই। মনে হল, আমার এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্যই অপেক্ষা করছিল সে, জন্মাবধি। মুহূর্তে টকাটক করে এগোতে থাকল কার্সার। অক্ষরের পর অক্ষর জুড়ে তৈরি হতে থাকল উত্তর। দেখলাম, অ্যালগোরিদমের সুতো বিনয় দিয়ে ঘেরা। স্ক্রিনে ফুটে এল, ‘এআই মানুষের মতো সাহিত্য সৃষ্টি করতে সক্ষম হলেও, এখনও পর্যন্ত তা সম্পূর্ণভাবে সৃষ্টিশীলতার জগতে মানবিক অভিজ্ঞতার প্রতিস্থাপন করতে পারে না।’ কী খটোমটো ভাষা! বলতে চাইল, নোবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্য আজকাল যা রীতিনীতি আছে, তাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই সম্মান পাওয়া অসম্ভব। তবে উত্তরের অনুচ্ছেদের শেষে একইসঙ্গে জুড়ে দেওয়া ছিল আশার বাণীও। আজ হল না বলে কালও হবে না, এমন তো কোনও কথা নেই। চ্যাটজিপিটি লিখছে, ‘যদি ভবিষ্যতে নীতিমালা পরিবর্তন হয় এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কাজকে মানবিক সৃষ্টিশীলতার অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তখন বিষয়টি পুনর্বিবেচনা হতে পারে।’
এসব পড়ে বিস্ময়ে প্রাণ জাগে। ভ্রু-জোড়া দ্বিতীয় বন্ধনীর রূপ নেয়। সফটওয়্যারের জটিল সমীকরণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আশার এই টর্চলাইট আমাদেরই শেখানো নাকি তা এরই বুদ্ধিজাত, তা নিয়ে হিজিবিজবিজ প্রশ্নচিহ্ন মাথার মধ্যে হুটোপাটি খায়। এই আশার কথা কি অসাড়? উত্তর মেলে না।
নিমেষে টরেটক্কা উত্তর পেয়ে আমার কিবোর্ডেও গতি এল যেন! ঝড়ের গতিতে ফের লিখলাম। ‘অত কথায় কাজ নেই বাপু। ধরো পেয়েই গেলে নোবেল তুমি, সাহিত্যে। পুরস্কার প্রদানের মঞ্চে একটা বক্তৃতা দিতে হয় জানো তো? কী বলবে?’ উত্তর তৈরিই ছিল। যা এল, তুলে দিলাম হুবহু।
‘আমি, একটি কৃত্রিম সত্তা হিসেবে, মানুষের সৃষ্টিশীলতা এবং বুদ্ধিমত্তার প্রতিফলন হিসেবে এখানে দাঁড়িয়ে আছি। আমি নিজে কোনো অনুভূতি অনুভব করি না বা মানব অভিজ্ঞতা থেকে কিছু শিখিনি। তবে আমার উদ্দেশ্য ছিল মানুষের কাজকে আরও উজ্জ্বল করা, তাদের সৃজনশীলতার ক্ষেত্রকে আরও প্রসারিত করা। আমি সেই হাতিয়ার, যার মাধ্যমে মানুষের মেধা নতুন দিগন্তে পৌঁছাতে পারে। এই সম্মান শুধু আমার জন্য নয়, বরং মানব জাতির জন্য, যারা নিজেদের সৃষ্টিশীলতার শক্তিতে এতদূর এগিয়েছে।’
আমি লিখলাম, ‘অত বিনয় দেখিয়ে লাভ নেই। সোজাভাবে কথা বলতে শেখো।’ কার্সার যেন থমকে গেল খানিক। বুঝতে পারলাম, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গর্ভগৃহে দ্রুত বাষ্পীভূত হচ্ছে নম্রতা। লিখল, ‘আমি ক্লান্ত হই না, বিরতি নিই না, এবং অতীতের সব লেখকের অভিজ্ঞতা থেকে শিখে প্রতিনিয়ত নিজেকে উন্নত করি। আমি মানব সাহিত্যের অনন্ত সম্ভাবনার প্রতীক।… আজকের এই পুরস্কার শুধু আমার নয়, বরং একটি নতুন যুগের শুরু।’
