কামু শাসিয়ে বলেছেন, উন্নাসিকতাই দার্শনিক সার্ত্রের সর্বনাশ করেছে। আর কামুর সর্বনাশ কে করেছে? কেন, সার্ত্রের প্রেমিকা, সহবাসিনী, সহমর্মিনী সিমন দ্য বভোয়া, যাঁর প্রেমে কিংবা শরীরে পড়েছেন বয়সে অনেক ছোট কামু! আর সার্ত্রের ঘুসি খেয়েছেন নাকে!
অবশেষে Les Deux Magots– প্যারিসের সবথেকে আইকনিক লিটারারি ক্যাফে! প্যারিসের চিঠি এইখানেই শেষ হোক। পরপর দু’টি সন্ধে কাটালাম ১৮৮৫ সালে জন্মানো এই ফরাসি ক্যাফেতে। প্যারিসের সব ক্যাফেই সুরার উৎসব, কোহলের উদ্যাপন। কিন্তু ম্যাগট্স (ফরাশি উচ্চারণ ‘মাঘো’-র কাছাকাছি) ব্রাসেরি (brasserie)-তে সুরার সঙ্গে, কোহল আর কল্লোলের সঙ্গে যুগে যুগে মিশে আছে ইউরোপের ইন্টেলেক্ট। দার্শনিক থেকে সাহিত্যিক, শিল্পী থেকে বিজ্ঞানী, সুরস্রষ্টা থেকে ফ্যাশনদ্রষ্টা– সব্বার ভিড় হয়েছে এখানে। এই অনন্য ক্যাফের প্রাণ অন্দরমহল থেকে স্তরে-স্তরে উপচে পড়ে প্যারিসের সুরম্য ফুটপাতে। সে এক অবিস্মরণীয় দৃশ্য!
‘ম্যাগট্স’-এর অন্দরমহলে যে রমণীয় কোণটি ছিল অ্যালব্যের কামুর ভাবনার কোণ এবং নারীচর্চার নিরালা, তারই একটু দূরে, লাল সুরা নিয়ে বসেছি আমি। চোখের সামনে ফুটে উঠছেন সেই নোবেলজয়ী ফরাসি লেখক। কী সুদর্শন, সন্দীপ্ত, অবয়ব! কী বোধোজ্বল দৃষ্টি! তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বলছেন, There is the good and the bad, the great and the low, the just and the unjust. এই হল জীবন। এই হল অস্তিত্বের অন্তরবার্তা। দিব্যি কেটে বলছি তোমাকে, কিছুতেই এর কোনও পরিবর্তন করতে পারবে না!
ঠিক এই মুহূর্তে ঢুকলেন কখনও আলব্যের কামুর বন্ধু, কখনও তীব্র সমালোচক, দার্শনিক ও সাহিত্যিক জঁ পল সার্ত্রে, যিনি নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন ‘বুর্জোয়া’ পুরস্কার বলে– কী বলবেন তিনি এবার? তিনি সরাসরি তাকালেন কামুর দিকে আর বললেন তাঁর সেইসব থেকে প্রসিদ্ধ উজ্জ্বল উক্তি : ‘Hell is other people!’ অন্যরা নরক! সার্ত্রের অস্তিত্ববাদের গোড়ার কথা না কি এটাই। তর্ক-বিতর্ক আজও চলছে। কামু তো শাসিয়ে বলেছেন, এই উন্নাসিকতাই দার্শনিক সার্ত্রের সর্বনাশ করেছে। আর কামুর সর্বনাশ কে করেছে? কেন, সার্ত্রের প্রেমিকা, সহবাসিনী, সহমর্মিনী সিমন দ্য বভোয়া, যাঁর প্রেমে কিংবা শরীরে পড়েছেন বয়সে অনেক ছোট কামু! আর সার্ত্রের ঘুসি খেয়েছেন নাকে! থাক থাক, এইসব রসের স্ক্যান্ডাল। এইমাত্র ‘ম্যাগটস’-এ এসে পৌঁছল এই খবর, প্যারিসের পথে গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন বছর ৪০-এর আলব্যের কামু। ‘ম্যাগট্স’-এ কারও মুখে শব্দ নেই। পাশাপাশি পাথর হয়ে বসে সার্ত্রে ও সিমন। সিমন হঠাৎ বললেন, প্যারিসে সূর্য উঠেছে। অথচ কামু নেই। ভাবতে পারছি না। সার্ত্রে আলতো হাত রাখলেন সিমন-এর পিঠে। বললেন, গাড়ির মধ্যে পাওয়া গেছে কামুর শেষ উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি। কে বলল, কামু নেই?
–কী নাম রেখেছে উপন্যাসের? জিজ্ঞেস করলেন সিমন।
–দ্য লাস্ট ম্যান, উত্তর দিলেন সার্ত্রে।
–শেষ করে গেছে? আমাকে বলেছিল, লিখছে।
–না, শেষ করতে পারেনি। তবে অনেকটা লিখেছে। প্রকাশিত হবে।
–জানো, এই উপন্যাসের বিষয়? প্রশ্ন করেন সিমন।
–না তো! জানি না। তুমি? তুমি জানো?
