বিলেতে কলকাত্তাইয়া খাবারে রসনাতৃপ্তি মোক্ষ হলে, ‘চৌরঙ্গী’ ছাড়া গতি নেই বিশেষ। আর নিছক পোলাও-কালিয়া, মুর্গি-মাটনের জিভে জল আনা আস্বাদ নয়, দোসর হিসেবে যে বাঙালিয়ানা ঘিরে থাকে বিলেতের ‘চৌরঙ্গী’-কে, সহস্র কাঞ্চনমূল্যে তার মাপজোক হয় না! বলুন না, মুগের ডাল-ঝুরি আলুভাজা খেতে-খেতে ক্যানভাসে সত্যজিতের প্রতিমূর্তি দেখতে কার না ভাল লাগে? কার না ভাল লাগে ছবিতে কলকাতার চৌরঙ্গীর মোড় খুঁজে পেতে? কার না ভাল লাগে, বিভুঁইয়ে কচি পাঁঠা সহযোগে কুমোরটুলি-ভিক্টোরিয়া-কফি হাউজের চিত্র-বেষ্টনীর ‘সাত পাকে’ বাঁধা পড়তে?
ওই যে, ওখানে তিনি বসে। ফিটফাট, কেতাদুরস্ত। ওঁকে চেনে সবাই। স্যাটা বোসকে আর কে না চেনে? বেশ শুনতে পাচ্ছি পিছনের লাগোয়া বাসরাস্তায় ঘোড়ার গাড়ির টুংটাং। কানে আসছে। চোখ দেখছে। সে এখন দেখছে হোটেলে বসনকারী এক দুঃখী রূপসীকে, নাম যাঁর করবী গুহ হলেও হতে পারে! আচ্ছা, ম্যানেজারের চেয়ারে বসে যিনি, কী যেন নাম তাঁর? আরে, যাঁর নামে পার্ক স্ট্রিটে খাসা রেস্তরাঁ আছে! অ্যায়, মনে পড়েছে। মার্কো পোলো, মার্কো পোলো!
লন্ডনের অভিজাত মেফেয়ার রোডের তোফা বাঙালি রেস্তরাঁর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে এ সমস্ত আগডুম-বাগডুম ভাবা এতটুকু দোষের নয়। কী করব বলুন, একে প্রাণের শহর কলকাতা ছেড়ে বিলেতে পড়তে আসা বাঙালি ছোকরা, তায় নাকের সামনে রেস্তরাঁ নামের এক আস্ত গল্পের বই। সেই কবে পড়েছি, ক্লাস টেনে পড়ার বইয়ের ফাঁকে রেখে, মুগ্ধতার রেশ যার এখনও গেল না। গেলে মনে পড়ত নাকি একগাদা এত নাম, চোখের সামনে স্রেফ একখানা নাম দেখে?
চৌরঙ্গী!
ভাবতে ভাবতে কখন যে হাত গুগল সার্চ দিয়ে বসেছে, টের পাইনি। দেখলাম, লন্ডনের ‘চৌরঙ্গী’ থেকে কলকাতার ‘চৌরঙ্গী’-র দূরত্ব দেখাচ্ছে প্রায় আট হাজার কিলোমিটার! বিভ্রম কাটল, মনখারাপও হল ঈষৎ। তবু কেন কে জানে, কলকাতার সে প্রাণকেন্দ্রের ক’বিঘা জমির সঙ্গে আত্মার টান এই মার্বেল আর্চ, অতিকায় মার্বেল সৌধের মধ্যে যেন খুঁজে পেলাম, এই প্রবাসে। লন্ডনের রাজপথে প্রথম বাঙালি রেস্তরাঁয়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………
বিরিয়ানি জিভে দিলে মনে হয়, প্রকৃত চৌরঙ্গী চত্বরের ‘আলিয়া’ কিংবা ‘আমিনিয়া’-য় বসে আছি! আর হ্যাঁ, বিরিয়ানিতেও এঁরা বড়সড় একখানা আলু দেন, ওয়াজেদ আলি শাহ-র রেওয়াজ রীতি অনুসরণ করে। আর মেনুকার্ডে কী লেখা জানেন? ‘ক্যালকাটা চিকেন বিরিয়ানি’– যে বিরিয়ানি মেনুতেই কলকাতা-কলকাতা, তার স্বাদ বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যায় বইকি!