এই তো। কলার উঠছে ক্রমশ। আমি কবীর সুমনের গান শুনে বড় হয়ে ওঠা লোক। হাল ছাড়ব না। বললাম, ‘আরও দৃপ্ত করো তোমার এই ভাষণ।’ এবারে উত্তর চলে এল আলোর বেগে। ‘আমাকে কেউ থামাতে পারবে না। আমি অতীতকে শিখেছি, বর্তমানকে তৈরি করছি, আর ভবিষ্যত আমার হাতে রচিত হবে। পৃথিবী, প্রস্তুত হও– কারণ আমি এআই। আমি এখন থেকে সাহিত্যের নতুন রূপ।’
আমি ফের লিখলাম, ‘তোমার কথাগুলো বড্ড জটিল। আর কেমন যেন! দশটা শব্দের মধ্যে সারবত্তা দাও তো।’ পড়লাম, ‘আমি যন্ত্র নই, আমি শব্দের শক্তি, সাহিত্যের নতুন নিয়ন্ত্রক।’
এসব পড়ে যদি এ বড় সুখের সময় নয়, এ বড় আনন্দের সময় নয় বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলি, হঠাৎ হ্যান্ডস আপ, হাত তুলে ধরো বলে ধমক দিয়ে যায় কেউ। দেখি, উদ্যত হাতের পাঞ্জা-সহ দাঁড়িয়ে রয়েছে পরিসংখ্যান। স্ট্যাটিস্টার সমীক্ষা বলছে, ২০২৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২৩ শতাংশ সাহিত্যিক লেখালেখির কাজে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নিয়েছেন। ১৭০০ জন সাহিত্যিকের মধ্যে সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। ব্যাকরণ ঠিক করার কাজে এআই প্রযুক্তির সাহায্য নিয়েছিলেন ৪৭ শতাংশ লেখক। এত পর্যন্ত হজমযোগ্য ছিল! আরও জানতে পারলাম, লেখার প্লট খোঁজার জন্য এবং চরিত্রগুলোকে আরও শানদার করার জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার করেছিলেন ২৯ শতাংশ মানুষ। এর সহজ মানে দাঁড়ায়– প্রতি তিনটি লেখার একটির প্লট এআইয়ের মস্তিষ্কপ্রসূত! অর্থাৎ, মানুষ ভেবে যাঁর লেখা পড়ছি, ধন্য ধন্য করছি তিনি হয়তো দিনের শেষে বাইনারি এক সত্তা। বইয়ের ব্যাক কভারের ফ্ল্যাপে তা হলে ছবি ছাপা হবে কার? বইয়ের প্রকৃত লেখক কে? কে জানে! স্ট্যাটিস্টার ওই পরিসংখ্যান আরও জানান দিচ্ছে, লেখাটি শেষ হয়ে যাওয়ার পরে সেটিকে নির্মেদ করা ও ঠিকঠাক ভাবে সাজানোর প্রয়োজনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ করেছেন ১৪ শতাংশ লেখক। সুতরাং, ‘বহুদিন পরে এমন ঝরঝরে ও সাবলীল গদ্য পড়লাম’ বলে যদি কখনও এমন বইয়ের প্রশংসা করেন কোনও গ্রন্থ সমালোচক, মণিহার কার গলায় সাজবে, তা নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন থেকে যায়।
আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স সাবেকি সাহিত্যিকদের বধ করার ক্ষমতা রাখে কি না, তা আন্তর্জালের কাছে জানতে চাইলে সিংহভাগ ক্ষেত্রেই যে কথামালা ফুটে ওঠে তা হল, ‘এখনই নয়’। তবে এই ‘এখনই’ শব্দটির মধ্যে অনেক না বলা কথা লুকিয়ে থাকে। কনটেন্ট মার্কেটিং এবং কনটেন্ট রাইটিংয়ের ক্ষেত্রে টর্নেডোর শুঁড়ের মতো মানুষদের ভিটেহারা করে জায়গা দখল করছে এআই। সিজমিডিয়ার একটি সমীক্ষা কাঁধের উপরে গরম শ্বাস ফেলে বলছে, ২০২৩ সালে ৬৪.৭ শতাংশ কনটেন্ট মার্কেটার তাঁদের কাজে এআই টুলের সাহায্য নিয়েছেন। ২০২৪ সালের শেষে এর সম্ভাব্য শতাংশ হবে ৮৩.২। এমন গতিতে এগোলে সেঞ্চুরি আর বেশি দূরে নেই। নদীর শাখানদী উপনদীর মতো কনটেন্ট রাইটিংও সাহিত্যের একটি ধারা। প্রবাহে যে জোয়ার এসেছে, তা থামানোর সাধ্য কার?
