ডালের পাতবদল, থুড়ি, স্বাদবদল ঘটেছে নানা সময়ে। মহাভারত, মুঘল আমল হয়ে আজকের ভারত, এমনকী, বিশ্বায়নের জেরে অভারতীয়রাও দিব্যি ডাল প্রেমমত্ত।
বাঙালির ঘরে ঘরে ‘ডাল-ভাত’-এর কদর কে না জানে! আসমুদ্রহিমাচল বাঙালি হেঁশেলে ভোরে উঠেই প্রেসারে সিটি দিয়ে আগেভাগে প্রস্তুতি নেয় একটা বিশেষ পরিপাটি ডালের। আজ পেঁয়াজ দিয়ে মুসুরের ডাল তো কাল ঘন ঘন করে ভাজা মুগ। পরশু লাউ দিয়ে কাঁচা মুগ, তো তরশু হিং দিয়ে অড়হর। একদিন আলুপোস্তর সঙ্গতে আদা-মৌরিবাটা দিয়ে বিউলি, তো পরের দিন পেঁপে দিয়ে মটর ডাল। বাঙালির রান্নাঘরে এইরকম ভাবেই ডাল-পালা বাড়ে। তবে শুধু বাঙালি নয়, ভারতবাসীদের খাদ্য তালিকাতেও ডালের একটা নিজস্ব জায়গা রয়েছে। স্থান বিশেষে এই ডাল তৈরি করার পদ্ধতি বিভিন্ন রকম। সাধারণত ফারাকটা মশলায়।
ইতিহাস বলছে, ডালের আবির্ভাব সেই হরপ্পা সভ্যতায়। প্রাচীন কালে ডাল পরিবেশন করা হত অভিজাত একটি পদ হিসাবে। ৩০৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের বিয়ের সময় পরিবেশন করা হয়েছিল ঘুগনি ডাল– এখন যা জনপ্রিয় একটি ‘পথখাদ্য’ হয়ে উঠেছে। ‘পাঁচমেল’ কিংবা ‘পঞ্চরত্ন’ ডাল এসেছে মেওয়ারের রাজ পরিবার থেকে। তবে জানা যায়, শাহজাহানও এই ডাল খেতে বেশ ভালবাসতেন। যদিও তাঁর জন্য বানানো হত ‘শাহি পঞ্চরত্ন ডাল’। এই ডাল আদ্যন্ত নিরামিষভোজী ঔরঙ্গজেবেরও বেশ পছন্দ ছিল। মজার কথা, এই পঞ্চরত্ন ডালের উল্লেখ পাওয়া যায় মহাভারতেও। যেখানে ভীম খুব অল্প আঁচে মাটির পাত্রে পঞ্চরত্ন ডাল বানাচ্ছেন। এবং ডালের ওপরে খুব যত্ন করে এক চামচ ঘি ঢেলে দিচ্ছেন। মহাভারতের আদিপর্বে বশিষ্ঠ কর্তৃক নন্দিনী নামক কামধেনুর কাছে ঋষি বিশ্বামিত্রের আহারের জন্য যে অন্ন-সূপ-মিষ্টান্ন-মদ্যের প্রার্থনা রয়েছে, সেখানে এই ‘সূপ’ বা ‘দাইল’ যে আমাদের ডালের অনুরূপ, তা বুঝতে বাকি থাকে না। এই হল ডালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
ডাল দিয়ে মিষ্টির সংখ্যাও কিছু কম নয়। যেমন মুগের ডাল দিয়ে মুগের লাড্ডু, ছোলার ডালের বরফি। রসগোল্লা, সন্দেশের মতো আভিজাত্য না-থাকলেও ‘মিষ্টি’ বলে দিব্যি চালানো যায়। ডালের একটি ভিন্ন পদ হল ডাল মাখানি। প্রথম ডাল মাখানির সন্ধান পেয়েছিলাম দিল্লির এক পথ-রেস্তোরাঁয়। উত্তর থেকে দক্ষিণ ভারত, কলকাতার কেটারার, নামী-অনামী মোগলাই রেস্তোরাঁ অথবা পাঞ্জাবি ধাবা– ডাল মাখানির রমরমা এখন সর্বত্র। বিশ্বায়নের দৌলতে এখন অভারতীয়রাও পরিচিত এই সুস্বাদু ভারতীয় ডালটির সঙ্গে। বস্তুত, সাগরপারের চাল-ডাল মিশিয়ে বিদেশি ‘কেডগ্রি’-ও আদপে আমাদেরই খিচুড়ি। ভিক্টোরীয় যুগে দেশে ফেরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজ অফিসাররা খিচুড়ি বানাতে শিখে ইংল্যান্ডের ডাইনিং টেবিলে হাজির করেছিল তাকে।
