‘ধর্ষণ’ এই বিষয়টিকে কেমনভাবে দেখতেন রবীন্দ্রনাথ? প্রশ্ন শুনে বিচলিত হওয়ার কারণ নেই। রবীন্দ্রনাথকে দেহহীন অসীমের পথে ধাবমান কবি বলে ভেবে আধ্যাত্মিক উদ্গার তুলে তৃপ্ত হন যাঁরা– সেই সমস্ত সুললিত সমালোচকের হাত থেকে রবীন্দ্ররচনাকে মুক্ত করাই এখন আমাদের কাজ। পিতৃতন্ত্র যে নানাভাবে নারীর শরীর ও মনকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে দলে-পিষে দেয় আর তাকেই যে বলা চলে নারী-ধর্ষণ, রবীন্দ্রনাথ খুবই জানতেন তা। সবচেয়ে বড় কথা, দাম্পত্য ক্ষেত্রে স্ত্রীর শরীর-মনের ওপর যে স্বামীর নির্বিচার অধিকার নেই, তা যে স্ত্রীর ইচ্ছাধীন ও অনুমতি সাপেক্ষ, এই নৈতিকতায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি।
রবীন্দ্রনাথের ‘মানসী’ নামের কবিতার বইটিতে ‘নারীর উক্তি’ নামের একটি কবিতা এখানে চোখে পড়ে। সেখানে মেয়েটি বলেছে তার স্বামীকে, ‘অপবিত্র ও করপরশ/ সঙ্গে ওর হৃদয় নহিলে।’ ‘নারীর উক্তি’ ধর্ষণ বিষয়ক কবিতা নয়, দাম্পত্য প্রণয়ের অবসানের কবিতা। একত্র বসবাসের ক্লান্তি বা অন্য কোনও কারণে স্বামীহৃদয়ে নারীটির প্রতি আগের মতো সেই প্রেম ও বিস্ময়বোধ নেই। আর তাই বলেছে সে ভালবাসার বোধহীন শারীরিক স্পর্শ, তা যদি স্বামীরও হয়, তাহলেও তা অপমানজনক, অপবিত্র। এই যে নারী তার শরীরের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন হচ্ছে, স্বামীমাত্রকেই যে কোনও চেহারায় যে কোনও অবস্থায় গ্রহণ করতে নারাজ, এ আত্মমর্যাদা বোধের ফল। উনিশ শতকে কৌলীন্য প্রথা, বহুবিবাহ, সহবাস সম্মতি আইন এই বিষয়গুলি নিয়ে সামাজিক স্তরে কথা হচ্ছে। কাজেই স্বামী নামের পুরুষ-পুঙ্গবটি ইচ্ছে করলেই স্ত্রীকে তাঁর ‘সম্পত্তি’ হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন না।
যে রবীন্দ্রনাথ ‘নারীর উক্তি’ লিখতে পারেন, সেই রবীন্দ্রনাথই লেখেন ‘যোগাযোগ’-এর মতো উপন্যাস। এ উপন্যাস ‘ম্যারিটাল রেপ’-এর ইঙ্গিতবাহী। পড়তি জমিদার বাড়ির মেয়ে কুমুকে বিয়ে করেছে উঠতি ব্যবসায়ী মধুসূদন ঘোষাল। এ বিয়ে মধুসূদনের কাছে কেবল বিয়ে নয়। যে জমিদার বাড়ির অর্থনৈতিক বৈভব দেখে সে ছেলেবেলায় বড় হয়ে উঠেছিল সেই জমিদার বাড়ির পড়তির দিনে সেই বাড়ির মেয়েকে নিজের স্ত্রী হিসেবে পাওয়া ও তাকে সর্বাত্মকভাবে ভোগ করা একদিক দিয়ে তার জয়লাভ। কুমুকে বিয়ে করার পর সে বুঝতে পারে কিছুতেই এই মেয়েটিকে শরীরে মনে সে উপভোগ করতে পারছে না। দাদা বিপ্রদাসের কাছে যে রুচিশীলতা অর্জন করেছে কুমু তার আবরণ ভেদ করে উঠতি ব্যবসায়ী মধুসূদন প্রবেশ করতে পারছে না, পারছে না বলেই তার পৌরুষ আহত হচ্ছে– ক্রোধ জেগে উঠছে। সেই ক্রোধেরই অন্তিম প্রকাশ দাম্পত্য-সংগম। কুমু নিরুপায়-অনিচ্ছায় শেষ অবধি শরীরটি পুরুষকে দিতে বাধ্য হয়েছে। সেই মিলনের মধ্যে যে শরীরে ও মনে তাকে কতটা গ্লানি বহন