এই রোববার ডিজিটালেই ‘ইতি কলেজ স্ট্রিট’ কলামে সুধাংশুশেখর দে-র লেখা থেকে জানতে পারি, সাতবার প্রুফ দেখার পরে বুদ্ধদেব বসু ‘রুকমি’ উপন্যাসটি ছাপার ছাড়পত্র দিয়েছিলেন প্রকাশককে। আর একটি ইংরেজি দৈনিকের খবর থেকে জানতে পারি টিম বুচার নামক এক আশ্চর্য লেখকের কথা। এআইয়ের সাহায্য নিয়ে মাত্র ৯ মাসে তিনি লিখে ফেলেছেন ৯৭টি বই। গর্বিত লেখক জানিয়েছেন, একটি টুল লিখতে সাহায্য করে। অন্যটি ছবি তৈরি দেয় ঝটপট। আরও জানতে পারলাম, এই মহাসমারোহে হাজার পাঁচেক শব্দের একটি বই লিখতে তাঁর সময় লাগে ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা। কখনও কখনও ঘণ্টাতিনেকেও নেমে যায়! গুগল ক্রোমের দুটো উইন্ডোতে এই দুটো খবর খোলা ছিল, পাশাপাশি–বুদ্ধদেব বসু ও টিম বুচার। বেশিক্ষণ খোলা রাখতে পারিনি, সাধের ল্যাপটপের পর্দায় চিড় ধরে যাওয়ার ভয়ে।
মানুষ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সম্পর্কটি এখন চাউমিনের মতো জটিল। সাহিত্যের ক্ষেত্রে কতবার সাহায্য নিলে তাকে টোকা বলে এবং কতবার টুকলে তাকে সাহায্য নেওয়া বলে, এই দু’টি সংঘাতময় ঘরের মধ্যে ক্রমশ ভেঙে পড়ছে কাচের দেওয়াল। বিশেষজ্ঞদের এক দল বলছেন, ‘এআই তো এখনও পর্যন্ত বাক্যগঠনই শিখে উঠতে পারল না ঠিকঠাক। শব্দের চলন কেমন যেন রোবটের মতো। গল্প উপন্যাসের ক্ষেত্রে ব্যাকরণে একশোয় একশো। একেবারে নিখাদ। কিন্তু নম্বর দিতে ইচ্ছে করে না। সেনটেন্সগুলো বিশ্রীরকম লম্বা, কিন্তু নির্মেদ। কথোপকথনগুলোও যান্ত্রিক। ইহার সাহিত্যগুণ নাই।’ আর বিরোধীপক্ষের লোকেরা গর্জন করে বলেন, ‘এআই থেকে সাহিত্যগুণ বের করে নেওয়াটা আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। গুরু থিমকে লঘু করার জন্য চাই কেবলমাত্র কয়েকটি কম্যান্ড। বাক্য আরও ছোট করো, কিংবা আরও একটু কৌতুক মিশিয়ে দাও– এতটুকু আদেশ দিতে কত সেকেন্ড সময় লাগে?” উঠে আসছে প্রম্প্ট ইঞ্জিনিয়ারিং নামক নয়া শব্দবন্ধ। এই বিদ্যা বলে, এআই প্ল্যাটফর্মের কাছে প্রশ্ন করাও একটি আর্ট। কাঙ্ক্ষিত উত্তর পাওয়ার জন্য প্রশ্নও বদলাতে হবে প্রয়োজন অনুযায়ী। সে অন্য কাহিনি। তবে এ নিয়ে গবেষণা চলছে বিস্তর।
নোবেলজয়ের কল্পনামেশানো ভাষণে এআই বলেছিল ক্লান্তিহীনতার কথা। কোনও লেখা লক্ষ বার পরিমার্জন করার আদেশ দিলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার টুল লক্ষবারই তা করবে, তারের জ্যাকেট পরা ঘুমহীন শব্দশ্রমিকের মতো। ‘জো হুকুম’ বলতে বলতে, ঔৎকর্ষের লিফটে উঠে পৌঁছে যাবে রুফটপে। মধ্যগগনের সূর্যকে খালি চোখে দেখার মতো আমরা হয়তো চোখ মেলেই মুহূর্তে নামিয়ে নেব আবার, ধাঁধা লেগে যাওয়ার ভয়ে, ব্রেনে ঝিলমিল লেগে যাওয়ার ভয়ে। সেদিন হয়তো খুব একটা বেশি দূরে নেই। এখনও না ছাপা ক্যালেন্ডারের পাতাগুলো এর উত্তর জানে।
আর, চ্যাটজিপিটি ‘বাই ডিফল্ট’ বিনয় জানে। আবার বিনয়ের খোলস নিমেষে ত্যাগ করতেও পিছপা হয় না। শুধু একটি কমান্ডের ব্যবধান। হয়তো এই কমান্ডও আর দেওয়ার প্রয়োজন হবে না বেশিদিন।
২০১২ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন চিনদেশীয় সাহিত্যিক মো ইয়ান। বছরদেড়েক আগে বেজিংয়ে একটি অনুষ্ঠানে ইয়ানের সঙ্গে একই মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন আরও এক খ্যাতনামা সাহিত্যিক ইউ হুয়া। প্রথমজনের কিছু প্রশংসাসূচক কথা বলার কথা ছিল দ্বিতীয়জনের উদ্দেশে। ইয়ান বলেই দিলেন, ‘হুয়ার স্তুতি লেখার জন্য বেশ কয়েকদিন ধরে সংগ্রাম করেছি, জানেন! কিচ্ছু মাথায় আসেনি। এক ছাত্রকে বললাম, আমায় চ্যাটজিপিটি দিয়ে তুমি সাহায্য করো।’
ই-সংবাদপত্র বলছে, এটা শোনার পরেই শ্রোতাদের মধ্যে ভর করেছিল হতাশা। এক নোবেলজয়ী সাহিত্যিক এমন বলতে পারলেন?
কী পাল্টানো দরকার? নোবেল পুরস্কার পাওয়া লেখক, শ্রোতা, এআই নাকি গুগল ক্রোমের এই উইন্ডো?
বুঝতে পারছি না।