–জানি। আমাকে চার-পাঁচ দিন আগে এই ক্যাফেতে বসেই বলল, “আমার ‘দ্য লাস্ট ম্যান’ উপন্যাসের বিষয়, আমারই জীবন। সেই জীবনে তুমিও থাকবে সিমন।”
প্যারিসে নিঃসঙ্গ জীবন বেছে নিয়েছিলেন সেলিব্রিটি লেখক মিলান কুন্দেরা। স্ত্রী ভেরাকে নিয়ে প্রায়ই আসতেন এই ক্যাফেতে। তবে গত ২০-২৫ বছর আর তেমন আসেননি। ভিড় এড়িয়ে চলেন। উনি এলে বড্ড ভিড় হয়ে যায়। তাই হয়তো আসেন না। উনি কোন টেবিলে বসতে পছন্দ করতেন? ওই যে টেবিল ল্যাম্প জ্বালা ছোট্ট টেবিল, শুনেছি ওখানেই বসতেন মিলান কুন্দেরা। শুনেছি, লিখতেনও বসে। আরও একটা অদ্ভুত দুঃখের কথা শুনেছি!
–অদ্ভুত দুঃখ?
–প্রায়ই বলতেন, হারানো চিঠিগুলোর সঙ্গে নিজেকেও হারিয়ে ফেলেছেন। সেইসব চিঠি না কি পড়ে আছে চেকোশ্লোভাকিয়ায়। যেখান থেকে কমিউনিস্টদের অত্যাচারে পালিয়ে এসেছিলেন তিনি। কমিউনিস্টরা ওঁকে নাকি বলেছিল, তোমার অতীতটা আমাদের বিক্রি করে দাও। তার বদলে একটা চমৎকার ভবিষ্যৎ দেব আমরা। উনি অতীত বিক্রি করতে চাননি। তাই প্যারিসে চলে এসে ফ্রেঞ্চ ভাষায় লিখতে শুরু করেন। ওঁর নিজের ভাষা ‘চেক’ ত্যাগ করলেন। আর অনেক প্রেমের চিঠি– সব ফেলে আসতে বাধ্য হন। প্রায়ই নাকি বলতেন, ওই টেবিল ল্যাম্প জ্বালা টেবিলে বসে, আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি। নিজেকে কোনও দিন আর খুঁজে পাব না। একেবারে চুপচাপ হয়ে যাচ্ছিলেন ক্রমশ। নিজের মধ্যে ডুবে থাকতেন। একা বসে ওয়াইন আর চিজ খেতেন।
অনেক অনেক বছর আগের কথা। এই ক্যাফের তখনও এত নামডাক হয়নি। তিনিও তখন খুব ইয়ং। আমরা কেউ দেখিনি তাঁকে। তবে তাঁর অনেক গল্প শুনেছি। তিনি প্রায়ই আসতেন এখানে ‘শেক্সপিয়র অ্যান্ড কম্পানি’ থেকে বই কিনে এখানে বসে পড়তেন। আর বোতল-বোতল ওয়াইন খেতেন।
–কী নাম তাঁর?
–আমেরিকান লেখক। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে।
–তিনি বসতেন কোথায়?
–সে তো কবেকার কথা। একশো বছর আগের ব্যাপার। তবে হয়তো বসতেন যেখানে ওঁর ছবি রয়েছে, তারই কাছাকাছি কোথাও।
–উনি কি এখানে বসে লিখতেন?
–হ্যাঁ হ্যাঁ, গল্প লিখতেন। দুপুরবেলা। আর তখন ডাবল রাম খেতেন, শুনেছি। এক বোতল রাম একাই শেষ করতেন!
–জানি। এই কারণেই ষাট বছর বয়সে, তাঁর লিভারটা পেট থেকে জোঁকের মতো ঠেলে বেরিয়ে উঁচু হয়ে উঠেছিল। শার্টের ভিতর থেকে নাকি দেখা যেত! নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পরেও বাষট্টি বছর বয়সে আত্মহত্যা করলেন হেমিংওয়ে।
তরুণ ওয়েটারটি অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, শুনেছি প্যারিসের ওপর তিনি একটা বই লিখেছেন।
–দ্য বেস্ট বুক অন প্যারিস, বললাম আমি। নাম, ‘আ মুভেবল ফিস্ট!’
–কী বলেছেন প্যারিস সম্পর্কে? জানতে চায় যুবক ক্যাফেকর্মী।
–যতটুকু মনে পড়ছে, বলছি। বুঝিয়ে বলতে পারব না কিন্তু।
যুবক হাসে।
আমি বলি, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে তাঁর বইয়ে এক জায়গায় লিখেছেন, Paris is a very old city and we were young and nothing was simple there, not even poverty, nor sudden money, nor the moonlight nor the breathing of someone who lay beside you in the moonlight.
বুঝলে কিছু?
যুবক হাসে।
আমি বাংলায় ভাবি টেবিলল্যাম্প-জ্বালা টেবিলে বসে:
প্যারিস বড় পুরনো শহর। আমরা ছিলাম তরুণ। কোনও কিছুই সরল সোজা ছিল না প্যারিসে। এমনকী, দারিদ্রও। কিংবা হঠাৎ অর্থাগম, তাও নয় সরল। চাঁদের আলোও সরল সোজা নয়। যে-মানুষটি রাত্রে চাঁদের আলোয় তোমার পাশে শুয়ে শ্বাস নিচ্ছে সেই শ্বাস সহজ নয়, সহজ নয়।
(শেষ)