ইবন বতুতার ভ্রমণকথায় চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ভারতে মুগ ডাল আর চাল দিয়ে ‘খিশ্রি’ তৈরির কথা আছে। তাঁর ঠিক পরই এদেশে আসা রুশ পর্যটক নিকিতিন-এর লেখাতেও চালে-ডালে খিচুড়ির প্রসঙ্গ মেলে। আর মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গির থেকে আকবরের খিচুড়িপ্রীতিও আমাদের জানা। হুমায়ুন যখন শের শাহ-এর তাড়া খেয়ে পারস্যে পৌঁছলেন, শের শাহকে তিনি নেমন্তন্ন করে এমন সুস্বাদু ভারতীয় খিচুড়ি খাইয়েছিলেন যে, শের শাহ মোহিত হয়ে হুমায়ুনকে পারস্যে আশ্রয় দেবেন ঠিক করেন।
আকবর-বীরবলের গপ্পে আছে, বীরবল খিচুড়ি রান্না করে আকবরকে নীতিকথা শেখাচ্ছেন। ফলে একথা বললে অত্যুক্তি হয় না যে, মুঘল বাদশাদের খিচুড়ি-প্রীতি বংশানুক্রমিক। আবুল ফজলও তাঁর ‘আইন-ই-আকবরি’-তে সাত রকম খিচুড়ির রেসিপি লিখেছেন। তবে ভারতে ডালের ব্যবহার কিন্তু মুঘল যুগের আগে থেকেই। ভারতীয় খাদ্যাভাসের সঙ্গে পারসিক, আরবিক ও তুর্কি খাদ্যাভাসের মেলবন্ধন ঘটেছিল মুঘল আমলে। শেরশাহ, শাহজাহান এবং ঔরঙ্গজেবের হাতে তা পরিপূর্ণতা পায় মোগলাই খাদ্যশৈলী হিসেবে। ভারতের বিভিন্ন এলাকায় এই মোগলাই রন্ধনশৈলী বিবর্তিত হয়েছে ৷ ঢাকা ও দিল্লির হালিম বা হিন্দিতে ডাল-গোস্ত বলা হয় যাকে, সেখানেও মাংসের সঙ্গে ডালের মাখোমাখো সখ্য ঘটেছিল।
অনেকটা ঘি দেওয়া, থকথকে এই ডাল রুটি-পরোটার সঙ্গে মুঘলরা খেতেন। যে কোনও পুজোর উপাচারে পঞ্চশস্য দেওয়ার চল সেই গুপ্ত ও মৌর্য যুগ থেকেই। পঞ্চশস্যের মধ্যে মাসকলাই হল ডাল। এখন যে ডাল মাখানি আমরা খাই, তার মধ্যে ছোলা, মটর, কাবুলি চানা, খোসা শুদ্ধ গোটা মুসুর, মাসকলাই, মুগ কলাই আর রাজমা থাকে। তা এই সপ্তরথীকে একত্রে আগের দিন রাতে ভিজিয়ে রেখে সেদ্ধ করে গলে ক্ষীর হওয়ার রসায়নেই মাখোমাখো হবে ডাল। আর বাদশাহি রীতি অনুসারে সিদ্ধ করার সময় এই ডালের মধ্যে গোটা বড় এলাচ, ছোট এলাচ, লবঙ্গ, দারচিনি, তেজপাতা, গোটা রসুন আর গোটা আদার ডুমো দেওয়ার রেওয়াজ সে যুগ থেকেই। ভারী হাতা দিয়ে কুকারের মধ্যেই ঘেঁটে দিলে শাহি গন্ধে ভরপুর হয় এই ডালশস্য। তখন দমে সেদ্ধ করা হত, এখন প্রেশারকুকারে।
বাঙালির চিরাচরিত এই ডাল-ভাতের গপ্প থেকে একটু স্বাদ বদলের জন্য এই ডাল চরিত মানসের অবতারণা। কিন্তু ‘চিরাচরিত’, ‘একঘেয়ে’– এসব বলে লাভ নেই। দুপুর কিংবা রাতে একবাটি ডাল যখন দোসর হিসাবে পায় আলুভাজা, বেগুন ভাজা অথবা নিদেনপক্ষে একটু আলুসিদ্ধ আর ঘি, ডাল তখন ‘ডার্লিং’ হয়ে ওঠে। ডালই বলতে পারে, আমাদের বহু শাখা আছে।
তবে সব মধুরেরই শেষ না হয়েও শেষ হয় কখনও কখনও। দিনু ঠাকুরের জীবনের শেষভাগে একসময় এসে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় তিনি ১৯৩৩ সালে তাঁর সাধের শান্তিনিকেতন, সঙ্গীত ভবন ও সর্বোপরি রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্য ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন।