কীভাবে শুনব আমরা রবীন্দ্রনাথের গান? কীভাবে কেমন পরিবেশে পরিবেশন করা হবে রবীন্দ্র-সংগীত? অস্বীকার করার উপায় নেই রবীন্দ্র-সংগীত শোনার ও পরিবেশনের সঙ্গে ‘শুচিশুদ্ধ’ আবহের যোগ তৈরি হয়েছে। এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই, সেই শুচিশুদ্ধতার সঙ্গে দমবদ্ধত্বের যোগ তৈরি হয়েছে ক্রমশ। ‘রাবীন্দ্রিক’ বলে তৈরি হয়েছে একখানা ছাঁচ– রবীন্দ্রকবিতার, রবীন্দ্র-সংগীতের, রবীন্দ্রনৃত্যের। শম্ভু মিত্রের বহুরূপীর ‘রক্তকরবী’ দেখে উৎপল দত্ত যে সমালোচনা লিখেছিলেন, তাতে শুচিশুদ্ধ রাবীন্দ্রিক দমবদ্ধতা ভেঙে দেওয়ার জন্য শম্ভু মিত্রকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথও কি এই রাবীন্দ্রিক দমবদ্ধতার বিরোধিতা নিজের মতো করে করেননি?
শিল্পী বিনোদবিহারী ছাত্র সত্যজিৎকে সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন কীভাবে গুরুদেব এসে তাঁদেরকে নন্দলালের শিল্পকলার ছাঁচ ভাঙার জন্য উসকে দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘তিনসঙ্গী’র গল্পগুলিতে তাঁর নিজের আগেকার বিষয় ও ভাষাভঙ্গিকে চুরমার করে দিলেন। ‘চেয়ে দেখে ঘরের মধ্যে নীলা। রাত কাপড় পরা, পাতলা সিল্কের শেমিজ। ও চমকে চৌকি থেকে উঠে পড়তে যাচ্ছিল। নীলা এসে ওর কোলের উপর বসে গলা জড়িয়ে ধরল। রেবতীর সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল, বুক উঠতে পড়তে লাগল প্রবলবেগে।’ এভাবে যৌন আকর্ষণসম্পন্না (seductive) রমণীর বিবরণ যে রবীন্দ্রনাথ দিতে পারেন, তা কি ‘কল্লোল’ পত্রিকার একদা তরুণ লেখকরা কোনও দিন ভাবতে পেরেছিলেন? গান শোনার ও পরিবেশনের ক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথের মত একেবারে ছাঁচভাঙা। ১৯৩৪ সালের ডিসেম্বর মাসে নিখিলবঙ্গ সংগীত সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘প্রাণের যে ধর্ম্ম সঙ্গীতেরও হবে সেই ধর্ম্ম। … তানসেন কি গেয়েছেন জানিনা কিন্তু আজ তাঁর গানে কেউ যদি পুলকিত হন, তবে বলব তিনি এখন জন্মেছেন কেন? … আমি বলব, আমি কাউকে জানি না, কাউকে মানি না …।’ বোঝা যাচ্ছে শুচিতার গারদে, স্থিতিশীলতার অচলায়তনে কোনও শিল্পকলাকেই তিনি ধূপ-ধুনো দিয়ে পুজো করতে চান না। নিজের গান সম্বন্ধেও যে তিনি কতটা মুক্তমনা, তা বোঝা গিয়েছিল ‘গীতালী’ সমিতির উদ্বোধনী ভাষণে। ১ জুলাই, ১৯৪০। জীবনের প্রান্তবেলায় ওস্তাদি গানের সঙ্গে তাঁর গানের পার্থক্য যে দুই যুগের পার্থক্য তা স্পষ্ট করে দিলেন। ওস্তাদি গানের যুগ রাজা-গজাদের যুগ। ‘কিন্তু যাঁরা খেটে খায়, অফিসে যায় তাঁদের পক্ষে এসব গান হয়ে উঠে না, তাঁদের পক্ষে ওস্তাদের মোট গলা সাধা শক্ত। … আমার গান আপন মনের গান – তাতে আনন্দ পাই, শুনলে আনন্দ হয়। গান হবে যাতে যাঁরা আশেপাশে থাকে তাঁরা খুসী হয়; আত্মীয়স্বজন যাঁরা অফিস থেকে আসছে – দূর থেকে শুনতে পেলেও এটা তাঁদের জন্যও ভালো। … তাই বলি আমার গান যদি শিখতে চাও, নিরালায় স্বগত নাওয়ার ঘরে কিংবা এমনি সব জায়গায় গলা ছেড়ে গাবে। আমার আকাঙ্ক্ষার দৌড় এই পর্য্যন্ত; এর খুব বেশী Ambition মনে নাই রাখলে।’ সংবাদপত্রের পাতায় প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতার এই অংশ পড়ে মনে হয় রবীন্দ্রনাথ নিজের সৃষ্টিকে, যাকে বলা চলে সাংস্কৃতিক পণ্য, নতুন মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তের সহজ ব্যবহার্য বস্তু হিসেবেই দেখতে চাইছেন খানিকটা। এ সময় সিনেমায় রেকর্ডে রবীন্দ্রনাথের গান ক্রেতার নাগালের মধ্যে। তা আর শান্তিনিকেতন-জোড়াসাঁকোয় আটকে নেই। ১৯৩৮-এর বিজ্ঞাপন ‘পূজার নূতন রেকর্ড/ নিউ থিয়েটার্স রেকর্ডস্/ মূল্য প্রত্যেকখানি ২ টাকা ১২ আনা মাত্র!/ শ্রীমতী উমাদেবী ও কে, এল সাইগল …।’ ‘কলম্বিয়া/ রেকর্ড ও গ্রামোফোন/ … জানুয়ারী মাসের নূতন রেকর্ড/ নিউ থিয়েটার্সের অধিকার চিত্র হইতে/ শ্রীযুক্ত পঙ্কজকুমার মল্লিক/ এমন দিনে তারে …।’
এই যে নিজের গানকে দিনযাপনের মধ্যে মিশিয়ে দিতে পারলেন রবীন্দ্রনাথ, ভেঙে দিতে পারলেন শিল্পশুচিতার দমবন্ধ করা ওস্তাদি সুদূরতা তা কি এর আগেও করেননি তিনি? করেছেন। স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে লিখেছিলেন একটি চিঠিতে, ‘সকালে নাবার ঘরে দুটো নৈবেদ্য লিখ্তে পেরেছিলুম।’ (ডিসেম্বর, ১৯০০) রাবীন্দ্রিক আধ্যাত্মিকতার নিদর্শন হিসেবে যে নৈবেদ্যকে দেখতে অভ্যস্ত সমালোচকরা তা কি না চানঘরের গান! রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ক্ষণিকা’ নামের কবিতার বইখানি উৎসর্গ করেছিলেন বন্ধু লোকেন পালিতকে। লিখেছিলেন,
আশা করি নিদেন-পক্ষে
ছ’টা মাস কি এক বছরই
হবে তোমার বিজন-বাসে
সিগারেটের সহচরী।
কতকটা তার ধোঁয়ার সঙ্গে
স্বপ্নলোকে উড়ে যাবে–
কতকটা কি অগ্নিকণায়
ক্ষণে ক্ষণে দীপ্তি পাবে?
কতকটা বা ছাইয়ের সঙ্গে
আপনি খসে পড়বে ধুলোয়,
তার পরে সে ঝেঁটিয়ে নিয়ে
বিদায় কোরো ভাঙা কুলোয়।
ভাগ করে সিগারেট খাওয়া আর কবিতা পড়ার এতোল-বেতোল বিবরণ আছে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের লেখা স্মৃতিকথা ‘কল্লোল যুগ’-এ। পরবর্তী কালে সে আদল অন্যভাবে এসেছে সুনীল-শক্তির ‘কৃত্তিবাস’-এ। তাই বলে রবীন্দ্রনাথের কবিতার বই– ছাই ও সিগারেটে মিশে যাবে! কীভাবে পড়ব-শুনব আমরা রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকে? কীভাবে কোন পরিবেশে যাপন করব রবীন্দ্রনাথ? রবীন্দ্রনাথকে ঠাকুরের মর্যাদায় কেবলই দূরে রাখব না কি প্রিয় করে নেব দেবতাকে! তার উত্তর খুঁজলে রবীন্দ্রনাথেই পাওয়া যাবে।