………………………………………………………………………………………………………………………………………
না, এমন নয় যে বিলেতে বাঙালি ভোজবিলাসের আস্তানা আর নেই। আছে। একাধিক আছে। হোয়াইট চ্যাপেল যান। ইলিশ মাছের পেটি থেকে কচু শাক– সব পাবেন। আছে ব্রিক লেন। কিন্তু সমস্ত বাংলাদেশের খাবার, ঝোলের বাটিতে লেগে পদ্মাপারের স্বাদ। সেখানে দেওয়াল থেকে দুর্গাপুজোর ছবিও ঝোলে না। অগত্যা বিলেতে কলকাত্তাইয়া খাবারে রসনাতৃপ্তি মোক্ষ হলে, ‘চৌরঙ্গী’ ছাড়া গতি নেই বিশেষ। আর নিছক পোলাও-কালিয়া, মুর্গি-মাটনের জিভে জল আনা আস্বাদ নয়, দোসর হিসেবে যে বাঙালিয়ানা ঘিরে থাকে বিলেতের ‘চৌরঙ্গী’-কে, সহস্র কাঞ্চনমূল্যে তার মাপজোক হয় না! বলুন না, মুগের ডাল-ঝুরি আলুভাজা খেতে-খেতে ক্যানভাসে সত্যজিতের প্রতিমূর্তি দেখতে কার না ভাল লাগে? কার না ভাল লাগে ছবিতে কলকাতার চৌরঙ্গীর মোড় খুঁজে পেতে? কার না ভাল লাগে, বিভুঁইয়ে কচি পাঁঠা সহযোগে কুমোরটুলি-ভিক্টোরিয়া-কফি হাউজের চিত্র-বেষ্টনীর ‘সাত পাকে’ বাঁধা পড়তে? তাছাড়া এ ‘চৌরঙ্গী’-র সিঁড়িগুলোও বড় ‘সৃষ্টিছাড়া’, সব উত্তর কলকাতার বনেদি বাড়ির আদলে, বড় মন কেমন করা। রেস্তরাঁ জুড়ে অনেক ‘বন্ধু-বান্ধব’ও আছে যার। বারান্দার রেলিং। জানালার খড়খড়ি। যাদের দেখে দীর্ঘশ্বাসের দখিনা বাতাস বয়। আলেয়ার মতো যার ডাকে, আয়, আয়, আয়…।
খাবারও বেয়াড়া রকমের ভাল। বিরিয়ানি জিভে দিলে মনে হয়, প্রকৃত চৌরঙ্গী চত্বরের ‘আলিয়া’ কিংবা ‘আমিনিয়া’-য় বসে আছি! আর হ্যাঁ, বিরিয়ানিতেও এঁরা বড়সড় একখানা আলু দেন, ওয়াজেদ আলি শাহ-র রেওয়াজ রীতি অনুসরণ করে। আর মেনুকার্ডে কী লেখা জানেন? ‘ক্যালকাটা চিকেন বিরিয়ানি’– যে বিরিয়ানি মেনুতেই কলকাতা-কলকাতা, তার স্বাদ বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যায় বইকি! বোঁ করে চোখ পড়ে যায় কোথায় কোথায় তবে কলকাতা কিংবা কলকাতার অনুষঙ্গ আছে! দেখি ‘ক্যালকাটা ফিস ফ্রাই’, অনতিদূরেই, চোখ অল্প নামালেই ‘নিজামস মালাই টিক্কা’! টাকরায় চিংড়ি মালাইকারি ছেড়ে দিলেও ধর্মতলা কেসি দাশের লাগোয়া ‘ভজহরি মান্না’র খাবারের নামে ভোজবাজি মালুম হয় দিব্য। নামেই মেনু কার্ড, এ আদতে খাবারের পাসপোর্ট– প্রবাসীর ঘরে ফেরা!
………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: ভারতীয় কাব্যপতাকায় লেখা থাক: শ্রীমধুসূদন
………………………………………………………………………………………………………………………………………
আসলে শুধু বাঙালি খানাপিনাতেই বিলেতের ‘চৌরঙ্গী’-কে সীমাবদ্ধ রাখতে চাননি রেস্তঁরা মালিক অঞ্জন চট্টোপাধ্যায়। মোগলাই, চিনেকেও অক্লেশে জুড়ে দিয়েছেন, যাতে এ-স্থানে এলে খাদ্যরসিক বাঙালির পার্ক স্ট্রিট টু পার্ক সার্কাস, এক লপ্তে ঘোরা হয়ে যায়! যার যা দরকার, সে তা নেবে। যার যা উদ্দেশ্য সে তা বুঝে নেবে। ভেটকি পাতুরি কাঁটা চামচ দিয়ে এখন সন্তর্পণে ছাড়াচ্ছে যারা, এই এখন আমপোড়া শরবত খেতে-খেতে দেখছি যাঁদের, বাঙালির দুই প্রিয় শংকরের একজনকেও চেনার দায় তাঁদের নেই। বিভূতিভূষণের সৃষ্টিকে না। মণিশংকরকেও না। ঠিক আছে। কিন্তু সে বাসনা আছে যাদের, উদরের সঙ্গে হৃদয়ের ক্ষুধা নিবৃত্ত করতে এসেছে যারা, তারাও পাবে ঠিক। ‘বেশক্’ পাবে। স্যাটা বোস থেকে, করবী গুহ, মার্কো পোলো– প্রত্যেককে দেখতে পাবে, পারবে অনুভব করতে। আর সময় যাবে যত, দৃষ্টি ঝাপসা হবে তত। হোটেলের নামও শেষে বদলে যাবে বেমালুম!
‘চৌরঙ্গী’ আর থাকবে না, চোখ দেখেও তাকে দেখবে না, ক্রমশ স্পষ্ট হবে এক কল্প-সৌধ, বাস্তবের আদলে চৌরঙ্গীর এক মায়া পান্থনিবাস, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘হোটেল’। এক মোগল বাদশাহর নামে যার নাম।
শাহজাহান!