করতে হয়েছে, তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, কুমুর বিধ্বস্ত শরীরের বিবরণে। সকালে নিরুপায় লজ্জায় ছাদে আশ্রয় নিয়েছে ‘ধর্ষিত’ কুমু। কুমুর দাম্পত্যজীবনে ধর্ষণের মধ্যে কেবল পুরুষের লালসাই ক্রিয়াশীল ছিল না, তার মধ্যে ক্ষমতার দম্ভ মিশে ছিল। উঠতি ব্যবসায়ী যেন কুমুর শরীর নয় জমিদার বাড়ির ঐতিহ্য-সংস্কৃতি সব কিছুকে ‘লিঙ্গসাৎ’ করতে চাইছে। ধর্ষণ তার জয়যুদ্ধ।
এখানেই রবীন্দ্রনাথ ধর্ষণকে আর নিতান্ত যৌনক্রিয়া হিসেবে দেখছেন না, ক্ষমতা সম্পাদন ক্রিয়া হিসেবে দেখছেন। মানুষ মানুষকে খুন করলে প্রকাশ্য প্রতিবাদ করতে আমরা দ্বিধা করি না, কিন্তু ধর্ষিতা মেয়েটি ধর্ষণের কথা প্রকাশ্যে বলতে দ্বিধা করেন। এই দ্বিধার কারণ যৌন-নৈতিকতা, মেয়েদের সতীত্ব সম্বন্ধে সামাজিকদের প্রতিক্রিয়াশীল মানসিকতা। ধর্ষিতা হওয়ার ক্ষেত্রে যে মেয়েটির সতীত্ব বিচার্য নয়, ধর্ষকের আধিপত্যকামী অনৈতিক আচরণই নিন্দনীয়– একথা ধরা পড়েছিল রবীন্দ্রনাথের শেষ পর্বের একটি কবিতায়। ‘আকাশপ্রদীপ’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘ঢাকিরা ঢাক বাজায় খালে বিলে’ কবিতাটি আমাদের বিষণ্ণ করে। কলু-বুড়ির সমত্থ নাতনিটিকে দেখা যাচ্ছে না। কোথায় গেল সে? চৌকিদারের মুখ থেকে জানা গেল, ‘যৌবন তার দলে গেছে জীবন গেছে চুকে’। কে তাকে ধর্ষণ করে খুন করেছে? সে কি ধরা পড়বে? শাস্তি পাবে? পাবে যে না, সে কথা কবিতাতে স্পষ্ট। ‘উপায় নাই, নাই প্রতিকার বাজে আকাশ জুড়ে।’ খুনি ধর্ষকের শাস্তি হল না কিন্তু গোটা কবিতায় ফিরে ফিরে এল একটি দৃশ্য। ‘জমিদারের বুড়ো হাতি হেলে দুলে চলেছে বাঁশতলায়, / ঢঙ্ঢঙিয়ে ঘণ্টা দোলে গলায়।’
জমিদারতন্ত্রেই কি কেবল কলু-বুড়ির নাতনিরা ধর্ষিত হয়, পুঁজিতন্ত্রের ক্ষমতাশালায় হয় না? সেখানে ধর্ষকেরা ঠান্ডা মাথার লোক। শতবর্ষ আগের ‘রক্তকরবী’ নাটকের খনিশহর যক্ষপুরীর কথা মনে নেই? সর্দাররা রাজাকে ক্ষমতার মাথায় বসিয়ে রেখে মুনাফার জন্য খনিশ্রমিকদের চালনা করে। এই যান্ত্রিক পুঁজিতন্ত্রকে ভাঙতে চায় রঞ্জন ও নন্দিনী। সর্দাররা তাই পরিকল্পনা করে কৌশলে রাজাকে দিয়ে বিপ্লবী রঞ্জনকে খুন করায়। আর নন্দিনীর জন্য কি পরিকল্পনা তাদের?
‘সর্দার। … এবার কিন্তু ঐ মেয়েটাকে অবিলম্বে–
মেজো সর্দার। না না, এ-সব কথা আমার সঙ্গে নয়। যে মোড়লের উপর ভার দেওয়া হয়েছে সে যোগ্য লোক, সে কোনোরকম নোংরামিকেই ভয় করে না।’
নাটকে গূঢ়কথা প্রকাশ করা হয়নি, কিন্তু একটি মেয়ের প্রতি কোনওরকম নোংরামি যে ধর্ষণ, তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। সর্দারদের সে পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছিল। নন্দিনী লড়াই করে ভাঙতে উদ্যত হয়েছিল যক্ষপুরী। শতবর্ষ পরে স্বাধীন ভারতের ভেতরে কত মণিপুরের মা যে রাজনৈতিক ধর্ষণের শিকার!